ঢাকা: চাষ থেকে শুরু করে ফসল বাজারজাতকরণ পর্যন্ত যা যা প্রয়োজন, সব উপকরণই দিচ্ছে এসিআই এগ্রোবিজনেস লিমিটেড। শুধু ফসল নয়- মাছ ও গবাদিপশুর ক্ষেত্রেও একই সেবা রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের।
এখানেই শেষ নয়, কৃষকের জন্য সমৃদ্ধ কৃষি নিয়েও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কৃষি পণ্য ব্যবসায় একের পর এক সফলতার গল্পও তৈরি হয়েছে তাদের। আর তাই তো কৃষি, কৃষক ও কৃষি অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠানটির অবদান দিনদিন বেড়েই চলছে।
সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে এসিআই লিমিটেড (এগ্রোবিজনেস) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফা. হ আনসারী এ তথ্য তুলে ধরেন। কৃষি ব্যবসায় এ প্রতিষ্ঠানটির সফলতার গল্পের মূল কারিগরও তিনি।
ড. আনসারী বলেন, এনিমেল হেলথ ও পোল্ট্রিতে সফলতার পর ২০০৮-০৯ সালের দিকে কৃষির বীজ, সার, মেশিনারিজসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। পেস্টিসাইড ব্যবসায় অনেক বড় সাফল্য পাওয়ায় কৃষির ব্যবসায় আমরা বড় সম্ভাবনা দেখতে পেলাম। পরে তা বাস্তবে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ‘উই আর ইমপ্রুভ ইন কোয়ালিটি লাইফ পিপল অব বাংলাদেশ’, এটাই হচ্ছে এসিআই’র মিশন। এখন দেশের মানুষের যদি কোয়ালিটি উন্নত করতে চাই তাহলে তো শুধু শহরের মানুষের জন্য করলে হবে না। গোটা দেশের মানুষের জন্য করতে হবে। আর গোটা দেশের মানুষের অর্ধেকেই তো কৃষক। এছাড়া কৃষির সঙ্গে আরও প্রায় ২০ ভাগ মানুষ জড়িত।
তাহলে কৃষির জন্য কিছু করতে হবে। এখন এটার জন্য দরকার জ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা, সম্পদ ও উৎসাহ। তো যেহেতু কৃষিতে আমাদের জ্ঞান আছে, ক্রপের ওপর দখলের পাশাপাশি একদল দক্ষ নেতৃত্বও তৈরি হলো।
‘এরপর আমরা কৃষির জন্য একটা মিশন তৈরি করলাম। মিশনটা হলো ‘ওয়েল ক্রিয়েশন ফর দ্য ফারমার’। কারণটা হলো- আমরা যদি শুধু পণ্য বিক্রি করি, তাহলে কৃষক পণ্য নিলো আর আমরা বিক্রি করলাম। এখান থেকে তারা একটু বেনিফিট পেলো। তারাও উপকৃত হলো আমরাও মুনাফা পেলাম। ’
মিশনের পুরো ব্যাখ্যায় এ কর্মকর্তা বলেন, আমি যদি বলি ‘ওয়েল ক্রিয়েশন ফর দ্য ফারমার’ তাহলে সুবিধা হয় কি, এসিআই’র মিশনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাবে। কেননা ওয়েলথ থাকলেই তো কোয়ালিটি উন্নত করতে পারবেন। এসময় তিনি সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে তুলে ধরেন।
কৃষির সঙ্গে প্রায় ৩৫ বছরের পথ চলা এ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ৫০ ভাগের বেশি কৃষির সঙ্গে জড়িত। এই ৫০ ভাগ মানুষের ফুড সিকিউরিটির কথা যদি বলি, তাহলে কিন্তু শুধু পেট ভরে খেয়ে থাকার মধ্য সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।
বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত, মোটামুটি ভালো মাপের ঘর বাড়িতে বাস করার সুযোগ থাকতে হবে। আর ওয়েলথ থাকলেই কিন্তু এসব সম্ভব।
‘তখন আমরা ভাবলাম তাহলে কৃষকের জন্য কী করছি! এসময়ই চিন্তা এলো ‘ওয়েলথ ক্রিয়েশন ফর দ্য ফারমার’ এর। চিন্তাটি বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য কাজ শুরু করি। প্রথমে কৃষকের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে মাঠে নেমে পড়ি আমরা।
‘কৃষকের মূল সমস্যা হলো- ভালো বীজ, সারসহ উন্নত কৃষি উপকরণ ঠিকমতো না পাওয়া। ফসল হার্ভেস্ট করতে গিয়েও সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতা তো আছেই। সবশেষে কাঙ্খিত ফসল ঘরে তুলে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এ কারণে আমরা বললাম, এ সব সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান দেবো। যা বাস্তাবে এখন কৃষকরা পাচ্ছেন।
কৃষককে কীভাবে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলবেন এর ব্যাখ্যা দিয়েই চললেন ড. আনসারী।
বললেন, একজন কৃষকের বাড়িতে কবুতর, গরু পালনের সুযোগ রয়েছে। ছোট একটা পুকুর আছে। তো একজন কৃষকের যেমন ফসলের দরকার আছে ঠিক তেমনি তার এনিমেলেরও যত্নের দরকার আছে। তাই এখানেও আমরা এসবের সমাধান নিয়ে এলাম।
কৃষকের এই সম্পূর্ণ সমাধান অনেক আগ থেকেই ছিল উল্লেখ করে ড. আনসারী বলেন, আমরা ড্রিমটা নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। এরপর ২০০৮-০৯ সাল থেকে ড্রিম থেকে গল্প শুরু হলো। তারপর ভাবলাম, শুধু গল্প বললেই হবে না নাম্বার ওয়ান পজিশনে গেলেই কৃষক আস্থা রাখবে। ব্র্যান্ডকে যদি প্রমোট করতে পারি তাহলে কিন্তু কৃষক পণ্য কিনবে।
সত্যিই তাই হলো। এখন কিন্তু এই ওয়েলথ কৃষির কথা সবাই বলেন।
পারিবারিক থেকে কৃষিকে বাণিজ্যিকে নিয়ে যেতেও কাজ করছে এসিআই- এমনটাই জানালেন তিনি। বললেন, আমাদের কৃষিটা কিন্তু সামাজিক, পারিবারিক কৃষি। পারিবারিক কৃষি কেন বললাম, পরিবারের সবাই মিলে কিন্তু কৃষির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন আমরা এই পারিবারিক কৃষিকে ছোট হোক আর বড় হোক বাণিজ্যিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আলু চাষিরা কোল্ডস্টোরে জায়গা পান না। আবার বাড়িতে ফসল সংরক্ষণ করতে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কম দামে বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা ছোট ছোট লাল আকারের আলুকে আপগ্রেড করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। সফলতাও পেলাম। এই আলু দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত বাড়িতে রাখতে পারছে কৃষক।
আলাপকালে কৃষি সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের আরও সুদৃষ্টি দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বললেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৯০ ভাগ সবজির বীজ, ভুট্টা বীজ ৯০ ভাগ, আলুর বীজ ৬০ ভাগ, ধান বীজের ৩০ ভাগ (উচ্চ ফলনশীলে প্রায় শতভাগ) সরবরাহ করছে। কিন্তু এই প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে। তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি জানান, প্রাইভেট সেক্টর যদি কৃষির উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে তাহলে সরকারের উচিত হবে এই সেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। তাহলে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক কৃষিতে দ্রুত চলে যেতে পারবে।
খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, চালে উদ্বৃত্তে এ ধরনের তথ্যের ওপর ভরসা রেখে না চলার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিবন্ধকতা মনে করি না। বরং সুযোগ মনে করি।
এতো সফলতার পেছনে অনুপ্রেরণা কি এ কথার উত্তরে বলেন, একই বিষয় নিয়ে ৩৫ বছর ধরে কাজ করছি। যেখানে শুধু ‘গ্রোথ’ ‘গ্রোথ’। নিয়মিত সফলতা হাতে ধরা দিচ্ছে। যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করতে হয়েছে। যখন ওয়েলথ কৃষির কথা ভাবলাম। তখন তো আমাকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে।
বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে নতুন নতুন প্রযুক্তি আর জামপ্লাজম নিয়ে দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নিয়ে কাজ করতেও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
বললেন, আমি প্রায় সময় দেশের বাইরে থাকি। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই। বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি নিয়ে এসে দেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। বড় বড় বিজ্ঞানী, গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কাজ আরম্ভ করে দেই। আমার নিজের মধ্যেও বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে কৌতুহল জাগে। সেগুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। মাঠে সফলতাও পাই।
কৃষি প্রযুক্তি বিষয়ে গল্প ওঠতেই জানালেন, কৃষি প্রযুক্তিতে আমরা অনেক এগিয়েছি। খরার সময়ে আমরা মুলা, টমেটোসহ নানা সবজি পাচ্ছি। তবে আমরা বক্তব্যে যতটা এগিয়েছি, তবে ততটা কিন্তু বাস্তবে না।
কৃষকের জীবনমান নিয়ে বলেন, আগের তুলনায় কৃষক এখন বেশ ভালো অবস্থানে আছে। তবে কৃষকরা এখনো সেই জায়গায় পৌঁছায়নি। কেননা তাদের এখনো পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে পারিনি। এটা সরকারকে করতে হবে।
দেশের জিডিপিতে এসিআই’র অংশগ্রহণ অনেক বেশি করার আশাবাদও ব্যক্ত করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৬
একে/জেডএম