ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় ভর্তুকি বন্ধ, বিপাকে কৃষক

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২১ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০২০
কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় ভর্তুকি বন্ধ, বিপাকে কৃষক কৃষি যন্ত্রপাতি

ঢাকা: ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরের শামসুল আলম। তার ৮ বিঘা আবাদি জমি আছে। নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমি চাষ করার জন্য একটা ট্রাক্টর কেনার ইচ্ছা পোষণ করেছেন ভর্তুকির আশায়। বর্তমানে একটা ট্রাক্টরের দাম ৯ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

কিন্তু শামসুল  কৃষি অফিসে গিয়ে দেখে ভর্তুকি বন্ধ রয়েছে। কয়েকমাস ধরে যোগাযোগ করে আসছিলেন তিনি।

শেষ পর্যন্ত আশায় ছিলেন ভর্তুকিতে ট্রাক্টর কিনতে পারবেন। কিন্তু কৃষি অফিস শেষ মুহূর্তে এসেও জানায়, বন্ধ থাকায় তাকে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে ট্রাক্টর কিনতে পারছেন না তিনি।

এমন অবস্থায় পড়েছেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কৃষক আব্দুর রহমানও। ভর্তুকির আশায় অবশেষে তার ট্রাক্টরই কেনা হয়নি। মেহেরপুর গাংনীর কৃষক মহিবুল ইসলাম। তার মোট ১৬ বিঘা আবাদি জমি রয়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কিনবেন।

বর্তমানে এর বাজার মূল্য প্রায় ২৮ লাখ টাকা। এত দাম দিয়ে তার পক্ষে এই হার্ভেস্টার কেনা সম্ভব নয়। তাই সরকারি ভর্তুকির আশায় ছিলেন তিনি। কিন্তু তা আর পাননি কৃষক মহিবুল ইসলাম।  

 

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, নিজেরসহ অন্যের ধান কর্তন, মাড়াই ও বোঝাইয়ের জন্য একটা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কেনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু কৃষি অফিসে দেখি ভর্তুকি বন্ধ। ভর্তুকি ছাড়া কৃষকের পক্ষে এতো দাম দিয়ে কৃষি যন্ত্রপানি কেনা সম্ভব না।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন মেয়াদে ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি- দ্বিতীয় পর্যায়’ প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৩৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বেড়েছে বলে মত দিয়েছেন দুই হাজার কৃষকের ৯৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। সেই সঙ্গে কমেছে উৎপাদন খরচও।

কৃষকেরা বলেছেন, যন্ত্রপাতি ব্যবহারে শস্য সংগ্রহত্তোর অপচয় সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ কমেছে। প্রকল্পের আওতায় কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে।

তবে ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।  ফলশ্রুতিতে বন্ধ হয়ে যায় কৃষকের ভর্তুকিও।

সূত্র বলছে, প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৮ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে কৃষককে সহায়তা দিয়েছে সরকার। এখনও আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে ভর্তুকির জন্য স্থানীয় কৃষি অফিসে যান কৃষকেরা। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা আর পাচ্ছেন না তারা।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন) এ কে এম মনিরুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, একটা চলমান প্রকল্পের আওতায় কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছিল। কৃষি যন্ত্রপাতির দামও অনেক বেশি। আসলে ভর্তুকি ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব নয়। প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। প্রকল্প শেষ হয়েছে তাই ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা বড় আকারে একটা প্রকল্প হাতে নেবো। তখন আবারও ভর্তুকি শুরু হবে কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার কাজে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ফসল উৎপাদনের প্রস্তুতিপর্ব, কর্তনপূর্ব পরিচর্যা, কর্তনকালীন ও কর্তনোত্তর সময়ে ফসলের বেশি ক্ষতি হয়। কৃষি কাজের এসব স্তরে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নিশ্চয়তার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।  উৎপাদন ও শ্রম খরচ কমবে কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে।

এছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি জনপ্রিয় করার জন্য তিনহাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটা প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার।   ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, থ্রেসার, রিপার, কমবাইন্ড হার্ভেস্টার কেনা হবে প্রকল্পের আওতায়। বাংলাদেশেরর তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশজুড়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

প্রকল্পের আওতায় হাওর ও লবণাক্ত জেলায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হবে। অন্যান্য জেলায় দেওয়া হবে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি। কৃষক যেসব যন্ত্র পছন্দ করবেন সেগুলোই দেওয়া হবে। জোর করে কৃষি যন্ত্রপাতি চাপিয়ে দেওয়া হবে না। কৃষক গ্রুপের সদস্যরাই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন।

যাতে কেউ এই সুবিধা নিয়ে অন্যজনের কাছে কৃষিযন্ত্র বিক্রি করে না দিতে পারেন সেজন্য কৃষি কার্ড রয়েছে এমন কৃষকেরাই কেবল ভর্তুকি পাবেন।

জানা যায়, দেশে ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার। প্রায় সাত লাখ রয়েছে পাওয়ার টিলার। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে চাষের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যবহৃত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের চাহিদা রয়েছে এক লাখের বেশি।

কিন্তু দেশে ব্যবহার হচ্ছে ১ হাজারেরও কম। আর ধান বীজ বোনার জন্য রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের প্রয়োজন দুই লাখ। অথচ এ যন্ত্রটিরও ব্যবহার হচ্ছে এক হাজারেরও কম। এছাড়া ধান কাটার যন্ত্র রিপারের চাহিদা এক লাখ হলেও দেশে এ যন্ত্র রয়েছে পাঁচ হাজার। ধান বোনার জন্য পিটিও সিডার আছে মাত্র আড়াই হাজার। দেশে এ যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে এক লাখ।

কৃষকরা বলছেন, একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের দাম ২৫-৩০ লাখ টাকার মধ্যে। বপন ও কর্তন যন্ত্রের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকদের জন্য সেগুলো কেনা বেশ কষ্টসাধ্য। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ায় কৃষকদের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেটিও গত নয় মাস ধরে বন্ধ।

অন্যদিকে কৃষি যন্ত্রের বিক্রিতেও এখন বড় ধরনের ভাটা পড়েছে বলে জানালেন বিপণনকারীরা। তারা বলছেন, কিছু মাঝারি ও হালকা কৃষিযন্ত্রের বিক্রি হলেও বড় কৃষিযন্ত্র বিক্রি প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে। চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন খরচ কমানো ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তাছাড়া সময় বাঁচাতেও কার্যকর ট্রাক্টর ও কম্বাইন্ড হারভেস্টর। কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ধান কাটা, মাড়াই, পরিষ্কার ও প্যাকেটজাত করা যায়। এর সঠিক ব্যবহারে একরপ্রতি কৃষি উৎপাদন খরচ ৫ হাজার টাকা থেকে মাত্র দেড় হাজার টাকায় নামিয়ে আনাও সম্ভব। অথচ সাত মাস ধরেই বন্ধ রয়েছে ভর্তুকি।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) এখনও পরিকল্পনা কমিশনে পৌঁছায়নি। কবে নাগাদ পৌঁছাবে তাও নিশ্চিত নয়। এছাড়া প্রকল্পের পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেকে) সভায় অনুমোদন পেতে আরো সময় লাগবে।

ফলে সহসাই ভর্তুকি কৃষি যন্ত্রপাতি মিলছে না বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০২০
এমআইএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।