ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (১০) || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (১০) || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন

১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

২০০৪ সালে ‘দি গার্ডিয়ান’র জরিপে উপন্যাসটি বিশ্বের চিরায়ত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসে সবার উপরে। ইংরেজি ভাষার এই উপন্যাসটি কালজয়ী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। যাতে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তির প্রেক্ষাপট। বাংলানিউজের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন মাহমুদ মেনন। উল্লেখ্য, জর্জ অরওয়েলের মূল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালের ১৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের মথিহারিতে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন লন্ডনে ১৯৫০ এর ২১ জানুয়ারি। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দি রোড টু উইগ্যান পাইয়ার’, ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’, ‘এনিমাল ফার্ম’।

৯ম কিস্তির লিংক

তৃতীয় অধ্যায়

মাকে স্বপ্ন দেখছিল উইনস্টন।
মা যখন চলে গেলেন তখন তার বয়স দশ-এগারো বছর। লম্বা গড়নের নিশ্চল খোঁদাই মূর্তির মত নীরব এক নারী ছিলেন মা। ধীর লয়ে চলাফেরা করতেন, মাথায় উজ্জ্বল সাদা চুল। বাবাকে যতটা মনে পড়ে হ্যাংলা গড়নের। কালো পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। (উইনস্টনের মনে পড়ে তার বাবার জুতোর তলি থাকত খুবই পাতলা) চশমা পরতেন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে দেখা মুখদুটো আবছা মনে আসে।

স্বপ্নে উইনস্টন দেখছিল তার মা অনেক গভীর নিচে এক জায়গায় বসে আছেন। কোলে তার ছোট বোনটি। বোনটিকে উইনস্টনের আর মনেই পড়ে না। ক্ষুদে দুর্বল একটি শিশু, বড় বড় চোখ করে সদাই নীরব তাকিয়ে থাকত, এটুকুই মনে আসে। গভীর খাদ থেকে ওরা দুজনই উইনস্টনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা যেখানে তার যেন কোনও তল নেই। নলকূপের গভীর তলদেশ যেমনটা হয়, অথবা গভীর কোনও কবর—এটি এমনই এক স্থান যা ওর থেকে অনেক অনেক নিচে, আর তা আরও নিচেই নেমে যাচ্ছিল। ওরা যেন একটি ডুবন্ত জাহাজের সেলুনের ভেতর, আর ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসা পানির ভেতর থেকে ওরা উপরে তার পানে তাকিয়ে। ওরা তখনও তাকে দেখতে পাচ্ছে আর সেও ওদের দেখছে, কিন্তু ক্রমশই ওরা গভীর থেকে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছিল। ডুবে যাচ্ছিল সবুজ জলরাশির ভেতর, যেন তারা একবার চোখের আড়াল হলে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সে বাইরে, চারিদিকে আলো-বাতাস, আর ওদের মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সে উপরে বলেই ওরা নিচে যাচ্ছে। এটা সে জানত, ওরাও জানত। আর ওরাও যে জানে তা ওদের চেহারায় ফুটে উঠছে। তবে এ জন্য তাদের চেহারায় কিংবা হৃদয়ের গভীরে কোনও অভিযোগ নেই। ওদের একটা বিষয় জানা, মৃত্যুই তাদের পথ আর তা এই জন্য যে, উইনস্টনকে বেঁচে থাকতে হবে। এটাই যেন এক অমোঘ বিধান।

কী ঘটেছিল তা আর মনে নেই, তবে স্বপ্নে সে জানত, কোনও না কোনও পথে তার জীবনের জন্যই মা ও বোনের জীবন উৎসর্গ হলো। কিছু স্বপ্ন আছে যাতে স্বপ্ন দৃশ্যপটে মনোজাগতিক জীবনের বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকে এবং স্বপ্নের মাঝে কিছু ঘটনা ও ভাবনা সম্পর্কে স্বপ্নদ্রষ্টা সতর্ক হয়ে ওঠেন, যা স্বপ্ন ভাঙ্গার পর জাগ্রত অবস্থায়ও মূল্যবান মনে হতে থাকে। এটিও ছিল তেমনই এক স্বপ্ন।

এখন উইনস্টনের মনে যা খেলে যাচ্ছে তা তার মায়ের হারিয়ে যাওয়ার কথা। বছর ত্রিশেক আগের সে ঘটনা যতটা হৃদয়ভাঙ্গা ছিল এখন আর তেমনটা হয় না। বিয়োগান্তক এই বিষয়গুলো আগেই বেশি আলোড়িত করত। সে সময় মানুষের একান্ততা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এগুলোর মূল্য ছিল। পরিবারের একজনের পাশে অন্যজন দাঁড়াত, প্রশ্নটিও করত না। মায়ের স্মৃতি তার হৃদয়টাকে ভেঙ্গে দেয় কারণ তাকে ভালোবেসেই ছিল মায়ের মৃত্যুবরণ। সে সময় প্রতিদানে ভালোবাসা দেওয়ার মত বড় সে ছিল না। আর সে মনেও করতে পারে না কিভাবে আনুগত্যের ধারণার কাছে ছিল তার আত্মোৎসর্গ, যা ছিল ব্যক্তিগত ও অপরিবর্তনীয়।

অতীতে যা কিছু সে দেখেছে, আজকাল আর তা ঘটেই না। ভয়, ঘৃণা ও কষ্ট জর্জরিত একটি সময় এখন। এখানে আবেগের মর্যাদা নেই, কোনও গভীর বা যৌগিক দুঃখবোধও কাজ করে না। অথচ এর সবটাই সে যেন দেখতে পেল তার মা ও বোনের দুজোড়া বিস্ফোরিত চোখে। উর্ধ্বপানে দৃষ্টি মেলে তারা তাকে দেখছিল, সবুজ পানির ভেতর থেকে, শত শত বাঁও গভীর থেকে তারা দেখছিল। আর তখনও তারা আরও গভীরেই ডুবে যাচ্ছিল।

হঠাৎ দেখল, কোনও এক গ্রীষ্মের বিকেলে একটি স্প্রিংয়ের টার্ফের ওপর সে দাঁড়িয়ে। সূর্যের তীর্যক আলো ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। এমন একটি দৃশ্যপট প্রায়শই তার স্বপ্নে আসে, তবে উইনস্টন নিশ্চিত হতে পারে না, বাস্তবে কখনওই এমনটি সে দেখেছে কি না। তার বয়ে চলা চিন্তাধারায় নিজেই এর নাম দেয় সোনালি দেশ। একটি খরগোশের আঁচড়কাটা পুরোনো চারণভূমি, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পায়েচলা পথ। আর ছোট ছোট ঢিঁবি ছড়িয়ে এখানে সেখানে। মাঠের উল্টোদিকের শীর্ণ বেড়া ঘেঁষে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে দেবদারু গাছের পাতাগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে ঝিরিঝিরি নড়ছে। নারীর চুল যেমন বাতাসে ওড়ে দেবদারুর পাতায়ও তেমন নাচন লেগে আছে। যদিও দৃষ্টির বাইরে, তাও বোঝা যাচ্ছে কাছেই কোথাও ধীর স্রোতে বয়ে চলছে স্বচ্ছজলের নদী, যাতে উইলো গাছের ছায়ায় মিঠা পানির মাছেরা সাঁতার কাটছে।

কালোকেশী মেয়েটি মেঠোপথ ধরে এগিয়ে আসছে। এক লহমায় তার মনে হলো মেয়েটি তার গায়ের পরিধান টেনে ছিঁড়ছে আর তাচ্ছিল্যভরে আশেপাশে ছুঁড়ে ফেলছে। তার সাদা, নিটোল দেহবল্লরী উইনস্টনের মধ্যে কোনও আগ্রহই তৈরি করছে না, এমনকি সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না সে। বরং শরীর থেকে কাপড় ছুঁড়ে ফেলায় মেয়েটির যে তাচ্ছিল্যের প্রকাশ ছিল, সেটিই তাকে বেশি আলোড়িত করল। এই সাবলীল অবজ্ঞা প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি সংস্কৃতি বিধ্বস্ত হলো, ধ্বংস হলো চিন্তার প্রক্রিয়া। একটি অসামান্য বাহুছোঁড়ার ভঙ্গিমায় যেন বিগ ব্রাদার, পার্টি আর থট পুলিশ অসারতায় ভেসে গেল। এটিও ছিল প্রাচীন সময়েরই একটি ভঙ্গিমা। ‘শেক্সপিয়ার’ শব্দটি ঠোঁটে নিয়ে ঘুম ভাঙলো উইনস্টনের।

১১তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।