ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঢাকার গ্যুন্টার গ্রাস | নাসির আলী মামুন

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
ঢাকার গ্যুন্টার গ্রাস | নাসির আলী মামুন ছবি: নাসির আলী মামুন

ঢাকা ও কলকাতার সঙ্গে গ্যুন্টার গ্রাসের একটা বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রথমবার কলকাতা আসার পর তিনি ঢাকায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিলেন গ্যুন্টার গ্রাস। তার কলকাতা সফরের সময়—সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, কাউকেই অ্যালাউ করছিলেন না। ঢাকা সফরও—প্রেস, প্রচারণার বাইরে থেকে করতে চেয়েছিলেন। ঢাকার গ্যাটে ইনস্টিটিউটকে তিনি সেরকম ব্যবস্থা করার কথাই জানান। গ্যাটে ইনস্টিটিউটের পিটার জেবিস—গুন্টার গ্রাসের ঢাকা সফরের সমন্বয়ক ছিলেন। জেবিন বহুবছর ধরে এদেশে বসবাসের ফলে ঢাকার শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা রাখতেন, ছিলেন সহৃদয়। তার ইচ্ছা ছিল গ্যুন্টার গ্রাসের এই সফরের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে রাখার। তিনি এ সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। ফলে খুব গোপনেই কবি বেলাল চৌধুরী এবং আমাকে জানান গ্রাসের সঙ্গী হওয়ার জন্য। বেলাল চৌধুরী যেহেতু অনেকদিন কলকাতায় ছিলেন এবং ইংরেজি ভালো জানেন—গ্যুন্টার গ্রাসের সাহিত্য সম্পর্কে জানা-শোনা। তাই বেলাল চৌধুরীই ছিলেন উপযুক্ত লোক, সঙ্গে ছবি তোলার জন্য আমাকে নির্বাচন করা হয়। সময়টা ছিল ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাস।

সেদিন গ্যুন্টার গ্রাসকে বহন করা বিমান ঢাকায় এসে পৌঁছায় বিকাল নাগাদ। আমরা বেশ ক’জন এয়ারপোর্টে তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হই। গ্যাটে ইনস্টিটিউটের একটি মাইক্রো বাসে করে আমি, কবি বেলাল চৌধুরী, কবি রবিউল হুসাইন, কবি ত্রিদিব দস্তিদার, কবি রফিক আজাদ উপস্থিত হই। এছাড়া আসেন আহমদ ছফা, তিনি খবর পেয়ে একাই আসেন। তাকে দেখতে পেয়ে প্রায় ৩০ ফুট দূর থেকে ছবি তুলে আমি ক্যামেরা লুকিয়ে ফেলি। যদি বিরক্ত হন! তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী উইটেগার। পরে যখন সবাই ফুল দিয়ে তাকে বরণ করে, তখন ক্যামেরা বের করে ছবি তুললেও তিনি কিছু বলেন না।

সে সময় ধানমন্ডি ২৮-এ ফোর্ট ফাউন্ডেশনের একটি রেস্ট হাউস ছিল। সেখানে তিনি ওঠেন। সেখানেই ওঠার কারণ—যাতে মানুষজন, মানে কবি-লেখকরা তার ঢাকায় আসবার খবর জানতে না পারে। ওই রেস্ট হাউসটা কবি-লেখকদের খুব একটা গোচরে ছিল না।
   
যাহোক, পরদিন সকালে ধানমন্ডি থেকে রিক্সায় রওনা দিই। গ্যুন্টার গ্রাস ও তার স্ত্রী এক রিক্সায়, বেলাল চৌধুরী আর আমি আরেক রিক্সায়; গন্তব্য লালবাগ কেল্লা। ঢাকায় আসার আগেই তিনি লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে, ঢাকা সম্পর্কে স্টাডি করেই আসেন। লালবাগ কেল্লার পৌঁছে, সেখানকার সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকেন। দেয়ালের কারুকাজ, এর নির্মাণ, এমনকি দেয়ালের চিকা মারাও। আর দেয়ালের অবাঞ্চিত লেখার অর্থ বেলাল চৌধুরীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে হো হো করে হেসে ওঠেন।

তার সঙ্গে একটা ঝোলাতে স্কেচ করার কাগজ, কলম পেন্সিল থাকত। যখন যেটা আঁকার প্রয়োজন হতো, তিনি এঁকে নিতেন। আমি তার ছবি তুলে যাচ্ছিলাম। তখন আমার একটিমাত্র রঙির ক্যামেরা, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আর ছবি ওঠানোর ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা ছিল অনেকটা অদৃশ্য মানুষের মত। যাতে ছবি তোলা তার জন্য কোনও প্রকার বিরক্তির কারণ না হয়।

গ্যুন্টার গ্রাস ঢাকার অনেক স্থানই ঘুরে দেখেন। এর মধ্যে পুরান ঢাকা, বুড়িগঙ্গা, বিহারি ক্যাম্প ইত্যাদি ছিল। বিহারি ক্যাম্প নিয়ে তার একটি ভুল ধারণা তৈরি হয়। ঢাকায় আসার আগেই তিনি—বিহারিদের এখানকার বসবাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে আসেন। তিনি বিহারি ক্যাম্প ঘুরে তাদের জীবন-যাপন দেখে কষ্ট পান। তাকে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি, এখন যাদের ৪৫/৫০ বছরের দেখছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল তরুণ এবং অনেক বাঙালি হত্যা করেছে, এমনকি এখনও বাংলাদেশকে স্বীকার করে না।

তিনি সফর শেষ করে ফিরে গিয়ে অনেকদিন পর্যন্ত ক্যাম্পের একটা স্কুলকে অর্থ সাহায্য দিতেন। শেষে তা বন্ধ করে দেন, কেননা ততদিনে তার মোহভঙ্গ ঘটে। ২০০৫ সালে কলকাতা সফরে এসে তিনি এক বক্তৃতায় বলেন, তিনি একটা স্কুলকে অর্থ-সাহায্য দিতেন, যে অর্থ স্কুলে নয়, জঙ্গী কাজে ব্যবহার হতো।

আমাদের জন্য তার ঢাকা সফর ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাংলাদেশ এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য তার এই ভ্রমণ বহুদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার



বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫

** চলে গেলেন গুন্টার গ্রাস
**গুন্টার গ্রাসের জীবন ও কর্ম
**গুন্টার গ্রাসের জীবন ও কর্ম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।