ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (১২) || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (১২) || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন

১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

২০০৪ সালে ‘দি গার্ডিয়ান’র জরিপে উপন্যাসটি বিশ্বের চিরায়ত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসে সবার উপরে। ইংরেজি ভাষার এই উপন্যাসটি কালজয়ী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। যাতে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তির প্রেক্ষাপট। বাংলানিউজের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন মাহমুদ মেনন। উল্লেখ্য, জর্জ অরওয়েলের মূল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালের ১৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের মথিহারিতে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন লন্ডনে ১৯৫০ এর ২১ জানুয়ারি। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দি রোড টু উইগ্যান পাইয়ার’, ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’, ‘এনিমাল ফার্ম’।

১১তম কিস্তির লিংক

পাথর ছড়ানো মেঝেতে বসেছিল অনেকে, কয়েকজন করে ঠাঁসাঠাঁসি হয়ে কতগুলো ধাতব মঞ্চকের ওপর বসে, একজনের ওপর দিয়ে আরেকজন। উইনস্টন ও তার বাবা-মা মেঝেতেই একটি স্থান বেছে নিয়েছিল। আর তাদের কাছেই একটি মঞ্চকে পাশাপাশি বসেছিল এক বৃদ্ধ আর এক বৃদ্ধা ।

বৃদ্ধ লোকটির অভিজাত কালো স্যুট পরা, মাথায় একটি কালো কাপড়ের ক্যাপ একটু পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া। তাতে তার ধবধবে সাদা চুলগুলো দেখা যাচ্ছিল। তার চেহারা ছিল লালচে, আর চোখ দুটো নীল আর অস্রুভরা। জিনের গন্ধ আসছিল। মনে হচ্ছিল তার গা থেকে ঘামের গন্ধ নয় জিনের গন্ধ ছড়ায়। আর তার চোখ থেকে খাঁটি জিন বেরিয়ে আসছে। কিছুটা মদে ঝিম ধরে থাকলেও তার কষ্ট স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, আর তা ছিল অসহনীয়। উইনস্টন তার শিশুমন দিয়েই তখন বুঝে নিয়েছিল ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে গেছে, এমন কিছু যা ক্ষমার অযোগ্য, যে ক্ষতি কোনও কিছু দিয়েই পূরণ হবে না। তার কাছে এও মনে হচ্ছিল যে সে বুঝতে পেরেছে ঠিক কী হয়েছে। বৃদ্ধ লোকটি যাকে খুব ভালোবাসত—তার ছোট্ট নাতনিটি, সম্ভব নিহত হয়েছে। কয়েক মিনিট পরপরই বৃদ্ধ লোকটি একটি কথাই বলে চলছিলেন:
‘ওদের বিশ্বাস করা আমাদের উচিত হয়নি। আমি পই পই করে বলেছি, বলো বলিনি? ওদের বিশ্বাস করে এই ফল হলো! আমি তো গোড়া থেকেই বলেছি। আমাদের এই পায়ুকামীগুলোকে বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। ’

তবে ওদের ঠিক কোন পায়ুকামীদের বিশ্বাস করা উচিত হয়নি উইনস্টন এখন তা মনে করতে পারে না।

আক্ষরিক অর্থে অনেকটা সেই সময় থেকেই যুদ্ধ চলছে। তবে সত্যি বটে, যুদ্ধটা সবসময় একই রকম ছিল না। তার ছেলেবেলায় মাসের পর মাস লন্ডনের রাস্তাগুলোতে যখন তখন সংঘর্ষ দেখা যেত, এর কোনও কোনওটি স্পষ্ট মনে আছে উইনস্টনের। তবে পুরো সময়ের ইতিহাস ঘেঁটে, কে ঠিক কখন কার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল তা বলা অসম্ভব। কারণ কোনও লিখিত দলিল নেই, নেই কোনও বলে রাখা কথা। ঠিক এখন যে যুদ্ধ চলছে তার বাইরে আর কোনও কিছুর কথাই কখনও উচ্চারিত হয় না। এই সময়ে, এই ১৯৮৪ সালে (যদি এটা ১৯৮৪ সাল হয়ে থাকে) ওশেনিয়া ইউরেশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে রত আর পূর্বএশিয়ার সঙ্গে জোটভুক্ত। কোনও সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত উচ্চারণে কখনও কি স্বীকার করা হবে যে একদা এই তিন শক্তির সম্পর্কটি ছিল ভিন্ন ধারায়। উইনস্টন ভালো করেই জানে, মাত্র চার বছর আগে ওশেনিয়ার যুদ্ধ ছিল পূর্বএশিয়ার বিরুদ্ধে আর ইউরেশিয়া ছিল তার মিত্র। সে নিতান্তই এক গোপন জ্ঞান, যা সে ঘটনাক্রমে ধারণ করছে, কারণ তার স্মৃতি সন্তোষজনকভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। অংশীদারত্বের এই পরিবর্তন কখনওই আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। ওশেনিয়া ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে; মানেই হচ্ছে ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ সবসময়ের। এখন যার সঙ্গে শত্রুতা, সে শত্রুতাই শেষ কথা। তার সঙ্গে সন্ধি না ভবিষ্যতে সম্ভব হবে, না অতীতে সম্ভব ছিল।

কাঁধ দুটি ব্যথাতুর করে তুলে পিছনের দিকে ঠেলে দিল উইনস্টন (পশ্চাৎদেশের ওপর দুই হাত চেপে ধরে কোমরের উপরের অংশের গোটা শরীর মোচড়ানো এক ধরনের ব্যায়াম যা পিঠের পেশিগুলোর জন্য ভালো) আর তখন সম্ভবত দশ সহস্রতমবারের মত তার মনে হলো,  আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এ সব সত্য হতে পারে কিন্তু পার্টি যদি তার হাত অতীত পর্যন্ত বিস্তৃত করে, আর বলে দেয়, এমনটা কখনওই ঘটেনি—তাহলে নিশ্চিতভাবেই তা হবে এই সামান্য নির্যাতন বা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ।

পার্টি বলছে ওশেনিয়া কখনওই ইউরেশিয়ার সঙ্গে জোট বাঁধেনি। আর সে, উইনস্টন স্মিথ, ভালো করেই জানে, ওশেনিয়া মাত্র চার বছর আগেই ইউরেশিয়ার মিত্র ছিল। কিন্তু সে জানার অস্তিত্ব কোথায়? তা কেবলই তার সচেতনতায়, যা যেভাবেই হোক যথাশীঘ্র ধ্বংস করে দেয়া হবে। আর যদি অন্য সবাই দলের চাপিয়ে দেয়া মিথ্যা মেনে নেয়—যদি সকল নথিপত্র একই গল্প বলে—তাহলে এই মিথ্যাই ইতিহাসে পর্যবসিত হবে আর তা সত্য বনে যাবে।   দলের স্লোগান বলে, ‘অতীত যার নিয়ন্ত্রণে... ভবিষ্যতেও তার নিয়ন্ত্রণ’, ‘বর্তমান যার নিয়ন্ত্রণে, অতীতেও তার নিয়ন্ত্রণ’। তবে অতীত কখনওই পাল্টায় না। আজ যা সত্য তা চিরদিনের জন্যই সত্য। খুবই সহজ এ সত্য প্রতিষ্ঠা। যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে অব্যাহতভাবে আপনার নিজের স্মৃতিকে জয় করে চলা। ‘বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ’ নিউস্পিকে ওরা বলে ‘দ্বৈতচিন্তা’।

সোজা হও!—ব্যায়াম শিক্ষয়ত্রীর চিৎকার, তবে কিছুটা মোলায়েম স্বরে।

উইনস্টন তার হাত দুটি দুপাশে ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ফুঁসফুঁস ভরে নিল। তার মন চট করে ঢুকে পড়ল দ্বৈতচিন্তার জটিল জগতে। জানতে হবে আবার জানাও যাবে না, সতর্কভাবে যে মিথ্যার গড়ন তার কথনে পূর্ণ সত্যতার সতর্কতা নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে দুটি মত পোষণ করতে হবে, যার দুটিই বাতিল হয়ে যাবে, দুটি মতই পরস্পরবিরোধী জেনেও দুটিতেই বিশ্বাস করতে হবে, যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি দাঁড় করাতে হবে, যখন নৈতিকতার কথা আসবে তখন তা অস্বীকার করতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব আর দলই কেবল গণতন্ত্রের অভিভাবক, যা কিছু ভুলে যাওয়া প্রয়োজন তা ভুলে যেতে হবে, আর যখন প্রয়োজন হয়ে পড়বে তখনই তা আবার মনে করতে হবে, এবং এর পরপরই আবার তা ভুলে যেতে হবে, আর সর্বোপরি, প্রক্রিয়ার মধ্যেই ওই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এটাই সুক্ষ্মদর্শীতা: সচেতনভাবে অসচেতনতার প্রয়োগ, এবং অতঃপর আবারও এই মাত্র যে অচেতনতার কাণ্ডটি ঘটে গেল তা নিয়ে অসচেতন হয়ে যাওয়া। বুঝতে হবে, ‘দ্বৈতচিন্তা’ শব্দের মধ্যেই রয়েছে দ্বৈতচিন্তার প্রয়োগ।

১৩তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।