ঢাকা, শনিবার, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

নাটোরে কমেছে রসুন চাষ

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৩
নাটোরে কমেছে রসুন চাষ

নাটোর: দেশের মোট উৎপাদনের ২৬ শতাংশ রসুন উৎপাদিত হয় নাটোর জেলায়। বিগত কয়েক বছর হলো দেশের এক-তৃতীয়াংশ রসুন উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে স্থান ধরে রেখেছে নাটোর।

 

অথচ গেল দুই বছর রসুনের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অনেক কৃষক এবার এ ফসল চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে রসুন চাষের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে ঝুঁকে পড়ছেন তারা। এতে চলতি মৌসুমে রসুন চাষে কৃষি বিভাগের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গত বছরের তুলনায় এবার ৫ হাজার ৯২৩ হেক্টর কম জমিতে রসুনের আবাদ হয়েছে। কারণ গত মৌসুমে চাষকৃত রসুনে লোকসান গুণতে হয়েছে কৃষকদের।

চলতি মৌসুমে সার-কীটনাশকের দামের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। ফলে এবার রসুন চাষে বিঘায় খরচ পড়ছে ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। যারা জমি লিজ নিয়ে আবাদ করছেন, তাদের খরচ পড়ছে আরও বেশি। এরপরও দেশের সর্বাধিক রসুন উৎপাদনকারী জেলা নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার চাষিরা নিজেদের উদ্ভাবিত বিনা চাষে রসুন বুনতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ন্যায্য দাম পেলে লোকসান পুষিয়ে নেবেন এমন প্রত্যাশা করছেন তারা।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশক ধরে গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলাসহ জেলার সাতটি উপজেলায় বিনা চাষে  ব্যাপকভাবে রসুন বপন করা হচ্ছিল। আশানুরূপ ফলন আর ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় ক্রমাগত রসুনের আবাদ বাড়তে থাকে। ফলে দেশের মোট চাষের ২৫ শতাংশ এবং মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ রসুন চাষ হতে শুরু করে নাটোরে।  
ফলে এখানকার উৎপাদিত রসুন সমগ্র দেশজুড়ে সাদা সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন এলাকার কয়েক হাজার কৃষক। কিন্তু গেল দুই বছর ধরে রসুনের কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। তাই এবার চাষে অনেকাংশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতি হেক্টর জমিতে রসুনের গড় ফলন হয় ৮ দশমিক ২ মেট্রিক টন। সেখানে নাটোর জেলায় প্রতি হেক্টরে গড় ফলন হয় ৮ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। জাতীয়ভাবে সারা দেশে গড়ে ৮৭ হাজার ৫৬০ হেক্টর থেকে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে রসুনের চাষ হয় এবং মোট রসুন উৎপাদন হয় ৭ লাখ ২৯ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন থেকে প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন। সেখানে শুধুমাত্র নাটোর জেলাতেই ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে রসুন চাষ হতো। তবে এবার চাষ কমেছে ৫ হাজার ৯২৩ হেক্টর।

সূত্র জানায়, সব মাটিতেই রসুনের চাষ হয়। তবে নাটোরের মাটি অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু ঊর্বর বেশি। তাই এখানকার চাষকৃত রসুনের ফলন অন্য এলাকার তুলনায় একটু বেশি হয়। এছাড়া বিনা চাষে রসুন সময় মতো বপন ও উত্তোলনের কারণে ফলন ভালো হয়। তবে উৎপাদনকৃত এসব রসুন সংরক্ষণ করে সময়মতো সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে কৃষকরা বেশি লাভবান হতে পারতেন। এজন্য এ এলাকায় রসুন সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সেটি না থাকায় কৃষকদের প্রতি বছর রসুন নিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।    

কৃষি বিভাগ সূত্র আরও জানায়, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ২২ হাজার ৬৬৮ হেক্টর জমিতে  রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার ১৩১ মেট্রিক টন। এবার চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ১৬ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ হাজার ৯২৩ হেক্টর কম জমিতে রসুন চাষ হয়েছে।

গত ২০২১-২২ মৌসুমে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ২ হেক্টর। সেখানে চাষ হয়েছিল ২১ হাজার ৯৭০ হেক্টর আর রসুন উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার  ১২৪ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ মৌসুমে ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে চাষ করে ২ লাখ ১৮  হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৯-২০ মৌসুমে ২১ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে চাষ করে মোট রসুন উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭৮ মেট্রিক টন।  

সূত্র জানায়, এবারও জেলার গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায় সবচেয়ে বেশি জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সদর উপজেলায় ৩ হাজার ১৮ হেক্টর, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৫৫০ হেক্টর, সিংড়া উপজেলায় ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর, বড়াইগ্রাম উপজেলায় ৯ হাজার ৬০০ হেক্টর, লালপুর উপজেলায় ১ হাজার ৩০০ হেক্টর ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে।

প্রতি জন ব্যক্তির দিনে ১৫ গ্রাম হারে রসুনের প্রয়োজন হলে জেলায় মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বছরে রসুনের চাহিদা দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। আর নষ্টসহ মোট চাহিদা ২৭ হাজার ৪১১ মেট্রিক টন। সেখানে প্রতি বছর গড়ে রসুন উৎপাদন হচ্ছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৯৮ মেট্রিক টন। বছরে উদ্বৃত্ত থাকছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব রসুন যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। তবে এবার রসুনের শ্বেত বিপ্লব নয়,  ছেদ ঘটার আশঙ্কা কৃষি সংশ্লিষ্টদের। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রসুন উৎপাদন হবে এ জেলায়।

বড়াইগ্রাম উপজেলার রয়না ভরট গ্রামের কৃষক মো. রঞ্জু জানান, রসুন চাষে তিন মাস সময় লাগে। প্রতি বিঘা রসুন চাষে খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার। খরচ বাদে লাভ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তিনি গত ২০ বছর ধরে রসুন চাষ করছেন। কিন্তু গত দুই বছর ধরে রসুনের দাম কম, উৎপাদন খরচ উঠছে না। তাই এবার রসুনের আবাদ কম করেছেন।

একই এলাকার জাহিদুল ইসলাম ও রবিউল করিম জানান, প্রতি বিঘা জমিতে রসুন বপন, সার, ওষুধ, কীটনাশক, সেচ, পরিচর্যা ও জমি থেকে তোলা পর্যন্ত ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় গড় ফলন কাঁচা অবস্থায় ২৫ থেকে ৩০ মণ। শুকানোর পর ২০ মণ টেকে। বিগত কয়েক বছর রসুন চাষ লাভজনক ছিল। তাই তারা গত ১০ বছর ধরে রসুন আবাদ করে আসছেন। কিন্তু গত দুই বছর ধরে রসুনের দাম একেবারেই কম। ফলে রসুন চাষ আর লাভজনক নেই।

রয়না গ্রামের সোলায়মান হোসেন জানান, ন্যায্য দাম না পাওয়ায় লোকসান হচ্ছে। দুর্যোগ না হলে বিঘায় ২০-২৫ মণ রসুন পাওয়া যায়। কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হলে সব খরচ বাদে চাষিদের লাভ থাকবে।

বাজিতপুর গ্রামের চাষি আব্দুল খালেক জানান, এ বছর তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে রসুন চাষ করেছেন। বিঘা প্রতি সার, বীজ ও কীটনাশক বাবদ ১৩-১৪ হাজার, বীজ বপন, নিড়ানি, রসুন তোলা, শুকানো, কাটা পর্যন্ত মোট ৪০ জন শ্রমিকের মজুরি বাবদ ২০ হাজার এবং সেচ বাবদ আরও ২-৩ হাজার টাকা খরচ পড়বে। এতে বিঘা প্রতি ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ পড়বে তার।

মামুদপুর গ্রামের মোবারক হোসেন বলেন, এবার মজুরিসহ সার, ডিজেলের দাম বেশি হওয়ায় বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে। গত মৌসুমে রসুন বেচে লোকসান হয়েছে, তারপরও একটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে রসুন চাষ করছি।

একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, উপজেলার  তারানগর, বাজিতপুর, মারিয়া, মানিকপুর, চকপাড়া গ্রামের শতাধিক কৃষক। তবে তারা রসুন বাজারজাতকরার সঠিক পরিবেশ এবং রসুন সংরক্ষণ করে সঠিক সময়ে বিক্রি করার পরিবেশ চান। এজন্য একটি সংরক্ষাণাগার বা হিমাগার নির্মাণ করা দরকার বলে মনে করেন তারা। কেননা একেকজন কৃষক রসুন উত্তোলনের পর বেশি দিন সংরক্ষণ করতে পারেন না। ফলে তড়িঘড়ি করে বিক্রি করে দেওয়ায়  তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। অথচ এসব রসুন সংরক্ষণ করে সঠিক সময়ে বিক্রি করতে পারলে একটু বেশি দাম পাওয়া যেত। তাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে আরও বেশি লাভবান হতেন।    

বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা, গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, গত মৌসুমে লোকসান সত্ত্বেও চাষিরা  আবার রসুন চাষে নেমেছেন। তারা যেন সঠিক দাম পান, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সুদৃষ্টি দিতে হবে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে বলেন, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে রসুন চাষ হয়েছে। তবে বিগত বছরের মতো এবারও রসুনের বাম্পার ফলন হবে।

তিনি আরও বলেন, কৃষকরা রসুনের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে তরমুজের চারা রোপণ করেছেন। রসুন উত্তোলনের পর একই জমিতে কৃষকরা তরমুজ পাবেন। এরপর সেখানে আমন ধানের আবাদ করতে পারবেন তারা। রসুন চাষের পুরো সময় কৃষি বিভাগের লোকজন মাঠে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। আশা করছি, এবারও রসুনের শ্বেত বিপ্লব ঘটবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৩
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।