১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
৩৬তম কিস্তির লিংক
___________________________________
হঠাৎ গোটা সড়ক জুড়ে এক ধরনের উত্তেজনা শুরু হল। চারিদিকে চিৎকার চ্যাঁচামেচি। মানুষগুলো খরগোশের মতো ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ছে দরজাপথ দিয়ে। উইনস্টনের ঠিক সামনে দিয়ে এক যুবতী লাফিয়ে পড়লো সড়কের ওপর, দ্রুত কোলে তুলে নিলো কাদায় মাখামাখি হয়ে খেলায় রত শিশুটিরে। অ্যাপ্রনের ভেতরে দ্রুত লুকিয়ে ফের লাফ দিয়ে ঢুকে পড়লো দরজা পথে। চোখের পলকেই যেনো ঘটে গেলো সবটুকু। কনসার্টিনার মতো দেখতো কালো স্যুট পরা এক লোক পাশের গলি থেকে রেরিয়ে উপরপানে উত্তেজিত দৃষ্টি ফেলে উইনস্টনের দিকেই ছুটে আসছিলো। আর ‘স্টিমার! স্টিমার!’ বলে চিৎকার করছিলো।
উইনস্টনকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘দেখো গাভ’নার! মাথার উপরে ধামাকা! শুয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি!’
রকেট বোমাকে কি কারণেই যেনো লোকে ‘স্টিমার’ বলে। ধপাস করে মুখগুজে শুয়ে পড়লো উইনস্টন। এসব ক্ষেত্রে প্রোলদের আশঙ্কাই ফলে যায়। মনে হয় ওদের যেনো কোনও এক অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে যা দিয়ে অন্তত কয়েক সেকেন্ড আগেই ধরে ফেলে রকেট বোমা আসছে। শব্দের গতির চেয়ে রকেট দ্রুত গতিতে ছোটে তারপরেও। হাতদুটো দিয়ে যতটা সম্ভব মাথা ঢেকে রেখেছে উইনস্টন। বিকট শব্দে কিছু একটা ফুটপাতে ঝাঁকি তুললো। তার পিঠের ওপর আঘাত হেনে আছড়ে পড়ছে কতকিছু। যখন উঠে দাঁড়ালো দেখলো কাছের একটি জানালার কাচের ভাঙা ভাঙা টুকরো তার সারা গা থেকে ঝড়ে পড়ছে।
হাঁটতে শুরু করলো উইনস্টন। বোমাটি পড়েছে সড়ক থেকে ২০০ মিটার দূরে। সেখানে বেশকিছু ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কালো একটা ধোঁয়ার কু-লি আকাশে উঠে পড়েছে, আর তার নিচ দিয়ে আস্তর কণাগুলো মেঘসদৃশ হয়ে উড়ছে। ততক্ষণে ধ্বংসাবশেষের ওপর ভীড় জমে গেছে মানুষের। তার সামনে ফুটপাতের ওপরই স্তুপ হয়ে পড়ে আছে এক গাদা পলেস্তারা, যার ঠিক মাঝখানে চোখে পড়লো কড়া লাল একটা কিছু। কাছাকাছি গিয়ে দেখলো ওটি উড়ে আসা একটি হাত, কবজির কাছে কেটে রক্ত ধরছে। ওই অংশটুকু ছাড়া হাতের বাকি অংশ আস্তরের ধুলো জমে সাদা হয়ে আছে।
লাথি দিয়ে ওটি নর্দমার ভেতর ছুঁড়ে দিলো সে, এরপর ভিড় এড়িয়ে ডান দিকের একটি পার্শ্বসড়কে ঢুকে পড়লো। তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে বোমাবিধ্বস্ত এলাকা থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলো, আর ওই সড়কের নোংরা ঘিনঘিনে জীবন আবারও স্বাভাবিক গতিতে চলতে লাগলো, যেনো কিছুই হয়নি। তখন প্রায় আটটা বাজে, মদের দোকানগুলো (ওরা বলে পাব), প্রোলরা যেখানে ঘন-ঘনই যায়, ক্রেতায় ভরে উঠলো। এর নোংরা নড়বড়ে দরজাগুলো অবিরাম খুলছে-বন্ধ হচ্ছে, ভক ভক করে ছুটে আসছে প্রসাব, কাঠের গুঁড়া আর টক বিয়ারের মিলিত গন্ধ। কৌনিকভাবে তৈরি একটি বাড়ির সামনে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে তিনজন। মাঝের জন হাতে একটি ভাজ করা খবরের কাগজ ধরে আছে আর দু’পাশের দুজন তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে চোখ ফেলে পড়ছে। মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাবে এমন দূরত্বে পৌঁছার আগেই, উইনস্টন ওদের নিমগ্নতা বুঝে ফেললো। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কোনও খবর তারা পড়ছে। তখনও কিছুটা দূরে, ঠিক তখনই তাদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেলো এবং দুজনের মধ্যে ভয়ানক তর্কাতর্কি শুরু হলো। অবস্থা এতটাই সঙ্গীণ হয়ে উঠলো যে মনে হচ্ছিলো যেকোনো মূহ’র্তেই একজন অন্যজনকে ঘুষি বসিয়ে দেবে।
‘তোমার কানে যায়, আমি কি বলছি? বলছি, গত চৌদ্দ মাসে বিজয়ী হয়েছে এমন একটি নাম্বারও সাত দিয়ে শেষ হয়নি!’
‘হ্যাঁ কানে যায়! তো কি হয়েছে!’
‘আমি বলছি ছিলো না! আমার সঙ্গে বাড়ি চলো, দেখবে গত দুই বছরের সবগুলো নাম্বার একটা কাগজে লিখে রেখেছি। ঘড়ির হিসাবে নিয়ম করে লিখেছি। আর আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি, একটা নাম্বারও সাত দিয়ে শেষ হয়নি-’
‘আরে, সাত জিতেছে! আমিও মোটামুটি নিশ্চিত করছি তোমাকে। চার কিংবা সাতেই শেষ হয়েছে নাম্বারটি। গত ফেব্রুয়ারিতে- ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে। ’
‘ফেব্রুয়ারি না তোমার দাদী!, সবগুলো কাগজে-কলমে হিসাব রেখেছি। তোমাকে বলছি- একটি নাম্বারও...’
‘আরে থামো তো তোমরা!’ এবার কথা বললো তৃতীয় জন।
এই ঝগড়ার বিষয় লটারি। ওদের ছাড়িয়ে প্রায় ত্রিশ মিটারের মতো পার হয়ে পেছনো তাকালো উইনস্টন। তখনো তর্ক চলছে, একই তীব্র-তারস্বরে। লটারির পুরস্কার ঘোষণা হয় প্রতি সপ্তায়, এ নিয়ে প্রোলদের মধ্যে আগ্রহ ভীষণ। মিলিয়ন মিলিয়ন প্রোল হবে, যারা তাদের বেঁচে থাকার উপজীব্য হিসেবে এই লটারিকেই বেছে নিয়েছে। এতেই তাদের হর্ষ, এতেই বিষাদ, এতেই মূঢ়তা, এতেই মুগ্ধতা, এতেই সান্ত¡না, এতেই উদ্দীপনা। বিষয় যখন লটারি, তখন অতি অশিক্ষিত মানুষটি, যে পড়তে লিখতে পর্যন্ত জানে না, সেও পাক্কা হিসাবি, বিষ্ময়কর স্মৃতিশক্তির ধারক। একটি বিশাল গোষ্ঠী স্রেফ এই লটারির সিস্টেম, ভাগ্যগণনা, আর ভাগ্যকবচ বেচেই বেঁচে আছে। এই লটারির সঙ্গে উইনস্টনের কোনো যোগসাজশ নেই, ওটা প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় দেখে। তবে সে জানে (পার্টির সবাই জানে) পুরস্কার জেতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও কাল্পনিক নাম্বার। ছোট ছোট অংকের পুরস্কারগুলো হয়তো কেউ কেউ পায়, বড় পুরস্কারের বিজয়ীদের কেউ চেনে না। আসলে তাদের কোনও অস্তিত্বই নেই। ওশেনিয়ার একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের কোন বাস্তবিক আন্তঃযোগাযোগ না থাকায় বিষয়টি নিশ্চিত করা কঠিনও কিছু নয়।
৩৮তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময় ১১০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (৩৭) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।