ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মাহবুব আজীজের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫
মাহবুব আজীজের একগুচ্ছ কবিতা

প্রতিপক্ষ

কেন পুড়িয়ে মারছো আমাকে তুমি?
আমি তো সামান্য মানুষ; বেঁচে-বর্তে
আছি কোনোমতে। আশৈশব চেনা ভূমি
কেন আজ লকলকে আগুনের আবর্তে?

কেন আমি তোমার প্রতিপক্ষ?
এদেশে জন্ম বলে! নিঃশ্বাস নিই কোনোরকম।


তোমরা তো দাবার ঘুটি চালে সুদক্ষণ।
আমি কেন আগুণে দগ্ধ-যখম!

নেকড়ের থাবায় দাহ করে দিলে সমস্ত;
কোথায় যাব? কার কাছে যাব? এই অবেলায়—
সামান্যে তুষ্ট হাসিমুখের মানুষগুলো আজ ধ্বস্ত।
পোড়া মাংসের গন্ধ আজ অসীমের সীমানায়।

আগুন! আগুন! বলে প্রিয় সব নদী কাঁপে থরথর।
দাবার চালে শুভবাদী মেঘও আজ নির্লিপ্ত পাথর।


মুহূর্ত

আমরা মুহূর্তের সত্যে বাঁচি; যদিও
এই কথা আমাদের মনেই থাকে না।

আমরা পিপীলিকার ছাত্র।
তিলতিল করে মুহূর্তাবলী খরচ করে
বানাই ভবিষ্যতের রাজহাঁস;
আমরা হাসি না; পাছে সময় নষ্ট হয় ভেবে।
আমরা ভালোবাসি না; কি লাভ হবে মেপে!

আমাদের সব-ই ভবিষ্যতের তহবিল।
তাই মুহূর্তকে উপভোগ আমরা করি না।
তসবিহদানার মতো ভবিষ্যৎ গুণতে গুণতে
একদিন দেখি ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ-ই রয়ে গেল!
ওটা আর কখনও বর্তমান হল না।

কবে কি হবে; হতে পারে ভেবে
এই মুহূর্তটিকে নষ্ট করার কোনো মানে নেই।

এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে চলো আমরা ভালোবাসি—
ভালোবাসাই একমাত্র সত্য, আর সব জলে ফেলি।



বিস্ময়

সময় তখন খুব বেশি হলে সকাল দশটা।
আমি তখন কিছুটা ক্লান্ত, বিরক্ত, হতাশা।
বাসস্টপ। চারদিকে মানুষের হৈ চৈ। চিৎকার-উল্লাস।
কেউ পান-সিগারেট খাচ্ছে। কেউ করছে তর্ক, কেউ ঠাট্টা।

হঠাৎ বাসস্টপে ঘটে যায় ছোট্ট ঘটনা—
সদ্য এক তরুণীর দিকে চোখ যায় সরল মুখ, কিছুটা কালো;
শরীরও তেমন সুবিধার নয়; বস্তুত তার চেহারা মোটে নয় ভালো।
যদি তাকে সুন্দরী বলি— হবে সে এক নিখাদ রটনা।

কিছু করছিল না। দাঁড়িয়ে ছিল; পোশাক নয় তেমন দামী;
তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিও মোহনীয় নয়; কপালে চূর্ণ চুল—
আসলে সে মোটেও স্মার্ট নয়—কাঁচুমাচু মুখে ঘামছে কুলকুল।
অথচ সাধারণ মেয়েটিকে দেখে পুরো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলাম যেন আমি।

কেন? মেয়েটির চোখ দেখে আমার মনে হয়—
ঐ চোখে খেলা করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিস্ময়।


দৃশ্যটিকে মনে রেখে

রাজধানীর উপকণ্ঠে গাদাগাদি ভিড়ের এক গলি।
৫ তলা বাসার ৩ তলায় ছোট্ট এক ঘরে
বারডেমফেরৎ বাবাকে নিয়ে এলাম।
ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।
ক্রিয়েটিনিন বাড়ছে ঝড়ের বেগে। ১৪, ১৬, ১৮....
নির্লিপ্ত কণ্ঠে তিনি বললেন—
‘আর কিছু করার নেই। তিনি মারা যাচ্ছেন। ’

মাকে জানাব কিভাবে এই খবর?
অন্য কোন ডাক্তারের কাছে যাব?
দিব ফোন বড়ভাইকে একবার?

বারডেম থেকে রিকশায় উঠে সেই
ছোট্ট ঘরের দিকে চললাম।
আমার রিকশা শাহবাগ থেকে শিশুপার্কের
সামনে দিয়ে পল্টন পার হয়ে ছুটলো।
আমার কি তখন স্রষ্টার কাছে নতজানু হওয়ার সময়?
ঈশ্বর, খোদা, আল্লাহ—বাঁচাও আমার পিতাকে?

আমি কারু কাছে কোনো প্রার্থনা না করে
রাতের নিঃসীম আকাশের দিকে সোজা ঊর্ধমুখ
তাকিয়ে রইলাম। রিকশা এগিয়ে চলে।
বাবা কোথায় চলে যাচ্ছে?
আর কোনোদিনও তার সংগে আমার দেখা হবে না?
তার কোনো সুবচন-ই কানে নিইনি কোনোদিন।
ইংরেজি আর অংকটা ভালো করে বুঝতে বলেছিলেন।
আমার ঐ দুটো বিষয়ের বইতে চিরকাল ধুলো জমেছে।
তাই বুঝি সবকিছুতেই আমার এতো শঙ্কা? এতো পরাজয়?
বাবা কোথায় চলে যাচ্ছে?
ঐ আকাশে? ঐ অন্ধকারে? ঐ নক্ষত্রদূরত্বে?
বাবা; ইংরেজি আর অংকটা এবার আমি শিখে নেব ঠিক।
৩০ বছর বয়সে এসব শেখা যায় না; না?
দূর ছাই; চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ে ক্যান?

মা জাপটে ধরলেন আমাকে। কাঁদলেন না।
৬৫ বছরের মা তখন প্রবল সাহসী।
মৃত্যুর সংগে পারলে একাই লড়ে যান।
বিস্ময় মানি, এতো শক্তি তার শরীরে কোথায় লুকিয়ে ছিল।
তিনি সব বুঝলেন। তবু বললেন—
‘ডাক্তাররা ভুল কইছে। ওরা জানে না। আমি জানি। ’

সারারাত আচ্ছন্নের মতো কাটে।
অস্পষ্ট সব স্বপ্ন...।
আমি তো আদর্শ দায়িত্বপরায়ণ সুপুত্র নই।
চিরকাল পলায়নপর হয়েই ছিলাম সংসারে—
কিন্তু বিদায়বেলায় একি অমোঘ অমোচ্য টা!

মাথার উপর থেকে অদৃশ্য আকাশ যেন চলে যাচ্ছে দূরে কোথায়।
বারবার ঘুম ভাঙে। মায়ের রোরুদ্দ্যমান কণ্ঠস্বর ও’ ঘর থেকে ভাসে।

তখন ভোরের আলো ফুটেছে।
আবছায়া বুঝি একেই বলে।
মা পাশের ঘর থেকে
আমার ডাকনাম ধরে চিৎকার করে উঠলেন।

আমি দৌঁড়ে যাই।
অচেতন বাবার পাশে দাঁড়িয়ে দেখি।
তার প্রেশারের কাটা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে
৭০-৬০-৫০-৪০-৩০-২০...
নেমে যাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে।
আমার সামান্য শিক্ষিত মা-ও সেটা বুঝতে পারছেন।
আমি দেখি, মায়ের পা দুটো থরথর করে কাঁপছে।
মৃত্যুর বিপরীতে লড়ে যাওয়া অসীম সাহসী যে মা’কে চিনি আমি
তিনি সেই মানুষটি নন।
তিনি ৫০ বছরের একান্ত সঙ্গীটিকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলতে
বসা নিঃসহায় চাতক পাখি যেন;
থরথর করে আমার মায়ের পা দু’টি কাঁপছে।
চিরবিচ্ছেদের এই দৃশ্য কেমন করে রচো বিধি!

প্রেশারের কাটা শূন্যে নেমে এল। বাবা মারা গেলেন।
মা বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আমাকে বললেন—
‘আমি কার কাছে থাকবো রে ....!’

কে আর কার কাছে থাকে?
আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তর।
তবুও সামান্য সময় আগে অভেদ্য আত্মাকে হারানো
জননীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি—
‘তুমি আমার কাছে থাকবে। ’

সেই থেকে মা তার স্বামীর ভিটায়। সুদুর মফস্বলে।
আমি নগরে। প্রাণপণে লড়ে চলেছি। সামান্য পা পিছলে গেলেই তোমাদের এই নগর
আমাকে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করবে।

বছরে ২দিনের বেশি মায়ের কাছে আমার যাওয়া হয় না।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।