কু-উ-উ ঝিকঝিক। রাত্রির অন্ধকারকে চিরে নীল রঙের ট্রেনটা ছুটে চলেছে।
সিটে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন আর্ট বুচওয়াল্ড। প্রচণ্ড ক্লান্ত তিনি। আজকেই সুইজারল্যান্ড থেকে প্যারিসে উড়ে এসেছেন। প্যারিস থেকে এই নীল ট্রেনে চেপে মোনাকো যাচ্ছেন। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সে বেচারী ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেনি। একাই মন্টিকার্লোতে যাবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এই সুযোগ ছাড়ার বান্দা বুচওয়াল্ড নন।
রাত আটটায় নীল ট্রেন পৌঁছে গেছে কানে। সাড়ে আটটাতেই নিসে। আর এক ঘণ্টা পরেই পৌঁছে যাবে মন্টিকার্লোতে। প্যারিস থেকে যখন ট্রেন ছেড়েছে, পুরো ভর্তি ছিল কামরা। গমগম করেছে সবকিছু। নিসে আসতে না আসতেই সবাই নেমে গেছে ট্রেন থেকে। মাত্র একজন ছাড়া। বুচওয়াল্ড চোখ বন্ধ করে থাকাতে টের পাননি এর কিছুই।
‘এই যে মশাই! শুনছেন!- রিনি রিনি কণ্ঠে কেউ ডেকে ওঠে।
চমকে চোখ খোলেন বুচওয়াল্ড। ঠিক পাশের সিটেই অপূর্ব রূপবতী এক তরুণী বসে আছে। অত্যন্ত দামি সাজসজ্জা তার। চোখে কৌতুহলী দৃষ্টি আর বন্ধুত্বের উষ্ণ হাসি নিয়ে বুচওয়াল্ডের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বুচওয়াল্ড তার দিকে তাকাতেই ভুবনমোহিনী হাসি দেয় মেয়েটি। তার হাসি যে বিশ্ব জয় করতে পারে, এটা মনে হচ্ছে মেয়েটা খুব ভালো করেই জানে।
মেয়েটার হাসির বদলে পাল্টা হাসি দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, বুচওয়াল্ড না হেসে অত্যন্ত অসৌজন্যমূলকভাবে মাথাটাকে ঘুরিয়ে নেন জানালার দিকে। মেয়েটা একটু অবাক হয়। বিস্ময়ের ছাপটা তার অনিন্দ্যসুন্দর ডাগর চোখে পড়ে, কিন্তু, চেহারায় তার ছাপ পড়ে না কোনো।
‘সবাই ট্রেন থেকে নেমে গেছে’- মধু ঝরানো কণ্ঠে বলে সে।
বুচওয়াল্ড কোনো উত্তর দেন না। জানালা দিয়ে বাইরেই তাকিয়ে থাকেন।
‘কথা বলার কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনিই শুধু আছেন ট্রেনে’- বললো মেয়েটা।
বুচওয়াল্ড অন্ধকার রাতে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
‘আপনি কি মন্টিকার্লো যাচ্ছেন?’- এবার সরাসরিই প্রশ্ন করে মেয়েটা।
মুখে উত্তর না দিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকান বুচওয়াল্ড। প্রচণ্ড বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন তিনি। আসার আগে স্ত্রী তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল যে, কোথাও কোনো অবিবাহিত মেয়ের সাথে কথা বলবেন না তিনি। স্ত্রীর প্রতি বেশি প্রেম দেখাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ‘চিন্তা করো না কোনো। শুধু অবিবাহিত কেন, কোনো বিবাহিত মেয়ের সাথেও কথা বলবো না আমি এই যাত্রায়। ’
স্ত্রীকে এই আলগা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসার জন্য এখন নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছেন তিনি।
‘আমিও মন্টিকার্লো যাচ্ছি’ উৎফুল্ল স্বরে বলে মেয়েটা, যেন অত্যন্ত মজাদার কোনো তথ্য এটি।
বুচওয়াল্ড বোকার মতো হাসেন।
‘এই সব যাত্রাগুলো না মাঝে মাঝে খুব একঘেঁয়ে হয়ে পড়ে। আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে, খুব কথা বলতে ইচ্ছা করেছ?’
‘কদাচিৎ’- নীরবতা ভেঙে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন বুচওয়াল্ড।
‘আমি না মানুষের সাথে কথা বলতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু, খুব কম লোকই আমার সাথে কথা বলে’- গাল ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বলে মেয়েটা।
এই রকম আগুনের মতো রূপের একটা মেয়ের সাথে কেউ কথা বলতে চায় না, ঠিক বিশ্বাস হয় না বুচওয়াল্ডের। নিজেকে দিয়েই বিচার করছেন তিনি। স্ত্রীর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি না থাকলে তিনি যে এর সাথে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসতেন, সে বিষয়ে তার নিজেরই কোনো সংশয় নেই।
‘আমার ঝুলিতে না খুব মজার একটা গল্প আছে। আপনি শুনবেন?’ আহ্লাদি সুরে মেয়েটা বলে।
জানালা বন্ধ করার ভান করেন বুচওয়াল্ড। কথাটা শোনেনই নি তিনি।
‘আপনি বিশ্বাস করবেন যে, আপনিই প্রথম অচেনা লোক, যাকে আমি এই দুর্দান্ত গল্পটা শোনাতে চাচ্ছি। ’
সশব্দে জানালা বন্ধ করেন বুচওয়াল্ড।
‘আপনি শুনলে অনেক মজা পাবেন। ’
খামোখাই জানালাটা আবার খোলেন বুচওয়াল্ড।
ট্রেন টানেলের মধ্যে প্রবেশ করে। সহযাত্রিণীর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় গভীর অন্ধকারে। খুব গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন বুচওয়াল্ড।
টানেল থেকে ট্রেনটা বের হতেই আবার কথা বলা শুরু করে মেয়েটা।
‘আপনার চেহারায় একটা সহৃদয় ভাব আছে। আপনি নিশ্চয়ই শুনবেন আমার গল্পটা। ’
নেতিবাচকভাবে মাথা নাড়েন বুচওয়াল্ড। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। মেয়েটা এতক্ষণে যেন টের পায় যে, তার কোনো আগ্রহ নেই এই গল্পে। নিমেষেই মলিন হয়ে যায় সুন্দর মুখটা।
‘পুরোটা শোনার দরকার নেই। কিছুটা শোনেন। ভালো লাগবে আপনার’- করুণভাবে মিনতি জানায় সে।
এবারও বুচওয়াল্ড মাথা নাড়েন- না।
‘একজনকে পেলাম, যাকে আমার গল্পটা বলা যায়। কিন্তু সে শুনতে চায় না। ’ বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেয়েটা।
স্ত্রীর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মেয়েটাকে বলতে গিয়েও থেমে যান বুচওয়াল্ড। নিজেকে হাস্যস্পদ বানানোর কোনো মানে নেই। তার বদলে বেশ রুক্ষভাবে বলেন যে, ‘দেখুন, আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি। ’ পাশে রাখা পত্রিকাটা তুলে নিয়ে তাতে মনোযোগ দেন তিনি।
‘আমি কি এত কুরূপা যে, আপনার একবিন্দু মনোযোগ পেলাম না?’- এবার সরাসরি অভিযোগনামা পেশ করে মেয়েটি। বুচওয়াল্ড কোনো উত্তর দেন না। নিউজপেপারের আড়ালে নিজেকে আরো সঁপে দেন।
মেয়েটা আর কথা বাড়ায় না। একজন সুন্দরী মেয়ের জন্য এর থেকে বেশি অপমান আর কী হতে পারে!
ট্রেন মন্টিকার্লোতে এসে থামে। দুজনেই প্ল্যাটফর্মে এসে নামেন। কেউ কারো সাথে কথা বলছেন না। স্টেশনে মাত্র একজন কুলি। দুজনকে তাই কুলি শেয়ার করতে হয়। গেটের দিকে দুজন এগিয়ে যান নিঃশব্দে।
গেটের কাছে বুচওয়াল্ডের জন্য অপেক্ষায় ছিল তার বন্ধু রিচার্ড। বুচওয়াল্ডকে দেখে ছুটে আসে সে। বুচওয়াল্ডের সাথে করমর্দন করার আগেই চোখ পড়ে সুন্দরী মেয়েটার ওপর। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে হা হয়ে যায় সে। রিচার্ডের কাণ্ড দেখে বিরক্ত হন বুচওয়াল্ড। রিচার্ডটা পাল্টালো না কিছুতেই। এখনো মেয়েদের দেখলেই হ্যাংলামোপনা শুরু করে। রিচার্ডের পেটে আঙুল দিয়ে অলক্ষে একটা গুঁতো দেন তিনি। গুঁতো খেয়ে সম্বিত ফেরে রিচার্ডের।
তার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, ‘গ্রেটাকে কোথায় পেলি দোস্ত?’
‘কোন গ্রেটা?’ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলেন বুচওয়াল্ডের।
‘গ্রেটা গার্বো’- আরো নেমে আসে রিচার্ডের গলা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে সে।
ফিরতি ট্রেনের নিচে নিজের গলা পেতে দেবেন, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন বুচওয়াল্ড।
লেখক: ভূতপূর্ব শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে টরন্টোতে বসবাসরত।