বরিশাল: বরিশাল বিভাগে সয়াবিন চাষের আগ্রহ বাড়ছে। সেই সঙ্গে আবহাওয়া ও মাটির গুণগত মানের কারণে সয়াবিনের উৎপাদনও বেশ ভালো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সয়াবিনই ভোজ্যতেল উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব। কৃষকদের আগ্রহ থাকায় উৎপাদনও বাড়ানো যেতে পারে। তবে সয়াবিনকে ভোজ্যতেলে রূপান্তর করতে যে ধরনের যন্ত্রপাতি ও কারখানা প্রয়োজন, তা এখনো দেশের কোথাও চালু হয়নি। কারখানা চালু হলে সয়াবিনের চাহিদা বাড়বে এবং কৃষক আরও লাভবান হবেন।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, বিভাগে ২০২৪ সালের বারি মৌসুমে ২৭ হাজার ৪৪ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা রয়েছে। এক মাস বাকি থাকতেই ২৬ হাজার ৭৭৮ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ শেষ হয়েছে।
গত বছরে একই মৌসুমে ২৭ হাজার ১১২ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে ২৭ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। ২০ হাজার ৪৫১ হেক্টরেই উৎপাদন হয়েছিলে ৩২ হাজার ১৯৭ টন ফসল।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. শওকত ওসমান বাংলানিউজকে বলেন, নিঃসন্দেহে সয়াবিনের আবাদ ও উৎপাদন এ অঞ্চলে বেড়ে যাওয়াটা সুখবর। তবে এখানকার উৎপাদিত সয়াবিন ভোজ্যতেলের জন্য নয়, যাচ্ছে ডেইরি, ফিশারিজ ও পোলট্রি ফিড তৈরির কারখানায়। বলতে গেলে এ কারণেই বরিশাল অঞ্চলে সয়াবিনের আবাদ বেড়েছে। বিভাগের মধ্যে বরিশাল ও ভোলা জেলার কয়েকটি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সয়াবিন আবাদ হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাজারমূল্য পাওয়ায় সয়াবিনে কৃষকদের আগ্রহ বেশ। নদী তীরবর্তী এ অঞ্চলের মাটি বেলে দো-আঁশ হওয়ায় সয়াবিন চাষের জন্য বেশ উপযোগীও। আবার আমাদের এখানে আমন কাটতে কিছুটা দেরি হওয়ায় সরিষা চাষে তেমন একটা সময় হাতে থাকে না, থাকলেও ১৫ দিনের মতো। সেক্ষেত্রে সয়াবিন চাষের জন্য সময় হাতে থাকে দুই মাস।
এ কৃষিবিদ বলেন, সয়াবিন দিয়ে ভোজ্যতেলের পাশাপাশি সয়া ডাল, সয়া দুধ, বিস্কুট, লাড্ডুসহ ডেইরি, ফিশারিজ ও পোলট্রি ফিড তৈরি করা হয়। তবে স্থানীয় ঘানিতে ভেঙে তেল বের করার পদ্ধতি এখনও হয়নি দেশে। উত্তরবঙ্গে একটি বেসরকারি প্রজেক্ট চলমান। তবে সেটি চালু হলে হয়তো সয়াবিন থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, আবাদ বাড়লেও সয়াবিনে লোকসান হওয়ার শঙ্কা নেই কৃষকদের। এর চাহিদা অন্যান্য বারি ফসলের চেয়ে অনেক বেশিই থাকবে। কারণ এ একটি ফসল দিয়ে নানান পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। সয়াবিন চাষের কারণে জমিতে উর্বরতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এর শুকনো গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
বরিশালের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুল হাসান খান বলেন, বরিশাল অঞ্চলে চাষ হওয়া বারি সয়াবিন-৫ এবং এর সঙ্গে বারি সয়াবিন- ৬ আধুনিক জাত। স্থানীয় জাতের চেয়ে আমাদের এসব জাতের সয়াবিন থেকে ৪০ শতাংশ (কেজিতে ৪০০ গ্রাম) ভোজ্যতেল বের করা সম্ভব।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা সয়াবিন পোলট্রি ফিডের জন্য চাষ করা হয় বলেই জানেন। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়, কারণ সয়াবিনের ভ্যালু অন্য ফসলের মতো নয়। এ সয়াবিন দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কেক, দুধ, সস, বিস্কুট, জুস, ভোজ্যতেল, ফিশারিজ ও পোলট্রি ফিড উৎপাদন করা যায়। তাই উৎপাদন বাড়লেও এর দামে প্রভাব পড়ার শঙ্কা নেই, তাই এটি লাভজনক ফসলই বলা যায়। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলের চাষিদের সয়াবিন চাষে আগ্রহী করা যেতে পারে। আর চাষ জনপ্রিয় করা গেলে ভোজ্যতেল উৎপাদনের দিকে ধাবিত হওয়া যাবে।
মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সয়াবিন থেকে ভোজ্যতেল বের করে তার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষঙ্গ মিশ্রণের যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার জন্য উপযুক্ত ঘানি বা কারখানা দেশে এখনো তৈরি হয়নি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর আগে এমন উদ্যোগ নিলেও পর্যাপ্ত কাঁচামাল না থাকায় সেখান থেকে তারা পিছু হটে। তখন তাদের দাবি ছিল, সারা দেশে উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে তেল উৎপাদন কারখানা পরিচালনা সম্ভব নয়। তবে কৃষকরা আগ্রহী হলে সয়াবিনের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালে উৎপাদিত সয়াবিন লক্ষ্মীপুরের একটি ফিড কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কৃষকদের হাটে নেওয়াসহ বাজারজাতকরণে কোনো ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় না।
বরিশাল সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জানান, চাষবিষয়ক যেকোনো পরামর্শ কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। ডিসেম্বর থেকে মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত বিশেষ করে শীতল আবহাওয়া সয়াবিন আবাদের জন্য ভালো সময়। আর তেমন কোনো রোগবালাই নেই এবং আবহাওয়াও অনুকূলে। ডিসেম্বরে যারা আবাদ করেছেন, ৯০ দিন পর অর্থাৎ মার্চের শুরুতে তারা ফসল ঘরে তুলবেন।
সয়াবিন চাষে কোনো লোকসান হয় না জানিয়ে বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদের কৃষক সোহেল প্যাদা বলেন, ২-৩ বছর ধরেই সয়াবিনের চাষ করছি, দিন দিন আবাদের পরিমাণের সঙ্গে উৎপাদনও বাড়ছে। আর এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ১৫ মণ সয়াবিন হলে বাড়িতে বসেই কোম্পানির কাছে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। অনেক সময় তা ৩৮-৩৯ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। আর সয়াবিনে রোগবালাই তেমন নেই। নিয়মের বাইরে বেশি পরিচর্যারও প্রয়োজন হয় না, তাই উৎপাদন খরচও কম।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪
এমএস/আরএইচ