ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইউএসএ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

সোমবার বিতর্ক: ঘোড়েল ঘায়েলের কৌশল হিলারির জানা

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬
সোমবার বিতর্ক: ঘোড়েল ঘায়েলের কৌশল হিলারির জানা

রাজনীতির ঘোড়েল আর গোঁয়ার বৈষম্যবাদীদের বিতর্কের টেবিলে কি করে ঘায়েল করতে হয় তা হিলারি ক্লিনটনের ভালোই জানা আছে।

তবে এবারের কথা ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে বিতর্কের মঞ্চে এমন সব প্রসঙ্গ আসবে যে তা মোকাবেলায় কেবল জ্ঞান, ধারণা আর যুক্তি খণ্ডনের দক্ষতা থাকলেই চলবে না। তার পাশাপাশি দিতে হবে চরম ধৈর্যের পরিচয়।

স্থানীয় সময় সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাতে এবারের প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের প্রথম আয়োজনে তিনি মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন সময়ের সবচেয়ে প্রকাশ্য নারীবিদ্বেষী ডনাল্ড ট্রাম্পকে। তাই ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবেলা করার সকল প্রস্তুতিই নিচ্ছেন হিলারি ক্লিনটন।

বহুল প্রত্যাশিত এই বিতর্কে লিঙ্গ প্রসঙ্গের যে দিকগুলো উঠে আসবে তা একটু স্থুল, সোজাসাপ্টা আর অনেকাংশেই কৌতুকপূর্ণ হয়ে উঠবে বৈকি।

তবে এবার হিলারি যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তেমনটা তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আর কখনোই নিতে হয়নি। হোক তা ছাত্রকালীন বার পরীক্ষার প্রস্তুতি, ২০০০ সালের সিনেট নির্বাচনের ডিবেট, ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতার ডিবেট, কিংবা এই সে দিনের ২০১৬ সালের ডেমোক্র্যাট প্রার্থীতায় জনপ্রিয় বার্নি স্যান্ডার্সের বিপক্ষে ডিবেটের প্রস্তুতি।

ক্যারিয়ারের সবগুলো বাঁকে তাকে লড়াই করে জয়ী হতে হয়েছে যেখানে পুরুষই ছিলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। পুরুষেরই ছিলো প্রাধান্য। সুতরাং লিঙ্গ প্রসঙ্গ বারবারই এসেছে। আর সেগুলো মোকাবেলা করেই তিনি এগিয়েছেন।

সিমন্স কলেজের প্রফেসর ইমেরিটাস ডেবোরা কব একটি আলোচনায় সেকথাই বলছিলেন। তিনি বলেন, “এসব কথা শুনে শুনেই এগিয়েছেন হিলারি”। নেগোশিয়েটিং অ্যাট ওয়ার্ক নামক বইয়ের রচয়িতা, ক্যারিয়ার সচেতন নারীদের উপদেষ্টা হিসেবে সুপরিচিত এই অধ্যাপক নারীদের এই সময়গুলোকে বলেন ‘ঘুরে দাঁড়ানো’।

ঠিক তাই। কেউ যখন তোমাকে হেয় করে, তখন তুমি তার নেতিবাচকতাকে তার দিকেই ফিরিয়ে দাও। যেমন, কেউ বললো ‘তোমাকে আজ ক্লান্ত লাগছে’। মানে হচ্ছে তুমি আজ কাজের জন্য ফিট নয়। তখন তুমি তাকে বলে দাও, আসলে আমি এ ধরনের মন্তব্য শুনতে শুনতেই ক্লান্ত।

২০০৮ সালের বিতর্কে নিউ হ্যাম্পশায়ার পাইমারির আগে বারাক ওবামার সঙ্গে বিতর্কে হিলারির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, কেন ভোটাররা তার চেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেশি পছন্দ করে।  

উত্তরে ক্লিনটন মুচকি হাসলেন। বললেন, “জ্বি, আপনার কথা আমার অনুভূতিতে আঘাত করেছে। তবে আমি কিন্ত দমছি না, আমি এগিয়ে যাবো। তখন এই কথা বলতে বলতে তার চোখে আনন্দের ঝলকানিই খেলে যাচ্ছিলো। ক্ষণকাল পরে ওবামা যখন বলে উঠলেন, ‘হিলারি আপনি যথেষ্ঠই পছন্দনীয়’ তখন তিনি তার সুন্দর চেয়ার নাচটাই দেখালেন।

সেবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীতা ওবামাই জয় করেছিলেন ঠিকই, তবে নিউ হ্যাম্পশায়ারের প্রাইমারি কিন্তু হিলারির ঝোলায় ঢুকেছিলো। ধারনা করা হয় ওই বিশেষ মুহূর্তটিতেই তিনি জয় করে নিয়েছিলেন নিউহ্যাম্পশায়ারবাসীর হৃদয়।

‘পছন্দনীয়তা’ একটি বিষয়। আর এ কথা খুব স্বীকৃত যে, এমন একটি প্রশ্ন কোনও পুরুষ প্রার্থীকে কখনোই মোকাবেলা করতে হয়নি। ২০০৮ সালে জন ম্যাককেইনের ব্যক্তিত্ব নিয়ে কি কেউ প্রশ্ন করেছিলো। জিওপি’র প্রাইমারিতে এই ডনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দনীয়তা নিয়েই কী কোনও প্রশ্ন হয়েছে?

২০০০ সাল। হিলারি সেবার নিউ ইয়র্কের সেনেটর নির্বাচিত হলেন। কিন্তু সেবারের বিতর্কের দিনটির কথা স্মরণ করুন (উপরের ভিডিওতে দেখুন)। হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসম্যান রিক ল্যাজিও বিতর্কের মঞ্চে তার সীমারেখা অতিক্রম করে হিলারির পাশে চলে এসেছিলেন আর অর্থ খরচ বিষয়ে একটি অঙ্গীকারনামা সই করতে চাপ দিচ্ছিলেন। এমনকি হিলারির দিক আঙ্গুলও নাচিয়েছিলেন ল্যাজিও। পরে তার এই আচরণকে মাদার জোন্স বেয়াড়াপনা, আর নারী বিদ্বেষী বলেই উল্লেখ করেন ও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ওই কংগ্রেসম্যান। ল্যাজিও এখনও বলেন, ওই বিশেষ মূহর্তটিই আসলে তাকে শেষ করে দিয়েছে। সেবার হিলারির কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছিলেন ল্যাজিও।

হিলারিকে যখন স্মার্ট, অভিজ্ঞ, দক্ষ বিতার্কিক বলা হয়, তখনও একটা ইঙ্গিত থাকে, পুরুষ সহকর্মীদের কারণেই তিনি এমনটা হতে পেরেছেন। কিন্তু সে নিয়েও অধ্যাপক কব’র মত হচ্ছে- এতে আসলে তারা একটি ফাঁদেই পা দেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিটা অনেকটা পুরুষদের ক্লাব। পুরুষরাই কংগ্রেসের ৮০ শতাংশ আসন দখলে রেখেছেন। গভর্নরদের অধিকাংশই পুরুষ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনও নারী কখনোই আসেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সেই জন্মাবধি হিলারি মোটে ৪৬ জন নারী সিনেটরের একজন।

পুরুষ রাজনীতিকরা যখন নারীর বিপক্ষে তখন তারা প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু দেখেন না। আর অন্য দিকে হিলারি কিন্তু প্রস্তুতিটিকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখেন আর সারা জীবন পুরুষদের কক্ষপথেই নিজেকে আসীন রেখেছেন।

সম্প্রতি হার্ভার্ড ল স্কুলে তাকে কেমন বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ মোকাবেলা করতে হয়েছিলো তার একটি উদাহরণ দেন হিলারি ক্লিনটন।

তিনি বলেন: আমি সেবার  ল’ স্কুলে ভর্তি পরিক্ষা দিচ্ছিলাম। হার্ভার্ডের বিশাল ক্লাসরুমে পরীক্ষা দিতে গেলাম। গোটা কক্ষে নারী মোটে জনা কয়েক। তার মধ্যে আমি আর এক বন্ধু। আমার কিছুটা নার্ভাসও লাগছিলো। কলেজে আমি সিনিয়র। পরীক্ষায় কেমন করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমরা যখন পরীক্ষা শুরু হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম একদল ছেলে ঢুকলো আর আমাদের কাছে এসে খুব চেঁচামেচি শুরু করলো। ‘তোমাদের এই পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। তোমরা এখানে কেনো?’ এইসব বলতে লাগলো। আরও অনেক কাজ আছে তোমাদের জন্য। এদের একজন এও বলতে ছাড়লো না, তুমি যদি আমার সুযোগটি নিয়ে নাও, আমি বাদ পড়ে যাই তাহলে আমাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে হবে। সেখানে আমি মারা পড়বো। আর এমন নয় যে ওরা মজা করছিলো। ওরা চাইছিলো আমরা যেনো পরীক্ষায় না বসি। আমার খুব আঁতে ঘা লাগছিলো। কিন্তু কোনও উত্তর দিতে পারলাম না। আসলে দিলাম না। কারণ আমি চাইনি কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে নিজের পরীক্ষাটাই খারাপ দেই। সুতরাং আমি নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম। আর মনে মনে প্রত্যাশা করতে থাকলাম প্রক্টর যদি একবার রুমে ঢুকতেন। আমি জানি আমি প্রয়োজনে শান্ত ও ভাবাবেগ শূন্য হয়ে যেতে পারি। কিন্তু ওই ছোট্ট বয়সেই আমাকে আমার অাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয়েছে। আর সে ছিলো এক কঠিন পথ যা মাড়িয়ে আমি এতটা দূর এসেছি। কারণ আপনার সুরক্ষা আপনাকেই দিতে হবে। আপনাকেই দৃঢ় থাকতে হবে। তবে আমি ভাবাবেগ শূন্য কেউ নই, আমারও আবেগ অনুভূতি প্রবল। আমার বন্ধুরা তা ভালোই জানে। পরিবারের সবাই জানে। কিন্তু আমার আচরণে যদি আমাকে অনুভূতিহীন মনে হয়, বা কেউ যদি আমাকে তেমনটা ভাবেনও আমি তাদের দুষবো না।       

নিজের নামটি রডহ্যাম থেকে ক্লিনটনে পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্তকে ১৯৮০ সালে তার স্বামী বিল ক্লিনটনের আরকানসাসের গভর্নর পদে হেরে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়। বিলের প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্র্যাঙ্ক হোয়াইট পুরো সময় জুড়েই বক্তৃতায় স্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে আনতেন আর বলতেন তার স্ত্রীর নাম মিসেস ফ্রাঙ্ক হোয়ইট। আর বিলের স্ত্রী হিলারি রডহ্যামই থেকে যাচ্ছেন। দুই বছর পর বিল ক্লিনটন যখন ফের গভর্নর পদে লড়াইয়ে নামলেন হিলারি তার নামটি পাল্টে হিলারি ক্লিনটন করে নিলেন।

এমন লিঙ্গ প্রসঙ্গ বারবারই এসেছে তার সামনে। এমনও কথা এসেছে তাকে দেখতেই প্রেসিডেন্টের মতো মনে হয় না।

পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখবো হিলারিকে এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে যার একটিও কোনও পুরুষকে করা হলে তিনি তা হজম করতেন না।

বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে বিতর্কে উচ্চকণ্ঠে কথা বলার জন্যও তার সমালোচনা হয়েছে।

নিশ্চয়ই নয়, এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে সোমবার রাতে ট্রাম্পের চেয়ে হিলারি ক্লিনটনই হবেন সেরা বিতার্কিক। তার হাতে ওয়াইল্ড কার্ড থেকে যাচ্ছে। যদিও ট্রাম্পের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কম কিন্তু তিনিও জানেন কি দিয়ে ঘায়েল করতে হয়।

এছাড়াও লিঙ্গই প্রসঙ্গই একমাত্র নয়, হিলারিরও দুর্বল দিক কিছু রয়েছে। যা সামনে এলে তাকে নাজুক হতেই হবে। বিশেষ করে ই-মেইল প্রসঙ্গ।

আর ওই যে নারীরা মোটা শুকরী, নারীর স্তনদান অসহ্য, নারীরা ঘরে থাকাই ভালো- ট্রাম্পের এ জাতীয় কথাবার্তা হিলারির জন্য নতুন কিছু নয়। এ অবস্থায় তার ধৈর্য্য বারবারই পরীক্ষিত। এ ধরনের অবমাননাকে তিনি যথেষ্ঠ যোগ্যতার সাথেই ফিরিয়ে দিতে পারেন। আর সেটা যদি নাই পারতেন- সেই কবে থেকেই তাকে চাপ্পাকুয়ার বাড়িতে কুকি ভেজে সময় পার করতে হতো।

বাংলাদেশ সময় ২০১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।