ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত ও বই প্রকাশ শুরু হয় সিপাহি বিদ্রোহের সময়। ১৮৬০ সালে হরিশচন্দ্র মিত্র ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সাহিত্যপত্র প্রকাশ করেন।
দিনদিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি প্রকাশনার মান ও পাঠক। তাই দেশের প্রকাশনা শিল্পের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় বিনিয়োগ করছেন।
খোশরোজ কিতাব মহল প্রকাশনীর সত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির বয়স ৭২ বছর। আগে এক সময় আমরা সাহিত্য, উপন্যাস, আইন, ইতিহাস ও গল্পের বিভিন্ন বই প্রকাশ করতাম, পাঠকের চাহিদাও ছিল অনেক। কিন্তু এখন আর তেমন চাহিদা নেই, তাই আমরা একাডেমি ভিত্তিক কিছু বইসহ গল্প-উপন্যাসেরও অল্পসংখ্যক কিছু বই প্রকাশ করি। ’
তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে অনেকেই ই-বুকের প্রতি নির্ভর হওয়ায় আমাদের এই প্রকাশনা শিল্পের অনেকটাই ক্ষতি হচ্ছে, পাঠকও দিনদিন কমে যাচ্ছে। ’
অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে সৃজনশীল বই প্রকাশ বাদ দিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফাইল, বুকলেট, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে কমে যাচ্ছে বই প্রকাশ, হারিয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাঠক। দেশে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উপন্যাস ও শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেশি এবং বিক্রিও হয় বেশি। কিন্তু সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পাঠকশ্রেণী গড়ে উঠছে না। প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের মধ্যে জনপ্রিয় লেখকদের বই ছাড়া অন্যদের বই তেমন বিক্রি হয় না।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর হিসাব রক্ষক ও সহকারি পরিচালক সুরুজ উজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তেমন বৈচিত্র আসেনি। যে কারণে আমাদের পাঠকের অবস্থান দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া ভালো বইয়ের পাঠক বৃদ্ধির জন্য শুরুতে যে প্রচারণা দরকার তা অনেক প্রকাশকরা করেন না। পাঠক বই সম্পর্কে আগাম তথ্য পায় না, ফলে বইও আশানুরূপ বিক্রি হয় না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশ ক্রমান্বয়ে অনেক গুণী লেখক হারাচ্ছে, কিন্তু ওই হারে নতুন লেখক তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, তাই বইয়ের পাঠকও বাড়ছে না। যেমন হুমায়ূন আহমেদ থাকতে তার বই দেড় থেকে দুই লাখ কপি অনেক প্রকাশকরাই বিক্র করত। পাঠকও ছিল অনেক। এছাড়া আগে যেমন তরুণ ছেলে-মেয়েদের কাছে বই একটা বিনোদনের মাধ্যম ছিল, এখন কিন্তু কম্পিউটারই বিনোদনের মূল মাধ্যম হয়ে গেছে। কাম্পিউটারে ইন্টারনেটে সময় দিচ্ছে সবাই। তরুণ পাঠকদের অনেকেই বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র এমরানুর রেজা বলেন, ‘বর্তমান অবস্থাতে পাঠক শ্রেণীকে বইয়ের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে হলে প্রকাশকদের বিকল্প ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। আর বর্তমান যেহেতু প্রযুক্তির যুগ তাদের কিছুটা প্রযুক্তি নির্ভরও হতে হবে। যেমন প্রকাশকরা যদি ই-বুক চালু করে তাহলে ইন্টারনেটে যারা সময় ব্যয় করছে তাদের একটা অংশও পুনরায় পাঠক হয়ে উঠতে পারে। প্রকাশকরাও ই-বুক বিক্রি করে অনেক লাভবান হতে পারে। ’
ষাটের দশক থেকে ঢাকার প্রকাশনা জগত খুবই সাবলীল হয়ে ওঠে। বহু প্রেসে স্থাপন করা হয় আধুনকি লাইনো ও মনোমেশিন। ছাপার মান হয় উন্নত। ধীরে ধীরে সৃজশীল বই প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাক। বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা এবং বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০টি সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ২০১৩ সালের বইয়ের তালিকায় ১১৮টি সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চার হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। বছরের হিসেবে দেখা যায় প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ কপি বই বিক্রি হয়। যা দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই কম। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে অনেক ঐতিহ্যবাহী, মধ্যবয়সী ও নবীন প্রকাশনীও তাদের ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫