ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

নাটোরে বিক্রি হচ্ছে কন্দ পেঁয়াজ, ফেলনা নয় ফুলকা আর পাতাও

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৩
নাটোরে বিক্রি হচ্ছে কন্দ পেঁয়াজ, ফেলনা নয় ফুলকা আর পাতাও

নাটোর: রান্নার কাজে পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে পেঁয়াজ কলির (ফুলকা- পেঁয়াজ ফুলের ডাটা) কদর এখন অনেক বেশি। কেননা একদিকে পেঁয়াজের দাম যেমন বেশি, অন্যদিকে কলির ঝাঁজ অনেকটাই পেঁয়াজের মতো, দামও কম।

এছাড়া ভাত-খিচুরি-পোলাওয়ের সঙ্গে সালাদেও অনেকে ব্যবহার করছেন পেঁয়াজের কলি।  

বলা যায়, পেঁয়াজের চাহিদা মিটছে কলিতে। ফলে পেঁয়াজের কলি এখন কৃষকদের কাছে অর্থকরী ফসল।  ফলে ক্রমাগত চাষাবাদের পরিধি বাড়ছে পেঁয়াজের।   
 
এদিকে নাটোরের গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারে গেল দুই সপ্তাহ ধরে কন্দ পেঁয়াজ, পেঁয়াজের কলি ও পাতা কেনা-বেচা বেশ জমে উঠেছে। তবে বাজার দর নিয়ে খুশি নন কৃষকরা। বাজারে প্রতি কেজি উঠতি কন্দ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়, কলি মাত্র দুই টাকা আর প্রতি কেজি পাতার দাম পাঁচ টাকা। তবে কলির চেয়ে পাতার কদরই বেশি। কেননা প্রাণ কোম্পানি সরাসরি কৃষকের জমি থেকে কন্দ পেঁয়াজের পাতা কিনে নিচ্ছে। এজন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে সমান তালে বিক্রি হচ্ছে কন্দ পেঁয়াজসহ পাতা ও কলি। এছাড়া পাতা বিক্রির আশায় কন্দ পেঁয়াজ পরিপক্ক না হতেই কৃষকরা তুলে বাজারে কম দামে বিক্রি করছেন।  

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষেতে কলি রাখলে কন্দ পেঁয়াজ খুব একটা বড় হয় না। এজন্য কৃষকরা পেঁয়াজের কলি একটু বড় হলেই ভেঙে বাজারে বিক্রি করেন। তবে ইদানিং পাতার কদর বেশি হওয়ায় কলির পাশাপাশি পাতা বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। সব মিলিয়ে পেঁয়াজ, পাতা ও কলি প্রায় একই সময়ে একসঙ্গে বিক্রি করছেন কৃষকরা। তবে পেঁয়াজের দাম আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো, কৃষকরা লাভবান হতেন।  
   
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় চার হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমিতে কন্দ পেঁয়াজ চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে অর্জিত হয়েছে ৯৬২ হেক্টর। গত মৌসুমে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল না। তবে চাষাবাদ হয়েছিল এক হাজার আট হেক্টর। মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১৫ হাজার ৭৬২ মেট্রিক টন।  

চলতি মৌসুমে জেলার সদর উপজেলায় ১২০ হেক্টর, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৪১০ হেক্টর, সিংড়া উপজেলায় ৫০ হেক্টর, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৭০ হেক্টর, বড়াইগ্রাম উপজেলায় ১১২ হেক্টর, লালপুর উপজেলায় ৮০ হেক্টর ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ১২০ হেক্টর জমিতে কন্দ পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। এবার জেলায় চার হাজার ৭২৫ মেট্রিক টন কন্দ পেঁয়াজ উৎপাদন হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করা সম্ভব হবে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার কন্দ পেঁয়াজ চাষ কম হয়েছে, ফলে উৎপাদনও কম হবে।  

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবার নলডাঙ্গা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি কন্দ পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে।  

নাটোরের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোথাও কলি, কোথাও পেঁয়াজের কন্দ আবার কোথাও পেঁয়াজের পাতা তুলছেন কৃষকরা। যারা পেঁয়াজ তুলছেন, তারা আগেই কলি বিক্রি করেছেন। আর এখন যারা জমি থেকে কলি তুলে বিক্রি করছেন, তারা আরও কিছুদিন পর পেঁয়াজ তুলবেন। তবে প্রাণ কোম্পানিতে পাতা বিক্রির আশায় অনেকেই পেঁয়াজ পরিপক্ক হওয়ার আগেই তুলে ফেলছেন।  

নলডাঙ্গা উপজেলার কাশিয়াবাড়ী এলাকার কৃষক রাসেল, মুছা, শহিদুল বাংলানিউজকে জানান, পেঁয়াজ উৎপাদনে যে পরিমাণ খরচ হয়, তাতে বাজারদর আরও বেশি হওয়া দরকার। কিন্তু গত দুই বছর ধরে তারা পেঁয়াজের সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না। আর এসময়ে পেঁয়াজ ছাড়া অন্য কোনো ফসলও ভালো হয় না। তাই তারা পেঁয়াজের আবাদ করে থাকেন।  

তবে শীতকালীন পেঁয়াজের আগে তারা ওই জমিতে কন্দ পেঁয়াজ চাষ করেন। তারা আরও জানান, আগে পেঁয়াজের কলি ও পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। এবার পেঁয়াজ-কলি ও পাতা একসঙ্গে বিক্রি করছেন। জমিতে এসে প্রাণ কোম্পানির লোকজন পাতা আর বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন কলি। এ অবস্থায় জমি থেকে পাতা পাঁচ টাকা কেজি ও কলি বিক্রি হচ্ছে দুই টাকা কেজি দরে।  

একই কথা জানালেন সরকুতিয়া, ইয়ারপুর, শেখপাড়া, সোনাপাতিল, ঠাকুরলক্ষিকুলসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও পাওয়া যায় একই চিত্র।  

নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর গ্রামের পেঁয়াজের কলি ব্যবসায়ী আব্বাস আলী ও সোনাপাতিল গ্রামের রুবেল জানান, প্রতিদিন তারা জমি থেকে কলি সংগ্রহ করেন এবং নলডাঙ্গা বাজারে এক জায়গায় করার পর তা বস্তাভর্তি করেন। পরে ট্রাক ভর্তি করে খুলনা, দৌলতপুর, নওপাড়া, কালীগঞ্জ ও ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন। এতে কেজিতে পরিবহন খরচ পড়ে চার টাকা আর প্রতি কেজি কলি কেনেন দুই টাকা কেজি দরে। পরে তারা ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করেন। এতে খরচ বাদে তাদের ভালোই লাভ হয়।  

শুরুতে কৃষকদের কাছ থেকে এসব কলি ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে কিনেছেন উল্লেখ করে তারা আরও জানান, প্রতিদিন নলডাঙ্গা থেকেই গড়ে ২০ মেট্রিক টন কলি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। গত এক মাসে এখান থেকে ৬০০ মেট্রিক টন কলি বাজারজাত হয়েছে। অন্তত আরও ১৫ দিন এ কলির ব্যবসা চলবে, তাতে আরও ৩০০ মেট্রিক টন কলি যাবে দেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে।  

প্রাণ অ্যাগ্রো কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজার (অপারেশন) মো. রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন ১৮ জন সরবরাহকারীর মাধ্যমে আট মেট্রিক টন করে পেঁয়াজের পাতা কিনছেন তারা। এ পর্যন্ত ৪০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজের পাতা কিনেছেন। যতদিন পর্যন্ত এ পাতা পাওয়া যাবে, ততদিন পর্যন্ত কেনা হবে। প্রথম দিকে ১৪ টাকা দরে প্রতি কেজি পাতা কিনেছেন। এখন পর্যাপ্ত পরিমাণ পাতা থাকায় দাম কমেছে। তারা এখন প্রতি কেজি পাতা নয় টাকা দরে সরবরাহকারীর কাছ থেকে কিনছেন। আর তারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পাঁচ টাকা কেজি দরে কিনছেন।  

তিনি বলেন, আগে এসব পাতা চীন থেকে আমদানি করা হতো। এখন দেশের কৃষকদের কাছ থেকে পাতা কেনা হচ্ছে। আগে আমাদের দেশে পেঁয়াজের পাতা পুরোটাই ফেলে দেওয়া হতো, কেননা এসব পাতা কোনো কাজে লাগানো হতো না। যেখানে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা কেজি দরে, সেখানে পাতার দাম নয় টাকা কেজি। চীন থেকে আমদানির পাশাপাশি দেশ থেকেই সারা বছর পাতা সংগ্রহ করব আমরা। এতে দেশীয় কৃষকরা লাভবান হবেন।  

তিনি পাতার ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন, প্রাণ কোম্পানির উৎপাদিত নুডুলস, বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্যে সবজি হিসেবে পেঁয়াজের পাতা ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি বাঁধাকপি ব্যবহার করা হয়। এজন্য প্রতিদিন ২০ মেট্রিক টন করে বাঁধাকপি কেনা হচ্ছে। শিগগিরই গাঁজর কেনা শুরু হবে।  

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, চলতি মৌসুমে তার উপজেলায় ৬১০ হেক্টর জমিতে কন্দ পেঁয়াজ চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে চাষ হয়েছে ৪১০ হেক্টর জমিতে। সাধারণত কার্তিক মাসে কন্দ পেঁয়াজের বীজ রোপণ করা হয় এবং উত্তোলন করা হয় পৌষ মাসের শেষ থেকে মধ্য মাঘ পর্যন্ত। সময়কাল ৮০ থেকে ৯০ দিন এবং প্রতি বিঘায় গড় ফলন ৭০ থেকে ৮০ মণ।
  
এ ফসল চাষে খরচ কম এবং শীতকালীন পেঁয়াজের চারা রোপণের আগেই এ পেঁয়াজ ঘরে তোলা যায়। এতে চাহিদা মেটানোসহ এসময়ে পেঁয়াজের বাজার দর স্থিতিশীল থাকে। আর কৃষকরাও পেঁয়াজের ভালো দাম পান, বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, কন্দ পেঁয়াজ চাষাবাদের আরও একটি ভালো দিক হচ্ছে, পেঁয়াজ ও কলি বিক্রি করা যায়। আগে পাতা ফেলে দেওয়া হতো, এখন তা ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা।  

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান, এবার আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকায় চাষাবাদ ভালো হয়েছে। ফলনও ভালো হচ্ছে। তবে গেল দুই বছর ধরে কন্দ পেঁয়াজের ভালো দাম না পাওয়ায় এবার কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে ওই জমিতে কৃষকরা সরিষাসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করেছেন। এবার কাঁচা পেঁয়াজ জমি থেকে তোলার পর কৃষকরা হাটে-বাজারে মণ প্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এবার কলির পাশাপাশি পেঁয়াজের পাতাও বিক্রি হচ্ছে। বিগত দিনে এমনটি ছিল না। এখন একসঙ্গে পেঁয়াজ, পাতা ও কলি বিক্রি হচ্ছে। তবে পেঁয়াজ তোলা উচিত আরও একটু পরিপক্ক হলে। তাহলে ফলন আরও বেশি ভালো হতো।  

তিনি পাতা বিক্রি প্রসঙ্গে বলেন, আগে পাতা বিক্রির প্রচলন ছিল না। কৃষকরা পেঁয়াজের পাতা জমিতে অথবা বাড়ির আশেপাশের নর্দমায় ফেলে দিতেন। এখন সেই পাতাও বিক্রি হচ্ছে জেনে ভালো লাগছে। কারণ কৃষকরা পাতা বিক্রি করে বাড়তি উপার্জন করতে পারবেন। পেঁয়াজের বাজার দর কোনো কারণে কম হলে কৃষকরা পাতা বিক্রি করে তা পুষিয়ে নেবেন। এতে আগামীতে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ বাড়বে। প্রাণ কোম্পানি যেভাবে পেঁয়াজের পাতা কিনছে, তাতে পেঁয়াজ ফসলে আশার আলো দেখা যাচ্ছে।  

তিনি বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজারজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কৃষিবিভাগ কাজ করছে। ভবিষ্যতেও করবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।