ভোরবিহানে ফার্ম হাউসের হলরুমে ব্রু করা হয় তাজা কফি। আমি পেয়ালায় কফির সঙ্গে এক ফোঁটা আইরিশ ক্রিম ও সিনেমনের গুড়া মেশাতে মেশাতে দেখি গতকালকের কৃষ্ণকায় এটেন্ডেন্ট নারীটি তার পরচুলায় ছোটখাট মাথাইলের মতো ডিজাইন তুলে ঝাড়ন দিয়ে মোচছেন ডিসপ্লে ক্যাবিনেটের ধুলাবালি।
গতকাল ব্রিজিত ও ইয়োরগান আস্ত একটি শ্যালে ভাড়া নিয়ে তার এক্সট্রা কামরা আমাকে দিতে চাইলে আমি রাজি হইনি। একই শ্যালেতে রাত্রিযাপন করে রুদ্ধ কামরায় বসে তাদের গৃহযুদ্ধের সাক্ষী হতে আমি চাইনি। তার উপর আমার অবচেতন মন তাদের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার ব্যাপারে আমাকে তাড়া দিচ্ছিলো। এ ফার্ম হাউস থেকে পর্যটকরা ভাড়া করতে পারে হ্রদে ভাসানোর জন্য নৌকা, পাহাড়ি পথে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ঘোড়া, কিংবা চারচাকার কোয়াড বাইক, এবং আঙ্গিনায় পেতে শোয়ার জন্য তাঁবু। তো আমি একটি মাঝারি সাইজের টেন্ট ভাড়া করে তা খাটিয়েছি ব্রিজিত ও ইয়োরগানের শ্যালে থেকে বেশ দূরে টিলার ঢালে কয়েকটি পামগাছের ছায়ায়।
সকালে কফির জন্য হলরুমে আসতেই খানিকটা পরিচয় হয়েছে সিনোর আলেসান্দের সাথে। কিন্ত তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা তেমন একটা জমেনি। এটেন্ডেন্ট মহিলা হাতআয়নায় তার চুলের বিন্যাস দেখতে দেখতে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়েছেন বারান্দায়। তার নাম মিস নাসিবুসিও। তিনি জানিয়েছেন যে,সিনোর আলেসান্দ ভুগছেন পার্কিনসন রোগে। তবে অনেক দিনের অভ্যাস সকালবেলা হাতে লিখে মাবুদা ফার্মের মেনু তৈরি করা। এখানকার ট্রাডিশন হচ্ছে, প্রতিদিন পর্যটকদের নিত্য নতুন খাবার দাবারের সাথে হাতে লিখে কার্বন কপি করে সরবরাহ করা হয় ফ্রেস মেনু। পঁয়ষট্টি বছর ধরে চলছে এ প্রথা।
xc
পেয়ালায় কফি নেয়ার আগে আমি একটু সময় নিয়ে সাবেক রাজকুমারের সংগৃহীত বইপত্রগুলো ঘাঁটি। এখানে পাওয়া যায় ইতালির মিলান থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি মুদ্রিত ফরাসী পক্ষীতত্ত্ববিধ ফ্রান্সিস লে ভিলিয়েন্ত এর জার্নাল। যেসব পাখি আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলে তিনি সেখানে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তাদের সবগুলোর স্কেচ পাওয়া যায় এ গ্রন্থে। পাখি ছাড়াও যেসব আদিবাসী নারীদের সাথে মিশেছিলেন, পরদেশী পুরুষ হিসাবে তাদের চিত্রও এঁকে রেখে গেছেন ভিলিয়েন্ত সাহেব। এগুলোর ভেতর নারিনা নামের খোয়খোয় গোত্রের উদ্ভিন্ন যৌবনা নারীটির চিত্র খুঁজে বের করতে আমার বিশেষ একটা সময় লাগে না। প্রায় নিরাভরণ এ নিতম্বীনীর বক্ষযুগল ও কটিদেশে প্রচুর কড়ি ও পুঁতির অলংকারাদি এঁকে তিনি রক্ষা করেছেন তার আব্রু। নারিনার চিত্রের পাশে তার সম্পর্কে লিখেছেনও তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। বিবরণের ভাষায় আমার দখল না থাকলেও তার বিস্তার দেখে আন্দাজ করি, সুরিনামের এ পাখিওয়ালা মজে ছিলেন মর্মান্তিকভাবে।
হলরুমের একটি টেবিলে কফির মগ সামনে নিয়ে একা বসে আছেন এক শ্বেতাঙ্গ। এ সাহেবের দাড়িগোঁফের রঙ হাল্কা হলুদাভ। পিঙ্গল চোখ দুটি থেকে জন্ডিস রোগীর মতো ছড়াচ্ছে অসুস্থ আভা। তার কোট পাতলুনে মোটর মেকানিক্সদের মতো তেলমবিল মাখানো। আজ আমি সুরুজ ওঠার লগ্নে চুলের সিঁথির মতো সোজা তরুবীথিতে ছায়াচ্ছন্ন সড়কে মর্নিং ওয়াক করি। তখন এ পিঙ্গল চোখের সাহেবকে দেখি গার্ডেন সিজার বা বাগানে গাছ ছাঁটার কাঁচি হাতে একটি ট্র্যাকটরের কাছে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে গুড মর্নিং জানান। ফেরার পথে খেয়াল করি ট্র্যাকটরের পাশে মাটিতে মস্ত মস্ত সব সিরামিকের টবে রাখা পাম জাতীয় কয়েকটি গাছ। নরসুন্দরের যত্নে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তিনি ছেঁটে দিচ্ছেন তাদের ছড়ানো পাতা। কফির মগে চুমুক দিয়ে এ সাহেব এখন চার পাঁচটি ভারী রূপার মুদ্রা দিয়ে লুফালুফি খেলছেন। আমার সাথে চোখাচুখি হতেই খুব দক্ষতার সাথে রেজকি পয়সা লুফতে লুফতে তিনি ভুরুর ইশারায় সম্ভাষণ জানান। মনে হয় চাইলে খুব সহজে তার সাথে গল্পগুজব করা যায়।
হান্টিং ভেস্ট ও হাইবুটের সাথে লেদারের স্কিনটাইট প্যান্ট পরেছে ব্রিজিত। মারদাঙ্গা সিনেমার নায়িকার মতো দেহের ঊর্মিময় ব্যাঞ্জনা ছড়িয়ে পেছনের দুয়ার দিয়ে সে ঢুকে। তার হাতে খুব ছোট্ট মিনিয়েচার সাইজের একটি বালতিতে ফেনায়িত তাজা দুধ। সাইড টেবিলে দাঁড়িয়ে স্পিরিট স্টোভে তা দিয়ে ক্যাফে-ওলে বানাতে বানাতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,‘সকালবেলা কফির জন্য সদ্য দোহানো উষ্ণ খাঁটি দুধ পাওয়া যাচ্ছে, ইজ নট মাবুদা ফার্ম অ্যা কুল প্লেস?’ আমি তার কথায় সায় দিয়ে বলতে যাই— পর্যটকরা চাইলে যেখানে করতে পারে নিজহাতে গাভি দোহন, জায়গাটিকে অবশ্যই বলতে হয় মনমোহন। কিন্তু আমাকে কথা বলার মাঝপথে থামিয়ে সে ছোট্ট বালতিটি এগিয়ে দিয়ে বলে,‘যাও, ব্যাকইয়ার্ডে পার হয়ে গরুর বাথানের কাছাকাছি খুঁটিতে বাঁধা আছে একটি জার্সি গাইগরু। গেস্টরা একে দোহন করতে পারে, কোনো অসুবিধা নেই, দুইয়ে নিয়ে আসো তাজা দুধ। তোমাকে বানিয়ে দিচ্ছি একদম ডিলাক্স ক্যাফে-ওলে। ’ সে আমাকে দুধ দুইয়ে আনার জন্য আবারও ইনসিস্ট করলে, আমি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে তাকে এভয়েড করার চেষ্টা করি। দুধ দোহানোর দক্ষতা আমার নেই, আর গাভী লাথি চালালে তো রীতিমতো মুসিবতই হবে। ব্রিজিত আমার থুতনিতে হাত রেখে মুখ তার দিকে ফিরিয়ে আবার দোহানোর প্রসঙ্গ তুললে আমি আতঙ্কিত হই। মনে মনে ভাবি, জিন্দেগিতে আমি পদাঘাত সয়েছি এন্তার, গাইগরু দ্বারা অপমানিত হওয়ার কোনো খায়েশ আমার নেই। সে আমার মনোভাব বুঝতে না পেরে জানতে চায়,‘তুমি চাও না ক্যাফে-ওলে?’ আমি যে কোন ছলে তার এ প্রস্তাবকে এড়াতে চাই, তাই বলি,‘আইরিশ ক্রিমের ফোঁড়ন দেয়া রেগুলার কফিই তো স্বাদে তোফা। হোয়াই ডু আই ওয়ান্ট ক্যাফে-ওলে। ’
গুনগুনিয়ে কিছু একটা গাইতে গাইতে ইয়োরগান হলরুমে ঢুকে। সে ব্রিজিতের জন্য কুড়িয়ে এনেছে নেপকিনে মোড়া শিশির ভেজা কিছু ইয়াসমিন ফুল। ব্রিজিত তা হাতে নিয়ে টেবিলক্লথে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলে,‘হোয়াট আর ইউ সিংগিং হানি?’ ইয়োরগান এবার লিরিকের শব্দগুলো খানিক স্পষ্ট করে গাইলে আমরা শুনি,‘আই ক্যান্ট সিমস টু মেক ইউ মাইন…। ’ খুশিতে ঝিকমিকিয়ে ওঠে ব্রিজিত বলে,‘এটা তো আমেরিকান পপ ব্যান্ড সিডসের গাওয়া গান। কত বছর আগে এসব গান শুনেছি, সিং ইট অ্যা লিটল বিট লাউড হানি..। ’ ঝরা ইয়াসমিনের সুরভিতে মাতাল হয়ে ওঠে টেবিলের পরিবেশ।
হাতে লেখা মেনু নিয়ে আমাদের টেবিলে আসেন সিনোর আলেসান্দ। তার বয়স তেমন বেশি গাছপাথর কিছু নয়, তবে তাকে কি কারণে জানি খুব বিধ্বস্ত দেখায়। হরিণগুলো শুট করে দিতে রাজি হওয়ায় ব্রিজিতের হাত স্পর্শ করে বিনম্রভাবে তাকে ধন্যবাদ জানান তিনি। রাইফেল শুটিং-এ ব্রিজিতের যে মার্কসম্যানের মতো দক্ষতা আছে, তা সিনোর লোকমুখে শুনেছেন। সে মাবুদা ফার্মে এসে যাওয়াতে তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন। কথা বলতে বলতে শহরতলীতে বিষ্ফোরণ হলে যে রকম নড়ে ওঠে দূরের দালানকোঠা, সেরকম থেকে থেকে কেঁপে ওঠছে সিনোর আলেসান্দের শরীর। আমি জানতে চাই— হঠাৎ করে তার প্রাইভেট গেম রিজার্ভ বা অভয়ারণ্যে হরিণের সংখ্যা বেড়ে গেল কেন? তিনি জানান যে—আদিতে এখানে ছিলো একটি মর্দা ও পাঁচটি মাদি চিতাবাঘ। এরা মূলত নিয়ন্ত্রণে রাখতো হরিণ কুলের বংশবৃদ্ধি। বছর পাঁচেক আগে তিনি চিকিৎসার জন্য ইউরোপ গেলে, পোচাররা মাদিগুলোকে বিষ খাইয়ে মেরে ছিলে নিয়ে যায় তাদের চামড়া। তখন থেকে বাড়ছে হরিণের সংখ্যা। বছর দুয়েক আগেও রিজার্ভে ঘুরে বেড়াতো নিংসঙ্গ মর্দা চিতাবাঘটি। তার চামড়ায় ছিল মেরুদণ্ডের কাছে ব্যতিক্রমি তিনটি টানা কালো দাগ। এ ধরনের টানা দাগঅলা চিতাকে বলা হয় কিং-চিতা। তার চোখের নিচেও কালো টিয়ার মার্কটি ছিল খুবই নজর কাড়া অত্যন্ত প্রমিনেন্ট। এ বিশেষ ভ্যারাইটির কিং-চিতা আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে আজকাল আর তেমন একটা সুলভ নয়। তো পোচাররা একে ফাঁদ পেতে ধরে নিয়ে সম্ভবত বিক্রি করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। পাশ্চাত্যের চিড়িয়াখানাগুলোতে কালো টানা দাগ ও টিয়ার মার্কের জন্য এদের এতো ডিমান্ড যে, হাল জামানার ব্ল্যাকমার্কেটে একটি কিং-চিতাকে দুই বা আড়াই লক্ষ ডলারে বিক্রি করে দেয়া কঠিন কিছু না।
সিনোর আলেসান্দ দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে বলেন, ‘আমার রিজার্ভে এখন আর কোনো চিতাবাঘ নেই। তাই হরিণকে শুট করে কালিং না করালে যে গ্রাসল্যান্ড আছে তার উপর চাপ পড়বে অনেক বেশি। ’ কৌতূহলি হয়ে আমি এ পর্যায়ে জানতে চাই,‘সোয়াজিল্যান্ডে আগে চিতাবাঘের সংখ্যা কেমন ছিল, আর পোচিং এর ফলে এখন তা কমে কতটায় দাঁড়িয়েছে?’ শরীরের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণ করতে করতে তিনি জবাব দেন,‘সোয়াজিল্যান্ডে ভালো করে কখনো কিছু গণনা হয়নি, তাই নির্দ্দিষ্টভাবে পরিসংখ্যান দিতে পারব না। তবে আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে ১৯০০ সালের দিকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে চিতাবাঘের সংখ্যা ছিল কমবেশি একলাখের মতো । ১৯৮০ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় পচিশ হাজারে। বর্তমানে সাউথ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, মালাওয়ে ও নামিবিয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে চিতাবাঘের সংখ্যা হবে ১২,০০০ এর কাছাকাছি। আর এ হারে পোচিং চললে বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, আগামি পনেরো বছরের ভেতর এ এলাকা থেকে সম্পূর্ণরূপে লোপ পাবে চিতা প্রজাতি। এ বিলুপ্ত হওয়ার তথ্যটি চাউর হওয়া মাত্র চিতাবাঘের পোচিং এর হার অভারনাইট ডাবোল ট্রিপোল হয়ে যায়। বিরল প্রজাতির প্রাণী হিসাবে ঘোষিত হওয়া মাত্র ব্ল্যাকমার্কেটে চিতাবাঘের চামড়ার মূল্য বৃদ্ধি পায় ছাপ্পান্ন শতাংশ। ’
ব্রিজিত তার হান্টিং ভেস্টের পকেট থেকে বের করে একটি প্লাস্টিকের ঝিপ-লক করা ব্যাগ। গতকাল সন্ধ্যা ও আজ ভোরে সে শুট করে মেরেছে মোট পাঁচটি হরিণ। প্রমাণ হিসাবে সে এগুলোর কান কেটে ঝিপ-লক করা ব্যাগে করে তা সিনোরকে দেখাতে এনেছে। সিনোর আলেসান্দ খুশি হয়ে মিস নাসিবুসিওকে ফার্মের লেজার বুকে পাঁচটি হরিণ খালাস করার সংখ্যাটি এন্ট্রি করতে হুকুম দেন। তারপর স্মোকিং জ্যাকেটের ব্রেস্ট পকেট থেকে একটি আধপোড়া সিগার বের করে ধরাতে ধরাতে ব্রিজিতকে বলেন, ‘হাত খুব কাঁপে বলে আমি আর এখন কালিং এর জন্য ডিয়ার শুট করতে পারি না। তুমি যে এক্সট্রা হরিণগুলো নিকাস করে দিচ্ছ, এ বিষয়টা মাবুদা ফার্ম একনোলেজ করতে চায়। তোমরা এখানে দিন কয়েক থেকে যাও, শ্যালের ভাড়া বাবদ কিছু দিতে হবে না। ’ মিস নাসিবুসিও লেজার খাতায় মৃত হরিণের সংখ্যা এন্ট্রি দিয়ে ট্রে-তে করে নিয়ে আসেন শিকারের জন্য অনেকগুলো তাজা এলজি জাতীয় কার্তুস। আলোচনায় মৃত হরিণের মাংশের কী হবে, এ প্রসঙ্গ চলে আসলে মিস নাসিবুসিও জানান যে— ফার্মের কর্মচারীরা তা অলরেডি সংগ্রহ করেছে। এখানে পর্যটনে আসা গেস্টদের লাঞ্চ ডিনারে গেম-মিট সরবরাহ করার রেওয়াজ আছে। ভেনিশন বা টাটকা হরিণের মাংশের স্টেক খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। অতিরিক্ত মাংশ লবণ মাখিয়ে শুকিয়ে রাখা হবে।
শ্যালের ভাড়া দিতে হবে না শুনে ব্রিজিত ও ইয়োরগান অবধারিতভাবে খুশি হয়। আমার তাঁবুর ভাড়া মওকুফ হয়নি বলে আমি মনক্ষুণ্ন হই। তবে হরিণ হত্যা করে বীরাঙ্গনার রোল প্লে করছে ব্রিজিত। আমার তো ইঁদুর মারারও মুরাদ নেই, সুতরাং সে যেসব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে তা আমি ঠিক প্রত্যাশা করতে পারি না। সিনোর আলেসান্দ টেবিলের ওপর মেলে ধরেন তার হাতে আঁকা একটি মানচিত্র। তাতে মাবুদা ফার্ম, লাগোয়া গেম রিজার্ভ বা অভয়ারণ্য, ও একটু দূরের লেবোমবো পাহাড়ের রীজের দিকে পায়ে চলা পথগুলোর রেখাচিত্র আছে। দিক নির্দেশনা ছাড়াও তাতে বড় বড় বোল্ডার, রকফর্মেশন, ঝর্ণা ও প্রাচীন গাছের প্রতীকগুলো ল্যান্ডমার্ক হিসাবে স্পষ্ট আঁকা আছে। তবে ল্যান্ডমার্কগুলোর পাশের বর্ণনা খুব ছোট হরফে হাতে লেখা বলে তিনি ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করেন। তা দিয়ে খুব ঝুঁকে আমাদের বুঝিয়ে বললে, বিগত আমলের রাজকুমারের এ বংশধরকে জহুরির মতো দেখায়। আমরা যাতে পথ হারিয়ে না ফেলি, সেজন্য আতশি কাচ হাতে পাথর বা গাছের প্রতীকের প্রতিটি ডিটেল তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্দেশ করতে থাকলে, মনে হয় এন্টিক কোনো অলংকারের মধ্যে গাঁথা মণিমুক্তা আমাদের খুঁটিয়ে দেখাচ্ছেন তিনি। মানচিত্রটি খুব কাজে লাগবে জানালে তার ইশারায় মিস নাসিবুসিও এর মিমিওগ্রাফ করা কপি আমাদের সরবরাহ করেন।
বিদায় নিয়ে উঠে পড়ার সময় সিনোর আলেসান্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানান, তার প্রাইভেট গেম রির্জাভে আর আগের মতো বন্য প্রাণী-সম্পদ নেই। কয়েক বছর আগেও ছিল দু জোড়া হোয়াইট রাইনো বা শ্বেতকায় গন্ডার। পোচিং এর ফলে কেবলমাত্র একটি অবশিষ্ট আছে। এ বুড়ো মর্দা গন্ডারটিকে বেশ কয়েকদিন হল পর্যটকরা স্পট করতে পারছে না। যেসব জায়গায় তার চরে বেড়ানোর কথা সেসব স্পটে সে আসছে না। ওয়াটার হৌল বা নুনিতেও তার পায়ের তাজা ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না। ‘নাও আই অনলি প্রে… যিসাশ উইল সেভ মাই ওল্ড রাইনো,’ বলে সিনোর বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকলে তাকে বয়সের চেয়েও অনেক বেশি বুড়ো দেখায়। ইয়োরগান তাকে জানায় যে, তার সাথে আছে ছোট চারটি প্রপেলার লাগানো একটি সার্ভিলিয়েন্স ক্যামেরা। সিনোর অনুমতি দিলে সে ক্যামেরাটি উড়িয়ে দেখতে পারে। এতে হাতি বা রাইনো এ ধরনের ভারী বিশাল সব জানোয়ারের ছবি উঠে আসবে। ‘গো এহেড,’ বলে তাকে ক্যামেরা উড়ানোর অনুমতি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালে, সিনোরকে বৈরী প্রতিবেশের চাপে নাজেহাল হওয়া মানুষের মতো বিষণ্ন দেখায়।
বেলা দশটার দিকে মিস নাসিবুসিও হ্রদের পাড়ে গাছের ছায়ায় বেতের চেয়ার পেতে পরিবেশন করেন ব্রাঞ্চ। ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ মিলিয়ে একসাথে ব্রাঞ্চ হিসাবে আয়োজিত হয়েছে এ ভোজ। শ্যালের মেইড টেবিলে সাজিয়ে রাখছে বেইক করা টাটকা ব্রেড, এগ বেনিডিক্ট ও প্রচুর পরিমাণে ভেনিসন বা হরিণের মাংশের বেকন ও সসেজ। হ্রদের পাড়ের জলাভূমিতে গজিয়েছে দীর্ঘ ঘাস। তাতে লুকোচুরি খেলছে বুনোহাঁস। থির হয়ে থাকা পানিতে মেঘভাসা আকাশের প্রতিফলনের সাথে মিশছে লেবোমবো পাহাড়ের চূড়ার প্রতিবিম্ব। কেবল মাত্র একজন পর্যটক তাতে নৌকা ভাসিয়ে বসে আছে রিলাক্স ভঙ্গিতে। গতকাল বিকালে এ তরুণকে চুলের সিঁথি মতো সোজা তরুছায়াময় সড়কে ঘোড়া হাঁকাতে দেখেছি। এখন বাইছে সে নাও। বেটা নির্ঘাৎ মৌজে আছে, তার দিকে তাকিয়ে থেকে ব্রিজিত বলে, ‘লাকি ডগ’।
একটু আগে আমরা যে গাছতলায় বসেছি, তার ছায়ায় ইয়োরগান প্লাস্টিকের ফেন্স দিয়ে ঘিরে তৈরি করেছে গড়ের মতো। ওখানে পাতা ফোমের মাদুরের ওপর বসে এক মনে খেলছে কার্লা। সে রঙচঙে ব্লকগুলোকে সারি দিয়ে সাজাচ্ছে। ইয়োরগান ফেন্সের পাশে বসে চারচারটি প্রপেলার-ওয়ালা তার সার্ভিলিয়েন্স ক্যামেরাকে রেডি করছে। আলোকচিত্রের উড্ডীন এ কাঠামোকে ড্রোনের মতো দেখায়। তার তলায় লাগানো মিনিয়েচার মোটর দেখে আমি চমৎকৃত হই। সে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে প্রথমে তা কার্লা যেখানে খেলছে, সে গড়ের উপর দিয়ে উড়ায়। উড্ডীন ক্যামেরাটি ঠিকঠাক মতো তার কাছে ফিরে আসলে, প্রচুর কনফিডেন্স নিয়ে ইয়োরগান এবার ক্যামেরাটিকে পাঠিয়ে দেয় হ্রদের উপর। নানাবিধ উচ্চতায় সরোবরের জলের উপর ঘুরপাক করে, হ্যান্ডলারের হাতে ফিরে আসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঈগলের মতো ক্যামেরাটি ইয়োরগানের পায়ের কাছে এসে ল্যান্ড করে। সে তা থেকে মেমোরি কমপোনেন্টটি খুলে নিয়ে ডিজিটালি রিভিউ করে আমাদের দেখায়— দীর্ঘ ঘাসে লুকোচুরি করা হাঁস ও পর্যটকের নৌকার ছবি। তাতে এক্সাইটেড হয়ে ব্রিজিত বলে ওঠে, ‘চিয়ার্স হানি। উই অট টু সেলিব্রেট দিস। ’ ইয়োরগান তার দিকে চেয়ে ফূর্তিতে গেয়ে ওঠে,‘আই ওয়াজ মেড টু লাভিন ইউ…। ’
ব্রিজিত শ্যাম্পেনের বোতল আনতে শ্যালের দিকে গেলে, ইয়োরগান যেন সঙ্গোপনে কোনো সিক্রেট বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করছে এমন ভঙ্গিতে আমাকে বলে,‘প্লিজ ডু মি অ্যা ফেভার ম্যান। আমাদের স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করে তুমি সুন্দরবন ফরেস্টের কর্মকর্তার সাথে কথা বলে দেখো। ব্রিজিতের জন্মদিন আসছে। তার যতো বৎসর বয়স হয়েছে সে সংখ্যার সমান সংখ্যক হরিণ শিকার করতে পারলে কী যে খুশি হবে সে। আর সুন্দরবনের চিত্রল হরিণ শিকার করতে পারলে তার এক্সাইটমেন্ট হবে জাস্ট স্কাই-হাই। ’ আমি কৌতূহলবশত জানতে চাই,‘ব্রিজিতের বয়স এখন কত চলছে?’ ইয়োরগান সরাসরি জবাব না দিয়ে বলে,‘তিরিশের খানিক উপরে, তবে অবশ্যই চল্লিশের নিচে। ’ আমি কল্পনা করি, ‘প্রায় পঁয়ত্রিশটি চিত্রল হরিণকে স্রেফ খুন করার অভিপ্রায় জানিয়ে আমি সুন্দরবনের কনজাভেটরের সাথে কথা বলছি। আর তার ইশারায় বনের পাইক পেয়াদারা বিদেশীদের যোগসাজসে বন্যপ্রাণী ধ্বংসের চক্রান্তের অভিযোগে পিছমোড়া করে বেঁধে আমাকে হাজতে পুরছে। আমার কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে ইয়োরগান আবার বলে,‘ব্রিজিত শুধু শুধু হরিণ শুট করবে না, বিনিময়ে আমরাও সুন্দরবনের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে খুব সফিসটিকেটেড একটা জিনিস অফার করব। তারা চাইলে এ সারভিলিয়েন্স ক্যামেরার মালিকানা পেতে পারে। আমি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়ে দেব এটা দিয়ে কিভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। আর সুন্দরবনে হান্টিং এর এ পুরা এক্সপিডিশনটি হবে ব্রিজিতকে দেয়া আমার বার্থডে গিফ্ট। ’ শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে ব্রিজিত তার স্কিন টাইট প্যান্ট পরা নিম্নাঙ্গে টগবগে ঊর্মি তুলে ফিরে আসলে, আমি ইয়োরগানকে আস্তে করে বলি,‘লেট মি থিংক এবাউট দিস, একটু চিন্তা করে পরে আমি তোমাকে জানাব, টেক ইট ইজি ম্যান। ’
অরেঞ্জ জুসের সাথে শ্যাম্পেন মিশিয়ে ব্রিজিত মিমোজা বলে একটি ককটেল তৈরি করে। আমরা ব্রাঞ্চের ভূরিভোজনের সাথে তা পান করি। কথা হয় যে মেইড কার্লার বেবী সিটিং করবে। ইয়োরগান যাবে ফার্ম হাউসের দালান পেরিয়ে, খামারের ঈশান কোণে জার্সি গরুদের বাথান অতিক্রম করে গ্রাসল্যান্ডের দিকে। ওখানে লুক আউট টাওয়ারে উঠে তার ঝুল বারান্দা থেকে গেম রির্জাভের দিকে উড়াবে তার সার্ভিলিয়েন্স ক্যামেরা। দুপুরের দিকে হরিণ চরে তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও ব্রিজিত উইনচেস্টার রাইফেলটি নিয়ে ঢুকে পড়বে অভয়ারণ্যের অন্দর মহলে। মওকা পেলে সে শুট করবে একটি দুটি হরিণ। তবে দুপুরের আলোয় সে দেখে নিতে চায় বনানীর বিস্তার, কোথায় নরোম ঘাসের উর্বর ভূমি, আর কোন দিকে নুনি ও জলের ঝোরা?
লেবোমবা পাহাড় আমাকে আকর্ষণ করে। আমি ভাবি পায়ে চলা ট্রেইল ধরে চলে যাব ওদিকে। মানচিত্রে বড় বড় বোল্ডার, পুরোনো বৃক্ষ ও রকওয়ালকে কিভাবে নিশানা ধরে এগিয়ে গিয়ে একটি প্লাটোর উপর দাঁড়ালে দেখা যাবে নদীর রূপালি রেখা; ব্রিজিত আমাকে ব্যাখ্যা করে তা বুঝিয়ে দেয়। যদি বা পথ হারাই, অসুবিধা কিছু নেই, পাহাড়ের উপর থেকে পরিষ্কার দেখা যাবে মাবুদা ফার্মের লুক আউট টাওয়ার। মেইড তপ্ত কাপাচিনো পরিবেশন করলে, তা পান করে আমরা উঠে পড়ে রওয়ানা দেই যে যার পছন্দ মাফিক ট্রেইলের দিকে।
*মঈনুস সুলতানের ভ্রমণ কাহিনী ‘সোয়াজিল্যান্ড: রাজা প্রজা পর্যটক’ মেলায় আসছে। প্রথমা থেকে বইটি বের হবে
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৫