মূলত পেঁয়াজ হার্ভেস্টিং সময় (পেঁয়াজ উত্তোলনকালীন) কৃষকেরা দাম পান না। তাই পেঁয়াজ উত্তোলনকালীন চার মাস বিশেষ করে এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে সব ধরনের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের ব্যাপারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। চার মাস পেঁয়াজ বন্ধের বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেছেন। আগামী বছরেই এ বিষয়ে আইন পাস হবে। এবং নতুন বছরের এপ্রিল থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে বলে নিশ্চিত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কৃষক বাঁচাতেই পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এটা একটা বড় সিদ্ধান্ত।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) সনৎ কুমার সাহা বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর পেঁয়াজ অনেক অস্থিরতা তৈরি করেছে। পেঁয়াজ নিয়ে নতুন করে সংকট চায় না। আমরা পেঁয়াজের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করবো। বর্তমানে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। আমরা বিশ্বাস কৃষক দাম পেলে ৩০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব। তাই হার্ভেস্টিং সময়ে আর পেঁয়াজ আমদানি নয়। বাণিজ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বলেছি তিনিও নীতিগত সমর্থন দিয়েছেন।
সনৎ কুমার সাহা আরও বলেন, আমরা আশা করছি নতুন বছর থেকে চার মাস পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকবে। এতে কৃষকও বাঁচবে দেশের মানুষও বাঁচবে। পেঁয়াজের দাম কৃষক কিছুটা বেশি পাবে তবে আমাদের কখনও ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ খেতে হবে না। আমরা পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো। কোনো দেশের প্রতি চেয়ে থাকবো না।
পেঁয়াজ আমদানির ৯৫ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট আমদানির ৯৫ শতাংশ পেঁয়াজ ভারত থেকে এসেছে। এরপরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০০ শতাংশ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ পেঁয়াজ ভারত থেকে এসেছে। এর পাশাপাশি চীন, মিশর, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে সামান্য পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
চলতি বছরের গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজের দাম ৮৫০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরে দেশের বাজারে ৩০০ টাকায় পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম বাড়ে।
সারা পৃথিবীর ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ পেঁয়াজ চীনে উৎপাদিত হয়। এর পরিমাণ ২৩৯ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন। এর পরেই ভারতে ১৯৪ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। যা বিশ্বে মোট উৎপাদনের ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে মিশর, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। উৎপাদন বাড়লেও দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ায় মূলত বেশি পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। অধিকাংশ পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ।
বিশ্বে পেঁয়াজ রপ্তানিতে শীর্ষে ভারত। এরপরেই রয়েছে মিয়ানমার, আফগানিস্তান, মিশর, তুরস্ক, চীন, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান। বাংলাদেশে ১৩ লাখ পরিবার পেঁয়াজ চাষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের প্রায় সব জেলাতেই পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ হয়। দাম পাওয়ার পাশপাশি কৃষকদের মানসম্পত বীজ ও সহজ শর্তে ঋণ দিলে আমদানি নির্ভরতা কমবে। চলতি বছরে দাম পাওয়ার কারণে কৃষকেরা এক জমিতে দুইবার পেঁয়াজ চাষে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। অনেক জেলাতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের জমিতে নতুন করে পেঁয়াজ চাষ করছেন। এ উৎসাহ অব্যাহত থাকলে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কৃষি গবেষকেরা। শুধু শীতকাল নয়, পেঁয়াজের দাম পেলে কৃষকেরা গ্রীষ্মেও চাষ করবেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র (বিএআরআই-বারি) গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, আমরা নতুন নতুন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করছি। কৃষকেরা দাম পেলে শুধু শীতকাল নয়, গ্রীষ্মেও চাষ করবেন। দাম পাওয়ার কারণে অনেক জেলায় কৃষকেরা মুড়িকাটা পেঁয়াজ ঘরে তোলার পরে নতুন করে পেঁয়াজ চাষ করছেন। অর্থাৎ এক বছরে দুইবার পেঁয়াজ চাষ করছেন। কৃষকের এমন আগ্রহ অব্যাহত রাখার জন্য নতুন বছরে চারমাস পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকবে। পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জন করার আগা পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯
এমআইএস/ওএইচ/