১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
২৪তম কিস্তির লিংক
___________________________________
এটা সত্য যে খুব একটা পার্থক্য টানা যাবে এমন কোনও স্মৃতি তার নেই। ভালোভাবে মনে করতে পারে—এমন একটি সময়ও ছিল না, যখন পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল, ছেঁড়া মোজা বা ছেঁড়া গেঞ্জি-জাঙিয়া পরতে হয়নি, আসবাবপত্র সবসময় দেখেছে ভাঙাচোরা, নড়বড়ে, অনুষ্ণ ঘর, টিউব ট্রেনে ঠেলাঠেলি, বাড়িগুলোতে আস্তর খসে খসে পড়ছে, কালচে রুটি, চায়ের আক্রা, বিস্বাদময় কফি, অপর্যাপ্ত সিগারেট—সিনথেটিক জিন ছাড়া কোনও কিছুই সস্তা নয়, প্রাচুর্য নেই। কারও শরীর যখন বুড়িয়ে যায় তখন এগুলো আরও মন্দ আকার নেয়। যখন অস্বস্তি, আবর্জনা আর অভাবগ্রস্ততায় কারও হৃদয় আক্রান্ত হয়, দীর্ঘ শীতে কাবু থাকে, একটাই মোজা পরতে হয় দিনের পর দিন, লিফট যখন কখনওই কাজ করে না, পানি ঠাণ্ডা হয়ে থাকে, খসখসে হয় সাবানের টুকরো, সিগারেট যখন ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে হয়, আর খাদ্যের হয় এমন অগ্রাহ্য স্বাদ—তখন ওই বুড়িয়ে যাওয়াকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলা চলে কি? আর কেনই এগুলো অসহনীয় ঠেকবে যখন অতীতের কোনও স্মৃতিই এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না?
আরও একবার গোটা ক্যান্টিনে চোখ ঘুরিয়ে নিল সে। প্রায় প্রত্যেকেরই চেহারা কুৎসিত, নীল আলখেল্লা ছাড়া অন্য কিছু পরলেও এমন কুৎসিতই দেখাত। কক্ষের দূরের দিকটাতে একটি টেবিলে একা বসে ছোটখাটো মৌমাছির মত দেখতে একজন কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর সন্দেহভরা দৃষ্টি হেনে এদিক ওদিক দেখছেন। পার্টি যে শারীরিক গঠনের কথা নির্ধারণ করে দিয়েছে—লম্বা পেশিবহুল যুবক, গভীর-বক্ষা, উজ্জ্বল চুলের নারী, রোদে পোড়া, বেপরোয়া ভাব—নিজের দিকে না তাকিয়ে এর অস্তিত্ব রয়েছে এবং ভালো করেই রয়েছে বলে বিশ্বাস করা সহজ। কিন্তু বাস্তবিক হচ্ছে, যতটা তার বিচারবুদ্ধি বলে, এয়ারস্ট্রিপ ওয়ানের অধিকাংশ মানুষই এখন ছোটখাটো, কালো আর অবহেলিত। কৌতূহলের বিষয় এই মৌমাছি-আকৃতির মানুষটি মন্ত্রণালয়ের কাজে কিভাবে ঢুকে পড়ল। বেটে মোটা মানুষগুলো, জীবনের গোড়ার দিকেই গায়ে মেদ জমিয়ে ফেলে, খাটো খাটো পায়ে দ্রুত-হন্তদন্ত হাঁটে, আর তাদের ভোমা-দুর্বোধ্য মুখমণ্ডলে কুঁতকুঁতে চোখ। দলের প্রতিপত্তির মাঝেই এই ধরনের মানুষগুলোর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আরেকবার তুর্যধ্বনি বাজিয়ে প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা শেষ হলো আর শুরু হলো ধাতব সুরের সঙ্গীত। পরিসংখ্যানের ধামাকায় এতক্ষণ হতবাক হয়ে থাকার পর এবার মুখ থেকে পাইপটি বের করে আনলো পারসন্স।
‘প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় এবার নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করেছে’—যেন খুব বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিমায় মাথাটি নাড়াতে নাড়াতে বলল সে। ‘আরে শোনো স্মিথ, বুড়ো বালক, আমার মনে হয় তোমার কাছে আমাকে দেওয়ার মত কোনো রেজর ব্লেড নেই!’
‘একটিও না’—বলল উইনস্টন। ‘গেল ছয় সপ্তাহ ধরে আমি একই ব্লেড ব্যবহার করছি’
‘ঠিক আছে—ঠিক ভাবলাম তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি, বুড়ো বালক। ’
‘দুঃখিত’—বলল উইনস্টন।
মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার সময় সাময়িক বন্ধ থাকা প্যাঁকপ্যাঁক কণ্ঠস্বরটি ফের চালু হয়েছে, আগের মতন সমান সশব্দে। কী কারণে যেন উইনস্টনের ভাবনায় এলো মিসেস পারসন্সের কথা। তার ফাঁপা চুল আর মুখের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা ময়লার আস্তর চোখে ভেসে উঠল। দুই বছরের মধ্যে তার সন্তানেরা তাকে থট পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে আর মিসেস পারসন্স বাষ্পায়িত হয়ে যাবে। অন্যদিকে, পারসন্স কখনওই বাষ্পায়িত হবে না। সাইমকে বাষ্পায়িত করা হবে। উইনস্টনকে বাষ্পায়িত করা হবে। ও’ব্রায়েনকে বাষ্পায়িত করা হবে, কিন্তু পক্ষান্তরে পারসন্সকে কখনওই বাষ্পায়িত করা হবে না। এই চক্ষুহীন, হংসকণ্ঠের জন্তুটিও কখনওই বাষ্পায়িত হবে না। ছোট মৌমাছি-আকৃতির মানুষগুলো যারা মন্ত্রণালয়ের গোলকধাঁধার মত বারান্দাগুলোতে ভন ভন করে ঘুরছে ওদেরও কখনওই বাষ্পায়িত করা হবে না। আর কালো চুলের মেয়েটি, ফিকশন ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি—ওদেরও কখনওই বাষ্পায়িত করা হবে না। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কে টিকে থাকবে আর কে অন্তিম পথের যাত্রী হবে: যদিও টিকে থাকার কারণটি কী তা নিশ্চিত করে বলা সহজ নয়।
২৬তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫