ঝরাপাতা এভিনিউ
তোমার চুলের উপমা বোঝাতে রাত আটটায়
ঘন আর কালো আঁধার ঘনালো ওই রাস্তায়।
সারি সারি বাড়ি, উল্টো পাশেই লম্বা প্রাচীর
আগেও ছিল না, এখনও অল্প মানুষের ভিড়।
রাত আটটায় ওই রাস্তাটা খুব নির্জন
রিকশাটা চলে, দুইটা একটা—জ্বলে লণ্ঠন।
আধাখানা চাঁদ হাতছানি দেয় ওই রাস্তায়
পাঁচিলের ‘পারে ব্যস্ত নগরী দাপিয়ে বেড়ায়।
পলকা বাতাসে পাতাঝরা গান, ছাতিমের ঘ্রাণ
বয়ে নিয়ে আসে পুরনো হারানো স্মৃতি—অম্লান।
মাঝে যতখানি দূরত্ব রয় দুই শব্দের
তত ব্যবধানে আমরা ছিলাম পরস্পরের।
বহু সন্ধ্যায় ওই রাস্তায় আমরা হেঁটেছি
কথা না বলেও শত তর্কের ঝড় যে তুলেছি।
ছুঁইনি তথাপি ছোঁয়ার অধিক পরিপূর্ণতা
লীলার অন্তে মনোসরণিতে মহাশূন্যতা।
নাড়া দিয়ে গেছো মর্ম-ধর্মে আমূল-তুমুল
মনোবাগিচায় ফুটিয়েছো তুমি শব্দের ফুল।
তোমার কৃপায় দুয়েক ছত্র গদ্য-পদ্য
তা দিয়ে সাজাই তোমার পূজার এ নৈবেদ্য।
হেই সুন্দর
(প্রহর্ষিণী)
হেই সুন্দর, বলে ডাকি যেই
আমার যখন চাই,
সেই সুন্দর তাকে সহজেই
আমার ভেতর পাই।
তার রূপটাই এবেলা এখন
শোনাই পাঠকগণ—
এই পদ্যের পুরোটা জুড়েই
তাহার প্রসঞ্জন।
বিস্তর দিন খোঁজাখুঁজি আর
অনেক সাধার পর,
এক সন্ধ্যায় দু’য়ে মিলে এক
হলাম পরস্পর।
তারপর দিন এতো যে রঙিন
সকাল-দুপুর-সাঁঝ,
তার আশ্রয় পেয়ে আমি আজ
সকল রাজার রাজ।
নেই ক্রোধ-ক্ষোভ অসূয়া বিষাদ
অখিদ্যমান মন
মঙ্গলময় ইশারা বাড়ায়
উদার আলিঙ্গন।
সর্বক্ষণ প্রমোদে বহাল
আমার নিমন্ত্রণ
দুঃখের দিন করেছে বিদায়
প্রহর্ষিণীর মন।
সম্পর্কের গাঁথুনি এমন
কঠিন ও মজবুত
এক চুল মাপ টলাতে বিফল
ভবিষ্যতের ভূত।
কেউ কেউ খুব কুরুচিসমেত
ঘটায় প্রকাশ তার
প্রেমহীন এক বৃথা সহবাস
যেমন, বলাৎকার।
মোর নিষ্কাম নিবেদনে হায়
দেখায় সে রস-রূপ
মুখ খুললেই কথা বলি তার,
যখন সে নিশ্চুপ।
হেই সুন্দর বলে আমি ডাক
দিতেই হাজির হয়;
নৈঃশব্দের সুরে পাতি কান
যে সুর জগৎময়।
কালখণ্ডের অববাহিকায়
যেসব, যা সুন্দর
নিজ গর্ভের মাঝে সে করেই
ধারণ নিরন্তর।
ব্রহ্মাণ্ডের অথবা কালের
এবং জ্যোতির্লোক
সব সৃষ্টির আগে ছিল সে-ই
স্বয়ং খোদার চোখ।
দোহাই
চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগে যে অমারাতে
খুনসুটিও জমতে থাকে তোমার সাথে,
কিন্তু বিরাট লায়েক সেজে খুব দেমাগে
গর্ভকুসুম ছিন্ন করি তোমার আগে;
এবং তোমার গর্ভের লাল ফুল ছেঁড়াতে
অনন্তকাল আটকে থাকি পুলসেরাতে।
ঢেউয়ের বুকে ঢেউ নাচে রে ঝঞ্ঝা যখন
স্মরণ পড়ে নাও দিয়েছে এক মহাজন,
বাঞ্ছা করি ওপার যাব দেখব তারে
কিন্তু আমার অপার থাকাই বারেবারে;
সময় গেল হাপুর হুপুর ডুব পারাতেই
গাঙ শুকাল মস্ত ফুটোর নাও সারাতে।
সান্দ্ররাতে হাস্নাহেনার সুবাস ছোটে
তনুমধ্যায় মৃদুমন্দ কাঁপন ওঠে,
আমার তখন উচিৎ কার্য তোমার সাধন
কিন্তু আমায় ব্যর্থ করে কামের বাঁধন;
আমার ঘরে বসত করে যে পাঁচজনা
জমার আগে রসের ক্ষীরে দেয় রে চোনা!
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আলোর দানো—
আঁধার চোখে আলোর চাবুক বারেক হানো
জীবের জীবন অন্ধকারে,অবহেলায়
যাচ্ছে সরে আস্তে ধীরে অস্তবেলায়
ওই কালানল আসছে ধেয়ে দেখছি যখন
দিচ্ছি দোহাই সহায় তুমি পতিত পবন।
রাত ভোরের বয়ান
এখানে রাত্রির বৃন্ত থেকে খসা সন্তাপ-সকল
শতমুখে কেঁদে ওঠে। অকালে নিহত হয় নদী।
হারায়ে পথের দিশা, মরুতে শুকিয়ে, সব জল
কালোর বন্দনা গায় অধোমুখে, প্রভাত অবধি।
কফিনে যে-কালো থাকে ঘুমে, দিনমান, মৃতপ্রায়
রাতে রক্তপিপাসায় জাগে করোটির অন্ধকারে;
যে-কালোর বাসনায় প্রেতসাধক হোমাগ্নি জ্বালায়—
বীভৎস সেই সে কালো নাচে এখানে—এবঙ্প্রকারে
নাচে বালিঘড়ি হাতে মাকড়সা-সম্রাজ্ঞী, কুৎসিত।
বিনিদ্র দর্শক আমি, তুমি এখানে অনুপস্থিত।
যে তুমি মোর কনীনিকায় আলোর ফুল্ল
থাকলে পাশে আমার কাছে স্বর্গতুল্য
জাহান্নামও;
সে-তুমি আমাকে ছাড়লে!
ছেড়ে চলে গেলে, যেতে পারলে,
প্রিয়তম?
ভূতের গলি বামে রেখে তুমি ডাইনে
যাও চলে সখা, কিন্তু এ আমি চাইনে!
প্রস্থানহেতু একে একে নিভে যায় সব
কালোর স্রোতে ভেসে আসে কার শব,
শৈশব?
(বসন্ততিলক)
শুক্র উচ্ছ্বল
রাতভর, মগজ জুড়ে প্রবল আঁধিঝড়, ডিএনএর
ক্রিস্টাল দেয়াল ভাঙে আঁধারপ্রজ মত্ত লাশ সব।
মজ্জায় হলুদ-লালে পারদ গলে। ওই তো দলছুট
শৈশব, ভেলায় দুলে নয়ন জলে ভাসছে তার শব।
মার্বেল গড়ায় আজো ধূসর ধূলিময় পথের ’পর...
দক্ষিণ আকাশ ব্যেপে জমাট বাঁধা কৃষ্ণমেঘদল।
বৃষ্টির পরশ মোছে স্মৃতির কালিদাগ। জীবনভর,
ঈশ্বর, আমাকে কাঁদাবে হায়, বেদনার্ত অঞ্চল?
নার্সিং হোম, পাংশু মুখের তুমি আছ বসে
একাকি এবং গর্ভপাতের বিড়ম্বনায়;
না-হওয়া আঙুলে তোমার হৃদয় ধরেছি যে কষে
এভাবে অকালে আমাকে হে সখি করো না বিদায়।
জরায়ুর লাল জবা ফুলটায় সন্তর্পনে
নির্মাণ করি বিধাতারে আমি মাতা মরিয়ম;
বৃথা প্রার্থনা, আদতে হলো যা—সেবিকা দু’জনে
বাঁকা চিমটায় ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিল, ভারি নির্মম!
চেতনানাশক ইনজেকশনে দু’পা টেনে টেনে
তুমি চলে যাও, আমি পড়ে রই, নর্দম-ড্রেনে;
কী যে অদ্ভুদ, কী যে অদ্ভুদ, কী যে অদ্ভুদ,
তুমি যে আমার, আমি যে তোমার নেভা বিদ্যুৎ।
(ইন্দিরা)
কিভাবে এই অনুর্বর হৃদয় জমিন
ফোটাবে ফের প্রসূন, স্নিগ্ধ আর রঙিন
দহনে ভস্মপ্রায় মৃত্তিকায় আবার
দাঁড়াবে উচ্চশির শাল-সেগুন-গামার
যেখানে গাইবে গান, বাঁধবে নীড় তিতির
হেনেছে বন্ধ্যারাত অন্ধকার ভীতি
এসো হে পঙ্খিরাজ দূর মেঘের দেশের
অলখি রূপকথার পুস্তকের থেকে
জেগেছে নীল আলোর নীলবালক আবার
হবে কি শেষ এবার সব গোলক ধাঁধার
তাকে তো রাখব আজ দুই চোখের তারায়
যে শিশু নীল আলোয় শিউলি ফুল কুড়ায়
(শার্দূলবিক্রিড়ীত)
নীল খরগোশ
পরানীল আলোর
অহমিকার
অভ্যন্তরের
খুব গহন
প্রান্তরময়
ছুটে যাচ্ছে কই?
নিশিভ্রমণ?
দলবলসমেত
পর্যটন?
সন্তাপময়
কোনো প্রেক্ষাপট—
ধূলিধূসর
খরগোশ জীবন,
অস্বীকার?—
এই প্রশ্নের
পাশে ঢের সময়
কাটিয়ে ফের
দেই ঘুমসাঁতার
নির্বিকার।
ফুল ঝরবার
আগে মৃত্যুময়
আবহে চাঁদ
অন্তিম অহং
ভুলতে চায়;
বনকুক্কুট
উড়ে যায় হঠাৎ
আঁধারে, তার
পাখসাট মিলায়
শূন্যতায়।
শষ্যের ঘুম
ভেঙ্গে যায় শিশুর
সিধেসরল
সওয়ালসমেত;
রাত ফুরায়—
ঘুমঘোর রাত,
শেফালির ধবল
চোখে, এবং
এক নীলবালক
ফুল কুড়ায়।
অন্ধ সওয়াল
মাগো আজকে রাতে কেন উঠছে কেঁদে
শত লোনলি গিটার?
কেন আত্মঘাতী কোনো ক্লান্তি নিয়ে
তারা জ্বালছে আলো?
কেন অন্ধকারে আরো অন্ধ কা’রে
খুঁজে ফিরছে কালো?
বলো আজকে রাতে কেন উঠছে ভেসে
মৃত মুখটি পিতার?
দেহযন্ত্র ওরে ষড়যন্ত্র করে
কেন বিগড়ে যে যায়,
খি খি খিল্লি খেয়ে কোটি ঝিল্লিপোকা
ওড়ে স্নায়ুর ভিতর;
মাগো চর্মতলে যতো রক্ত চলে
ততো লালচে ঝালর
ওড়ে, এক ম্যাটাডোর যেন উস্কে চলে
বহু ষাঁড়ের লড়াই।
খ্যাপা পাগলা জলে ফাঁপা গুর্দা জ্বলে
যেন বোম্বে মরিচ
খেয়ে মূর্ধাজ্বলা আমি আত্মভোলা
কালা নিগ্রো মেকুর—
পিলে তীব্র ব্যথা ভুলে আপ্তকথা
তুলি অম্লঢেকুর;
কানা ছিদ্র পথে টানা বিদ্ধ করে
চোখা আলোর কিরিচ।
শ্রুত কান্নাগুলো দ্রুত ফিনকি দিয়ে
ছোটা খুনের মতো
তাজা উষ্ণতম— কেনো উথলে ওঠে
মাগো আজ নিশিথে?
তবে এইবেলা কি ভবে ঘোরচালাকি
শেষে মিথ্যা মিথে
মিশে চাইবে যেতে স্বীয় কলজে ফুঁড়ে
ওঠা সূক্ত যত?
মাগো চান্দ্ররোদে দূরে সান্দ্র মেঘে
কারো আবছা বদন
দেখি অষ্টদিকে বায়ু মন্দ বেগে
মৃদু ছন্দে ভাসায়;
আমি আজকে রাতে মাগো পাংশু মুখে
আছি তীব্র আশায়
আহা এই ধরাতে যদি তোর বরাতে
মেলে সুধার সদন!
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫