চোখের কাছাকাছি থাকা চারপাশের ঘামবিন্দু বার বার মুছতে হয় রাতুলকে। গরমকালেই বেশি আতঙ্ক।
ডাক্তার বলেন, অল্পের জন্য রক্ষা! পর্যাপ্ত পানি ঢালার কারণে চোখ একেবারেই নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচেছেন। পেটের দায় মেটাতে তাও থাকতে হবে অভিশাপের এই নগরীতে! জীবনটা যে নিম্ন বিত্তের! এই অমহান মহানগর ছাড়া উপায়তো নেই!
রাত ১১টা। অফিস থেকে নেমে পল্টন মোড়ে দাঁড়িয়েছে রাতুল। বেতনের হাজার দশেক টাকা পকেটে রয়েছে। জুরাইনে নেমে মায়ের জন্য অষুধ কিনে বাসায় ফিরতে হবে। কাল আবার সকাল ৯টায় অফিস। ৪৫ মিনিট পেরিয়ে গেলো। কোনো বাস নেই। রাজনীতির জ্বালাও-পোড়াও, আন্দোলন-মহান্দোলনে তটস্থ সাধারণ মানুষ। আগুন-ককটেলে বিদ্ধস্ত রাস্তায় ইদানিং দিনেই গাড়ি বেরোয় না।
অনেকক্ষণ পর পর যাত্রাবাড়ী রুটের দুয়েকটা আট নম্বর বাস আসতে দেখা যায় প্রেস ক্লাবের দিক থেকে। তাতে উঠে দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা নেই। এতো ভিড়ে গাড়ির গেটে পা-দানিতে দাঁড়ানোরও সুযোগ নেই। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির গেটে বাদুড়ের মতো ঝুলছে যাত্রী। বিভিন্ন গন্তব্যের অনেক লোকের ভিড় পল্টন মোড়ে। অপেক্ষা আর হাপিত্যেস। গাড়ি নেই!
ভিড় ভেঙে মোড়ে এসে হঠাৎ একটা সাদা প্রাইভেট কার থমকে দাঁড়ালো। গাড়িতে কেউ নেই। চিৎকার করতে করতে ড্রাইভার নেমে পড়লো।
ওই যাত্রাবাড়ী ৫০ টাকা!
ওই যাত্রাবাড়ী ৫০!
খালি যাত্রাবাড়ী ৫০!
কে যাইবেন যাত্রবাড়ী।
ওই যাত্রবাড়ী, যাত্রাবাড়ী। ৫০, ৫০!
কেউ এসে বলছে: মিয়া এখান থেকে যাত্রাবাড়ী ভাড়া ৫০ টাকা? ভাড়া কমাও। বাস নাই দেইখ্যা ঠেকাইছো যাত্রীদের? সুযোগ নেও মিয়া?
ড্রাইভারের চিৎকার- গেলে উডেন ৫০। যাত্রাবাড়ী ৫০। ওই যাত্রবাড়ী ৫০।
এতো রাত! কোনো বাস নাই। সাদা গাড়িটাকে এবং ড্রাইভারের চিৎকার-চেচামেচি ভালোভাবে পরখ করে দেখলো রাতুল। দুষ্টু গাড়ির কোনো রুষ্ট ড্রাইভার নাতো? সঙ্গে কি কেউ আছে? না। গাড়িটা এখনো খালি।
পরক্ষণেই দেখা গেলো। একজন যাত্রী উঠেছে পেছনের সিটে। রাতুল একবার ভাবছে উঠি। আরেকবার ভাবে- না। যদি এরা কোনো অজ্ঞান-মলম পার্টির লোক হয়? এসব ভাবনার মধ্যেই দেখা গেলো আরেক যাত্রী উঠেছে। বসেছে মাঝের সিটে। ইতোমধ্যে ঘড়ির কাটা সাড়ে ১২ তে। রাতুলের মনে হলো, নাহ এই গাড়িটা মিস করলে আজ আর বাসায় যেতে পারবো না। ঘুমাতে হবে। সকালেই আবার অফিস। মানুষের যে চাপ তাতে এই গাড়িটা এখনই ভরে যাবে। আল্লহ ভরসায় উঠে গেলো গাড়িতে।
ড্রাইভার উঠে পড়লো। তড়াক করে গাড়িটা স্টার্ট দিলো। ইতোমধ্যে আরেক যাত্রী ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসলো। ছুটে চললো গাড়িটা। পেছনের দুজন যাত্রী অস্বাভাবিক নড়া-চড়া শুরু করলো। রাতুলকে নানা প্রশ্ন। কোথায় থাকেন, কি করেন? কোথায় যাবেন? ইত্যাদি।
দুয়েকটা উত্তর দেয়ার পর বিরক্ত রাতুল বললো, “এতো কথা জানতে চাইছেন কেন আপনারা?” সঙ্গে সঙ্গে একজন একটা ছুরি তুলে ধরে রাতুলের গলায়। আরেকজন দুহাতে রাতুলের দু’চোখে জোরপূর্বক মলমজাতীয় কিছু একটা মাখতে থাকে। এমনভাবে মাখছে যেন অনন্তকাল ধরে চলবে এই মাখামাখি। চোখ জ্বলতে শুরু করে। রাতুলের মনে হলো কারা যেন তার চোখে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
যা আছে সব হাতিয়ে নিতে থাকে ছুরিওয়ালা। চোখে জ্বালাপোড়া বেড়ে যাওয়ায় তাকাতে পারে না রাতুল। এই মুহূর্তে গাড়িটা কোথায় তাও ঠাহর করা মুশকিল। ড্রাইভারের পাশের সিটের যাত্রীকে ছিনিয়ে নেয়া মোবাইল ফোনটা তুলে দেয় ওরা। রাতুলের চোখ বন্ধ। চোখ খুললেই জ্বালা-যন্ত্রণা। বাতাসের ছোঁয়া পেলে আগুন যেমন আরো উতলা হয়ে ওঠে।
গলা থেকে ছুরি অনড়। হুমকি-ধামকিও অবিকার। রাতুলকে দুপাশ থেকে চেপে ধরে আছে। বলছে- “কোনো কথা কবি না, কোনো নড়াচড়া না। ডায়রেক গলা নামাই দিমু। ”
অন্ধকার গাড়িতে মাঝে মধ্যে তাকাতে চেষ্টা করে রাতুল। কিছুটা হলেও অনুমান করতে চায়। চোখের এক কোণ দিয়ে হলেও বুঝতে হবে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা? দৈনিকবাংলা মোড়ে গিয়ে গাড়িটা ডানে মোড় নেয়। বক চত্ত্বর ঘুরে সোজা চলে এলো ইউনুস সেন্টার ভবনের কাছাকাছি মোড়টাতে। সময় লেগেছে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট। ততক্ষণে সব শেষ! চোখ শেষ, টাকা-মোবাইল ফোন সব। এখন শুধু জীবনে বাঁচার তাগিদ। ওদের সঙ্গে কোনো তর্কই করে না রাতুল। তর্ক করে কী লাভ? জীবনকে বরং ওদের হাতে তুলে দেয়াই শ্রেয়। কালো চেহারার সহযাত্রীরা গাড়ির ভেতরের অন্ধকারে মিশে রয়েছে। তাদের চেহারা অস্পষ্ট। অবশ্য ওদের চেহারার দিকে তাকানোর কোনো চেষ্টাও ছিলো না রাতুলের। চোখ বুজেই ওদের বলছে- ভাই আপনারাতো যা নেওয়ার নিছেন, এবার আমারে ছাইড়া দেন প্লিজ।
“তুই এতো ভদ্র ক্যা?”, মলমওয়ালাদের জিজ্ঞাসা।
আবারো মিনতি করে রাতুল- ভাই, ছাইড়া দেন আমারে! প্লিজ! আমার চোখটাতো নষ্ট হয়ে যাবে।
“এই চুপ। ছুরি এক্কেবারে প্যাটের ভিতরে ভইরা দিমু”, ধমকায় সহযাত্রীরা। আবার চুপসে যায় রাতুল।
ঢাকা শহরের অনিরাপদ রাস্তাঘাট, যানবাহন আর অজ্ঞান-মলম পার্টির বিকৃত রুচির অমানুষের ব্যাপারে রাতুল বরাবরই সচেতন। অনলাইন-অফলাইন পত্রিকার নিয়মিত পাঠক সে। পত্রিকা মারফত এসব ভয়ংকর ব্যাপার জানা আছে রাতুলের। কিন্তু বিধি আজ বাম। সে-ই মলমে ধরা। তার চোখেই মলম! সে-ই আজ মলমে নি:স্ব! অন্ধ প্রায়!
মতিঝিলের ইউনুস সেন্টারের কাছাকাছি মোড়ে এসে চলতি গাড়ি থেকে রাতুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। শুন্য ওয়ালেটটা তার গায়ের ওপর ছুড়ে ফেলে ওরা চম্পট দেয়। জ্বলন্ত চোখে ভগ্ন হৃদয়ে উঠে কোনো রকম দাঁড়ায় রাতুল। আহ্ জানটাতো ফেরত পেলাম! এইতো বেশ! ভাবে রাতুল। একটু দূরে পড়ে আছে ওয়ালেটটা। তাতে এখন শুধু অফিসের আইডি কার্ডটাই আছে।
একটা কথা খুউব মনে গাঁথে রাতুলের। চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেয়ার সময় ওরা বলে যায়- “সামনের চায়ের দোকান তে চোখে পানি দিস। নাইলে অন্ধ অই যাবি। ”
ওরা আমার চোখ নিয়ে চিন্তিত কেন? আমার প্রতি কি ওদের দয়া হয়েছিলো তবে? ওদের মধ্যেও কি মাঝেমধ্যে মানবিকতা জাগে? ওরা জানে এই মলম বেশি পরিমাণ চোখে লাগানোর পর পানি না দিলে চোখ নষ্ট হয়ে যায়!