দূর্গাপুর (নেত্রকোনা) থেকে ফিরে: ‘দাদা, তুমি কইনো (কোথায়)? ঢাহাততে (ঢাকা থেকে) লুক (লোক) আইছে, ফডো (ছবি) তুলবো। ’
অগ্রহায়ণের দ্বিতীয়া দিবসের দুপুর বিকেলের দিকে যাত্রা শুরু করেছে।
মহাআগ্রহে কোনো এক সোনালি জমিনের আলপথ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে ছুটলো নাতি ফারুক ইসলাম। এদিকে, আগন্তুকদের ঘিরে কৌতুহলের জটলা।
বাউলের ‘পুতি’ আজহারের (৫) ক্যামেরা নিয়েই আগ্রহ বেশি। দু-চারবার নানা ছুতোয় ছুঁয়ে দেখা হয়ে গেছে। কায়দা করে নিজের ছবিও তুলে নিলো এক ফাঁকে।
এর মধ্যে হাজির আকাশী রঙের পাঞ্জাবি, পকেটে মাথা উঁচু করা কলম ও মাথায় সাদা টুপি পরা ওমর বাউল। এসেই হাত বাড়িয়ে লম্বা সালাম। চাটাই পেতে বসলেন মাটিলেপা ঘরের পিছনের বারান্দায়।
এদিন দুপুরে কথা হচ্ছিল সুসং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক সাদেক আলীর সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে ওঠে পালাগানা, জারি, সারি, বাউল, পুঁথিপাঠের কথা। তিনিই খোঁজ দিলেন দূর্গাপুর অঞ্চলের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বাউল ওমরের।
তার কথা, আপনারা সোজা তার কাছে চলে যান। তিনি সব জানেন! তার কাছে সব পাবেন।
সাদেক আলীর কথা মতো দশাল গ্রামের পথ ধরে ৯৪ বছর বয়সী এ বাউলের বাড়ি। ভেবেছিলাম, থুত্থুরে স্মৃতিভ্রষ্ট কেউ হবেন। কিন্তু হলো তার ঠিক উল্টো। ১৩ বছর বয়স থেকেই শুরু করেছেন গান গাওয়া।
কোনো এক গ্রাম্য আসরে গান শুনে সেই যে সুর আর কথার প্রেমে বাঁধা পড়েছিলেন, সেই বাঁধন এখনও কাটেনি। কিশোর বয়সেই তালিম নেন স্থানীয় মোবারকপুর গ্রামের বাউল গুরু তৈয়ব আলীর কাছে। তার কাছে আট-নয় বছর গান শিখেছেন। এরপর একদিন গুরু ডেকে বললেন, যা! তুই এবার নিজেই গান কর, গান বাঁধ।
‘আল্লাহর রমহতে আর আমনেরার দোয়ায়, একবার হুনলেই যে কোনো গান ধরতে পারতাম। হেইডা যতো কঠিনই অউক। গুরুজি ডাইক্যা তার বান্ধা গানও গাওয়াইছুইন। আমার গাওন হুইন্যা হেইলা খুশি অইতাইন। হরে একটা সময় আইয়া আমরে গাওনের আদেশ দিছুইন। এরহর তে হারাজীবনই গান লইয়া আছি। ’
‘আমি জীবন ভরিয়া কতো কষ্ট করিয়া
পালতেছি একটা বেঈমান পাখি
জানি না, সেই পাখিটা আগে ছিলো কার
ডাক শুনিয়া কাগা-ময়না হইলো তাবেদার।
..................................................
চৌদ্দতলা পিঞ্জরে তার মুধ্যে তার আসন
উপরে হইতে নিচে নামে মনডায় লয় যখন
পাখি কেউরে হাসায় কেউরে কাঁদায়
কেউর ঘরে কখন মারে উঁকি
আমি জীবন ভরিয়া কতো কষ্ট করিয়া
পালতেছি একটা বেঈমান পাখি
................................................’
(বাউল তৈয়ব আলী)
ব্যক্তিগত জীবনে বাউলের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের ঘরে আবার তিন ছেলে, দুই মেয়ে। তাদেরও ছেলে-মেয়ে হওয়ায় পুতি-পুতনি দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে তার। এখন তাদের আদর-আবদার শুনে দিন কাটে। কথা বলার সময়ও পুতি আজহারের চারপাশে পাক দেওয়া বন্ধ হয়নি। কয়েকবার বললেনও, ‘যা! অহন ভিতরে যা। ’
স্মৃতি হাতড়ে গল্প শোনান, একসময় মাসের ত্রিশ দিনই গান-বাজনার বায়না আসতো। মহররম, উরশ, হালখাতা, স্থানীয় উৎসব বা গ্রামের লোক টাকা তুলে করা গানের আয়োজনেই বেশি ডাক পড়তো।
নিজ জেলা নেত্রকোনা ছাড়াও ডাক পড়েছে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। গান করে এসেছেন সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলে গিয়েও।
বিভিন্ন সময় চাহিদা অনুযায়ী পুঁথি-পালা গাইলেও নিজের বিশেষত্বের জায়গা- কবি গান, জারি ও মালজোড়া (প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে উপস্থিত বাঁধা গান)। বিষয়বস্তু হিসেবে আধ্যাত্ম ও দেহতত্ত্বই তার প্রিয় বিষয়।
‘আমি নামের পাগল হইলাম গো
কোথায় পাই তাহারে
দিবা-নিশী অন্তর আমার ফুরফুরা পুড়া পুড়ে
কোথায় পাই মওলারে। ’
(ওমর বাউল)
দু-চার লাইন নিজের বাঁধা গান মুখে মুখে শোনালে অনুরোধ ছুটে যায় সুর করে গাওয়ার জন্য।
অনুরোধ করতেই হাসিমুখে বললেন, ‘এহন আর গাই না। আমার শিষ্যরা গায়। আমার একতারা, বেলা (বেহালা), সারিন্দা, হারমুনি (হারমোনিয়াম) বেকতাই হেরারে দিয়া দিছি। হেরার কোনো গান (অনুষ্ঠানে) অইলে যাই। তহন মাইনষ্যে অনুরোধ করলে একটু-আধডু গাই। যন্ত্র-টন্ত্র তো হেরারে সব দিয়ালছি। এইসব ছাড়া তো আর গান অইবো না!’
এরপরও অনেক অনুরোধে হালকা সুরে গাইলেন দু-তিনটি গান। মাটি আর উরুতে দুই হাতের তাল দেওয়া গানে মন্ত্রমুগ্ধ করলেন সবাইকে। কে বলবে বয়স ৯৪!
শিল্প-সংস্কৃতি এভাবেই বোধহয় মানুষকে সজীব ও অফুরান প্রাণের অধিকারী করে তোলে!
আগের মতো কি এইসব গানের কদর আছে? ‘হ্যাঁ, আছে না, আছে। এহনও মানুষ হোনে। এহনও ডাক পাই। হোনেন, বেক (সব) জাগাত (জায়গা) তো আর হমান (সমান) না। কেউ এইডারে পছন্দ করে, কেউ করে না। যারা করে হেরাই ডাকে আর কি। ’
তিনি শিল্পী; তাই সবকিছুতে ভালো ও অল্পকেই বড় করে দেখেন। কিন্তু এ অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতো, লোকগানের কদর এখন আর আগের মতো নেই। তরুণ প্রজন্ম এ শিল্পের সঙ্গে জুড়তে নারাজ।
প্রবীণরাই বরং এসব নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগেন। এজন্য মোবাইল ফোন ও বিশ্বায়নকেই ‘দায়ী’ করলেন তারা।
বাউল ওমর আলীর শিষ্যদের মধ্যে এখন অধিকাংশই পুরোদস্তুর বাউল। তাদের মধ্যে বাচ্চু, মান্নান, রফিকুল, হাশেম উল্লেখযোগ্য।
তাদের সম্পর্কে বললেন, ‘আমি এহন ঘরে বইসাই টেহা-পয়সা পাই। হেরা (শিষ্যরা) কোনো অনুষ্ঠানে গেলে, কিছু টেহা আমার বাড়িতও আয়। আমারে আইয়া দিইয়া যায়। ’
ওমর বাউলের নিজের বাঁধা গান রয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০টি। এর সবগুলোই অসংরক্ষিত। নিজেই মুখস্থ করে রেখেছেন, কিছু তার শিষ্যদের মুখে মুখে ফেরে। কোথাও লিখে রাখা নেই। কোনো ক্যাসেট-সিডিও বের হয়নি।
বয়সের ভারে দৃষ্টিশক্তি একটু কমে এলেও এখনও তার স্মৃতিশক্তি অবাক করার মতো। নিজের গানের পাশাপাশি কারবালা, গাজী কালু, রামায়ণ, মহাভারতসহ প্রায় আট-দশটি পুঁথি তার ঠোঁটস্থ। এখনও কোনো বিষয় বুঝিয়ে দিলে উপস্থিত গান বেঁধে দিতে পারেন তিনি।
তার নিজের ভাষায়, ‘এহন আমি গানবাজনা ছাইড়া দিছি। কোনো হানে যাই-ও না। কোনো হিস্টরি যদি আমনে বুঝায়ে দেইন বা কেউ-র (কারও) জীবনী এইভাবে-ওইভাবে অইছে- হিস্টরি বুঝায়ে দিলে এহনও গান বান্ধতে হারি। ’
বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেতের মধ্যে তার বাড়ি। লোকশিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম আধার ভাটির দেশ নেত্রকোনার ভূমিপুত্র তিনি। এই গ্রাম-বাংলা, জল-ভূগোল, উঠানে লাউশাকের মাঁচা, কলকলা সুমেশ্বরী-কংসের জল, পাখির গীত তাকে বাউল বানিয়েছে।
বয়সের ভার দিন দিন শরীরকে কব্জা করে নিচ্ছে, তারপরও প্রিয় গ্রামের মানুষের অনুরোধ ফেলেন না। পয়লা অগ্রহায়ণেও তাদের জন্য শুনিয়েছেন। এই চাষা-ভূষো মানুষের কাছে যে তার অনেক ঋণ।
সেটা তিনি নিজেও বলেন, ‘আমি তো পল্লীকবি, গাঁও-গেরামের গানই বেশি গাইছি। অহন গাঁও-গেরামের গান গাইতে গাইতেই মরতে চাই!’
**ওমর বাউলের গান (ভিডিও- সৌমিন খেলন)
বাংলাদেশ সময়: ০০০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৬
এসএনএস/এমএ