ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গুল্লি | কিঙ্কর আহ্সান

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৫
গুল্লি | কিঙ্কর আহ্সান

বোমায় উড়ে গেছে বাড়িটির এক অংশ।
গোলাগুলি চলছে সমানে।

ব্যবহার করা হচ্ছে রিভলবার, কাটা রাইফেল ও মেশিনগান। হকিস্টিক আর ক্রিকেটের ব্যাট কারও কারও হাতে। অনেকগুলো মটরসাইকেল নিয়ে এসেছে গুণ্ডারা। মটর সাইকেলের ভ্রউউম, ভ্রুউউম আওয়াজে কানে তালা লাগার যোগাড়।

‘বাঁচাওওও। হেল্প মিইই’ বলে চিৎকার করছে নায়িকা। নায়িকার কষ্ট দেখে হা, হা, হা করে হেসে উঠল প্রধান ভিলেন কবিল। বলল, ‘সুন্দরী তুই এখন আমার। কোথায় তোর লাভার? কেউ আর বাঁচাতে পারবে না তোকে। হা হা হা। ’

‘না। আমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে এই আকাশ, বাতাস, সূর্যকে সাক্ষী রেখে বলছি আমাকে বাঁচাতে আমার ভালোবাসার মানুষ আসবেই। আসবে। ’ চিৎকার করে বলে নায়িকা। ভিলেন তার কথায় কান দেয় না। ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে কাপড়ের কিছু অংশ। নায়িকা কাঁদে—ভিলেন কবিল তার ইজ্জত নষ্ট করে দেবে এই ভয়ে। নায়িকার পরনে ওপরের দিকে ব্লাউজের মতন রঙচঙে কিছু একটা আর নিচে হাফপ্যান্ট। নাভি চোখে পড়ে। চোখে পড়ে কোমরের মেদ। দর্শক মোটা নায়িকা পছন্দ করে। এই নায়িকা যথেষ্ট মোটা। প্রযোজকদের কাছে তার চাহিদা খুব। মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে প্রতিটি ছবির জন্য। যৌবন চিরদিনের জন্য নয়। এখনই তার কামানোর সময়।

উঁচু একটা দালানের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামে নায়ক ইজাজ খান। উঁচু থেকে নেমে মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে কেঁপে ওঠে চারপাশ। জোরে হাওয়া বইতে থাকে। ভিলেন কবিল ভয় পায়। চিৎকার করে ‘অ্যাটাক’ বলার সাথে সব গুণ্ডারা দৌড়ে যায় নায়কের দিকে।

নায়কের হাতে রামদা। সে সেই রামদা ঘুরাতে থাকে। আঘাত করে একেক জনকে। কারও কবজি উড়ে যায়, কারও আস্ত হাত। ইয়া ঢিশুম, ঢিশুম বলে নায়ক মারতে থাকে গুণ্ডাদের। কবিল গুলি চালায় নায়কের দিকে। নায়কের কাঁধে লাগে।

‘নাআআআ’... বলে চিৎকার করে নায়িকা। নায়ক পড়ে যায় মাটিতে। রক্তে ভেসে যায় চারপাশ। কবিল হাসতে থাকে। নায়িকার গালে চুমু খেতে যায়। এমন সময় আবার লাফ দিয়ে ওঠে নায়ক। কাছে থাকা রামদাটা ছুঁড়ে মারে কবিলের দিকে। রামদার আঘাতে পুরো মাথাটা আলাদা হয়ে যায়। তারপর নায়িকার কাছে যায় নায়ক। হাতের বাঁধন খোলা হয়। নায়িকা ঝাপিয়ে পড়ে নায়কের লোমশ বুকে। নায়িকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নায়ক ইজাজ খান বলে, ‘আমার সাথে লাগতে এলে গুল্লি মেরে খুল্লি উড়িয়ে দেবো। হুম। ’ সাথে সাথে কাট বলে চিৎকার করে পরিচালক।

তালি পড়ে। পরিচালকের মুখে হাসি। এত বড় শট ওকে হয়ে গেল এক টেকে। এনজি শট নেই। শান্তি। দুশ্চিন্তা কাটে পরিচালকের। লাঞ্চ ব্রেক দেয়। ককশিট, ট্রলি, বেবি, সোলার লাইটগুলো নিয়ে রাখা হয় এফডিসির দুই নম্বর ফ্লোরে। সেট ঠিকঠাক করতে লেগে যায় একদল লোক। খাবারের জন্য দৌড়ায় প্রোডাকশন বয়।

রন্টু সব দেখে। এফডিসিতে সে পড়ে আছে আজ মাস দুই হলো। বাবলু নামের এক দালালকে তিনশ টাকা দিয়ে এখানে ঢোকার অনুমতিপত্র পেয়েছে। প্রথমে সে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াত। শুটিং দেখত। সে সিনেমা পাগল। সিনেমার সাথে জড়িত যে কোনও কিছুই তার দেখতে ভালো লাগে। কিভাবে নায়ক পেটায়, কিভাবে আউটডোরে সূর্যের আলো বুঝে ককশিট, রিফ্লেক্টর ব্যবহার করা হয়, কেন ক্যামেরার লেন্স বদলানো হয়, কিভাবে নকল পিস্তল থেকে গুলি ছোটে, কিভাবে রক্ত গড়িয়ে পড়ে শরীর থেকে, কিভাবে মেকআপ দিয়ে চেহারা বদলানো হয়, উইগ পড়ানো হয়—সব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করত রন্টু।

মেকআপম্যান শরীফের একজন অ্যাসিসটেন্টের দরকার ছিল। রন্টুকে একদিন কাজের সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পছন্দ হয়ে যায় শরীফের। ছেলের চেহারা ভালো। নায়কমার্কা চেহারা। গায়ের রং ফর্সা। হাইট ভালো। শুধু বয়স কম। একদম কচি মুখ। লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকলে একদিন নায়ক হয়ে যেতে পারে কিংবা সাইড নায়ক। কপালের কথা তো বলা যায় না!

রন্টু শরীফের হয়ে কাজ করে। মেকআপের টুকিটাকি কাজ শিখে নেয়। বেশিরভাগ সময়েই বসে থাকতে হয়।

প্রচণ্ড শীত। নায়িকা ছোট কাপড় পড়ে আছে। রন্টু তাকে গরম কাপড় দেয়। এই নায়িকার কাপড় পরায় বড়ই অনীহা। অভিনয়ের জন্যে তার খোলামেলা হতে আপত্তি নেই একথা বলে এর মাঝেই মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছে নতুন নায়িকা মিসিতা। তার দেমাগ দেখার মতন!

রন্টুকে মিসিতা পছন্দ করে। চেহারা ভালো লোকজন তার পছন্দের। সুন্দর কিছু পাশে থাকলে মন ভালো থাকে। রন্টুর বয়স কম। কম বয়সী ছেলের সামনে লজ্জা নেই। মিশিতা কাপড় বদলানো থেকে বগল-নাকের লোম সাফ করা সব রন্টুর সামনেই করে। ছেলের লোভ আছে তবে ভীতু। মেয়েরা চোখ দেখেই সব বোঝে। রন্টু তাই নিরাপদ।

নায়ক ইজাজ খান এসে ঢোকে নায়িকার ড্রেসিং রুমে। একসাথে খাবে। তারা মেপে মেপে খায়। শরীরের খেয়াল রাখতে হয়। সকালে দুটো পরোটা, সুজির হালুয়া, ডাল আর কমলার জুস। দুপুরে বেশি খাওয়া হয়। এফডিসির খাবারের অনেক সুনাম। কালা ভুনা, দশ-বারো রকমের ভর্তা, কবুতরের মাংস আর ডাবের পানি এই হলো নায়কের খাবার। মিশিতাও খায়। শরীর মোটা রাখতে হয়। কোমরের ভাঁজ দেখে সিনেমা হলে, নইলে দর্শকদের শিস দিতে শোনা যায় না।

মিশিতা আর ইজাজ খান যখন খায় তখন দরজার বাইরে দাড়িয়ে পাহারা দেয় রন্টু। এসময় কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে না। আদর-সোহাগের পর্ব চলে। রন্টু ইজাজ খানের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে। তার কল্পনা শক্তি প্রবল। রন্টুর নায়ক হবার ইচ্ছে। ভিলেনের কলার ধরে বলার ইচ্ছে, ‘লাগতে এলে গুল্লি মেরে খুল্লি উড়িয়ে দেবো। হুম। ’ একদিন না একদিন সে অভিনয় করবেই। ওস্তাদ শরীফ বলেছে তাকে সুযোগ করে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে সে আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। তার কথা পরিচালক ফেলতে পারবে না। প্রথমে নায়কের পেছনের সারিতে কোথাও দাঁড়াতে হবে।

নায়কের একদম আশেপাশে সুন্দর চেহারার কারও দাঁড়াবার নিয়ম নেই। যোগ্যতা থাকলে রন্টু ভিড়ের মাঝে থেকেও একদিন নিজের জাত চিনিয়ে দেবে। নায়ক হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এত সহজে সবকিছু হয় না। ইজাজ খানেরও হয়নি। এইসব উঠে আসার গল্প আর স্বপ্ন রন্টুকে আশাবাদী করে তোলে। রন্টু সেই একদিনের জন্য আশাবাদী হয়ে ওঠে। ঢিশুম, ঢুশুম প্র্যাকটিস চালিয়ে যায়। নিজের ঘরে হিরো, হিরোইনের পোস্টার টানিয়ে রাখে। মানিব্যাগে থাকে ভিউকার্ড। আয়নার সামনে দাড়িয়ে অভিনয় করে। চাইনিজ মোবাইলটায় এমপি ফোর গান থাকে। গানের দৃশ্য দেখে একটু আধটু নাচের চেষ্টাও চলে।

মাস শেষে হাজার দুই টাকা তার হাতে তুলে দেয় ওস্তাদ শরীফ। কৃতজ্ঞতায় মাথা নিচু হয়ে আসে রন্টুর। না হলেও চলত এমন ভাব করে টাকাটা নেয় সে। আসা-যাওয়া, খাওয়া এসবের খরচ উঠে আসে। শুটিং প্যাকআপ হবারও অনেক পরে বাসায় ফেরে রন্টু। বাসা তার ভালো লাগে না। সিনেমার এই রঙিন জগতই তার ভালোলাগার, ভলোবাসার জায়গা। এখানেই শান্তি। বাসায় যত কষ্ট।

মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা হয়ে আরও ভেতরে তার বাড়ি। বাবার ফার্নিচারের দোকান ছিল। কাঠের কাজ করত। তার দাদার সময় এই ব্যবসা জমজমাট ছিল। সে সময় সাড়ে তিন শতাংশ জমি কিনে রাখা হয় বসিলায়। জমির দাম কম ছিল তখন। এদিকটায় কেউ আসত না। অপরাধীদের আখড়া ছিল এলাকা। জমির দাম এরপর হু হু করে বাড়তে থাকে। রন্টুর বাবা আর তার একমাত্র ভাই বাবার ব্যবসা নিয়ে খুব একটা এগোতে পারেনি। লসের পরে লস। দুই ভাইয়ের বিয়ের পরপরই বিবাদ শুরু হয়। হাতাহাতি হয়। জমিজমার ভাগ নিয়ে লড়াই হয়। রন্টুর চাচীর বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। বিয়ের পর যে টাকা পায় রন্টুর চাচা তাই দিয়ে পুরো জমিটা কিনে নেয় সে। নগদ টাকার লোভ সামলাতে পারেনি রন্টুর বাবা। জমিটা ছেড়ে দিয়ে নতুন স্বপ্ন নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন রন্টুর বাবা। মাথায় ব্যবসার ভূত। না বুঝেই অনেকগুলো টাকা খাটানো। ব্যবসা বন্ধ হয় অল্প কিছুদিনের ভেতরেই। রন্টুর বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে দিন কাটায়। রন্টু পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তার পড়তে ভালো লাগে না। সিনেমা টানে। পরিবারের দায়িত্ব নিতে ভালো লাগে না। মায়ের কান্না, বাবার অসুস্থতা বিরক্ত লাগে।

তার চাচা ধনী হয়ে ওঠে। সচিবালয়ে চাকরি হয়। গাড়ির ড্রাইভার। অনেক ফাঁকফোকর। এদিক ওদিক দিয়ে টাকা আসতে থাকে। বসিলায় বাড়ি করে ভাড়া দেয়। টাকার কমতি নেই। তার ছেলেমেয়েগুলোও মানুষ হয়।

রন্টুর বড় ভাই সংসার দেখে। কাপড় সেলাই করে তার মা কিছু আয় করে। বড় ভাই বাড়িতে বাড়িতে নেটের লাইন পৌঁছায়। ব্রডব্যান্ড নেট। এ দিয়ে খুব একটা আয় হয় না। কিভাবে বাড়তি টাকা রন্টুর বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আসে তা বুঝে উঠতে পারে না সে। টাকা আয় করা এতই সহজ?

বাবার চিকিৎসা বন্ধ। পরে রন্টুর বড় ভাই মনে করল এই বিলাসিতার মানে নেই। চিকিৎসা করে লাভ হবে না। আজকাল আর চিকিৎসা হয় না। বাড়ির কাছে হোমিওপ্যাথের ডাক্তার আছে। অবস্থা বেশি খারাপ হলে সেখানে যায় রন্টুর মা। স্বামীকে এখনও ভালোবাসে সে। স্বামী সুস্থ হোক এটা চায়। দুই ছেলে যাতে বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এজন্য গজগজ করে। মাসশেষে সংসার চালানোর টাকায় কম পড়লে চাচার কাছে যেতে হয়। রন্টু যায়। চাচা তাকে অপমান করে। বাঁকা বাঁকা কথা বলে। তবে সাহায্য যে করে না তা নয়। মাঝে মাঝে টাকা দেয় কিছু।

বসিলায় টায়ারের গন্ধ। দম বন্ধ হয়ে আসে। শীত পড়েছে জাকিয়ে। কাল সিনেমা হলে যাওয়া হবে। এক টিকেটে দুই ছবি। শেষের ছবিটা আপত্তিকর ইংরেজি ছবি। বাজে দৃশ্য থাকে খুব। এই ছবিটায় ভিড় হয় বেশি। দর্শক আগ্রহ নিয়ে পুরো ছবি দেখে। পারলে চোখ, মাথা, মুখ পুরো দেহ অতি আগ্রহের কারণে স্ক্রিনের ভেতর ঢুকে যায়। এসবও একদম মন্দ লাগে না রন্টুর।

বাড়ি ফেরে রন্টু। বাড়িতে তালা দেওয়া। বড় ভাইকে কল দেওয়া হয়। রিং হয়। ফোন ধরে না কেউ। বসিলায় ছোট্ট একটা টিনের বাড়ি ভাড়া করে থাকে তারা।

রন্টু চিন্তায় পড়ে যায়। মায়ের কোনও খবর নেই। বাবাও নেই। পাশের বাড়ি থেকে জানা যায় রন্টুর বাবার অবস্থা খুব খারাপ। রন্টু আসার কিছুক্ষণ আগে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আজ দুপুরের পর আচমকা খাট থেকে পড়ে জ্ঞান হারায় রন্টুর বাবা। মুখ থেকে ফেনা বের হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। রন্টুর মা কয়েকজন প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে নিয়ে যায় লোকটাকে। রন্টুর বড় ভাইকে জানানো হয়। রন্টুকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি কেউ। রন্টু তার পরিবারে এত প্রয়োজনীয় কেউ না।

ভাই মোবাইল ধরছে না। হয়ত ব্যস্ত এই মুহূর্তে বাবাকে নিয়ে। রন্টু দ্রুত ছুটে যায় হাসপাতালে। হাসপাতাল কাছেই। গিয়ে জানতে পারে বাবা তার ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেন্টারে আছে। মা কাঁদছে। বড় ভাই মন ভার করে হাটছে হাসপাতালের করিডরে। চোখ ঝাপসা তার জলে। বাবাটা তাদের খারাপ না। পরাজিত একজন মানুষ সন্দেহ নেই তাতে কিন্তু তাদের প্রতি ভালোবাসায় কোনওদিন কমতি রাখেনি। যখন যা চেয়েছে তা দিতে পারেনি কিন্তু সুযোগ পেলেই বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরে ফার্নিচার পরে থাকলেও মায়া লাগে আর এ তো বাবা!

রন্টু গিয়ে বড় ভাইয়ের পাশে দাড়ায়। বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়।
‘অবস্থা ভালো না। টিকব না মনে হয় আর। কিডনি নাই। ’ রন্টুর ভাই বলে।
‘হুশ আছে?’
‘নাই। টাকা লাগব। কাইলকার মাঝে। ’ মাথা নিচু করে বলে রন্টুর ভাই। তাকে খুব অসহায় মনে হয়।
‘কী করবা?’
‘আমি বাড়তি টাকা কই দিয়া আনি জানস?’
‘না। ’
‘নেটের বিজনেস। নেটের লাইন দেই ঘরে ঘরে। একদিনে যেই লাইন দেওয়া যায় অইটা দেই সাত দিনে। বাড়িতে কয়জন লোক দেখি। খোঁজখবর নেই—কে কখন বাইরে যায়, ঘরে আসে। তারপর সুযোগ বুইজা তিন জনের টিম লইয়া ডাকাতি করি। টাকা আসে অইখান দিয়া। ’

রন্টু তার ভাইয়ের কথা অবাক হয়ে শোনে। সিনেমার মতন মনে হয় সবকিছু। এই নিয়া ছবি বানাইলে হিট হইত। সুপারহিট। ব্লাকেও টিকেট পাওয়া যেত না। শুধু নায়িকা মিসিতাকে নিতে হতো।

‘টাকা কামান সহজ নারে ভাই। কষ্ট আছে। এক এলাকায় বেশি ডাকাতি করন যায় না। রিস্ক। বিনিয়োগ লাগে। মেশিন কিনতে হয়। ছুরি ছারা দিয়া হয় না। ’

‘এই কতা এহন ক্যান?’ বাবার অসুস্থতার সময় রন্টুর বড় ভাইয়ের মুখে এ কথা ভালো লাগে না।

‘চাচার বাড়ির নেট নষ্ট এই অজুহাত নিয়া লাইন ঠিক করতে যামু তুই আর আমি। চাচার আলমারিতে অনেক টাকা। বাবার চিকিৎসায় কাজে লাগবে। বাবার জন্য করলে তোর পাপ হবো না। যহন যামু তহন বাড়িতে খালি চাচাই থাকব। ’ কথাটা বলে রন্টুর বড় ভাই সিগারেট খাবার জন্য হাসপাতালের কাছের দোকানটায় যায়। রন্টু বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকে।

কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। কাছেই কোনও এক বেডের কোন এক রোগী মারা গেছে। তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কাছের মানুষরা। কি কষ্ট। বাবাকে বাঁচাতে হবে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে রন্টু বাবাকে বাঁচাবে। সিনেমার নায়করা তো তাই করে, তাই না?

২.
নায়ক হবার স্বপ্ন পূরণ হবে না রন্টুর। হাতে তাদের সর্বমোট সাতশ একান্ন টাকা আর পাঁচশো টাকার দুইটা প্রাইজবন্ড। দুই ভাই পালাচ্ছে। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। শীতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে পৃথিবীর শরীর। চাঁদের আলোর আঁচল আর কুয়াশার মাঝ থেকে দুই হাত দূরের কাউকেও ঠাওর করা যায় না। পালাতে সুবিধা হয়। রন্টু আর বড় ভাই পালায়। অন্ধকারের ভেতর, কুয়াশার ভেতর।

পেছনে মানুষের আওয়াজ শোনা যায়। ধরতে পারলেই গণধোলাই নইলে পাঠানো হবে জেলে। চাচাকে মারার পর পালানো গেল না সময়মতন। গলায় ছুরি বসানোর সময় চিৎকার করে লোক জড়ো করার চেষ্টা করেছে লোকটা। ছুরি রন্টুই চালিয়েছে। গলায় পোচ দেবার সময় বলেছে নায়কের মতন, ‘লাগতে আসবি না। এলে গুল্লি মেরে খুল্লি উড়িয়ে দেবো। ’ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি!

এসময় ভাই আলমারি ভেঙেছে। ভেঙে হতাশ হয়েছে। লাখ লাখ টাকার বদলে পাওয়া গেছে অল্প কিছু টাকা আর প্রাইজবন্ড।

রন্টু দৌড়ায়। বড় ভাই কই খেয়াল নেই। কুয়াশার ভেতর পথ না বুঝেই দৌড়ায়। নায়ক হওয়ার স্বপ্ন ভাঙল বলে এই মুহূর্তে তার একটু মন খারাপ। বাবাকে বাঁচানোও হলো না। আফসোস।

কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে মাঝে মাঝে চাঁদটা উকি দেয়। লুকোচুরি খেলা। চাঁদের দুধসাদা আলো দেখে মিসিতার কথা মনে পড়ে। কি সুন্দর গায়ের রং। কি সুন্দর শরীর। নরম, পেলব। মিসিতার জন্য রন্টুর মন উচাটন হয়। দৌড়াতে দৌড়াতে কান্না আসে।
সে কি মিসিতাকে ভালোবাসে?
হুম, বাসে।



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।