ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রক্তকরবীর মুক্তিকামী রবীন্দ্রনাথ | ফজলুল হক সৈকত

রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৮ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৫
রক্তকরবীর মুক্তিকামী রবীন্দ্রনাথ | ফজলুল হক সৈকত

এ বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শত বছর আর মৃত্যুর সত্তরতম বছর পালিত হচ্ছে সারাবিশ্বে। রবীন্দ্রনাথের নানান রূপ।

কবি-গীতিকার-কথাশিল্পী-নাট্যকার-প্রবন্ধিক—এসব পরিচয় তো সকলের জানা। আর ভ্রমণসাহিত্য, শিশুতোষরচনায়ও তাঁর খ্যাতির ছবি আমাদের চোখের সামনেই দৃশ্যমান। এছাড়া রয়েছে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের পরিণত প্রকাশ (৬৭ বছর বয়সে ছবি আঁকতে আরম্ভ করেছেন)। নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। আর, বিশেষত, অভিনেতা (নিজের লেখা নাটকে এবং তাঁর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন) কিংবা চিত্রপরিচালক ও চিত্রঅভিনেতা (‘নটীর-পুজা’ নামক একমাত্র চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, অভিনয়ও করেছেন, ৭০ বছর বয়সে—১৯৩২ সালে) হিসেবে তাঁকে আমরা খুব বেশি চিনি না। সমকালে শিল্পসৃষ্টির এই নতুন আঙ্গিকটির সম্ভাবনা এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন:

“ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফুটিত করা উচিত, যা কোনও বাক্যের সাহায্য ছাড়া আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে। সুরের চলমান ধারায় সংগীত যেমন বিনাবাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে, তেমনি রূপের চলৎপ্রবাহ কেন একটি স্বতন্ত্র রসসৃষ্টিরূপে উন্মোচিত হবে না। ”

আবার, মাঝে-মধ্যে মনে হয়, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকেও আমরা হয়ত ভুলতে বসেছি তাঁর কবিতা-গান আর গল্প-কাহিনীর প্রবল বাতাসে। মিডিয়ার তুমুল প্রভাবে, আজকাল (পরশুও হয়ত) রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপের প্রচার বেড়েছে ঠিকই; সে বিবেচনায় নাট্যকার রবিবাবুকে একালের খুব বেশি লোক বোধকরি স্মরণ করেন না। অথচ মানব-জীবনের বহু-বিচিত্র বিষয়াদি তিনি হাজির করেছেন নাটকের ক্যানভাসে; কবিতা কিংবা সংগীত অথবা গল্পমালার আবেদনের চেয়ে, তাৎপর্যের তুলনায় তা কোনও অর্থেই সামান্য নয়। প্রকৃতি, মানব-মন, আনন্দ-বেদনা আর পাওয়া-না-পাওয়ার অনেক হিসেব হয়ত মিলবে বরিঠাকুরের নাটকের সংলাপে, চরিত্রের গতি-অন্বেষায় ও বিকাশে। মানুষের প্রবণতাগুলিকে আলোড়িত করবার জন্য রবীন্দ্রনাথের সার্বক্ষণিক যে আকুলতা, তার সরল-স্বাভাবিক-প্রত্যাশিত চিন্তাবলি সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে তাঁর নাটক-বুননের কৌশলে আর সৃষ্ট নাটকীয়তায়। আর ওই যে তিনি চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে দৃশ্যের গতিপ্রবাহের কথা বলেছেন—এই প্রবাহ বহমান তাঁর নাটকের দৃশ্যে দৃশ্যে।

রক্তকরবী (প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ১৯২৬; অগ্রহায়ণ ১৩৩৩) একটি তত্ত্বনাটক; এখানে মঞ্চের আলোকের আড়ালে জীবনের এবং সৌন্দর্যের বিশেষ বিশেষ দিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন নাট্যকার ও কবি রবীন্দ্রনাথ। মূলত কৃষিসভ্যতা এবং যন্ত্রসভ্যতার মধ্যকার দ্বন্দ্বকে তিনি সংলাপের চমৎকারিত্বে প্রকাশ করতে চেয়েছেন বর্তমান নাটকে। অনেকে মনে করে থাকেন এটি একটি আধুনিক সমস্যা। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সমস্যাকে আধুনিক কিংবা পুরাতন—এই দুইভাগে ভাগ না করে সকল সমস্যাকে চিরকালের স্বাভাবিক সমস্যা বলে অভিহিত করার পক্ষপাতি। গ্রন্থাকারে প্রকাশের তিন বছর আগে শিলঙ-বাসকালে রবীন্দ্রনাথ নাটকটি রচনার সময় এর নাম রেখেছিলেন যক্ষপুরী। সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪) ১০ জুলাই ১৯২৩-এ তাঁর এক বন্ধুকে পত্রে লিখেছেন:

“রবিবাবু একটা টুতন ড্রামা লিখেছেন সেটার নাম বোধ হয় যক্ষপুরী। সেদিন সেটা পড়লেন। খুব ভালোই লাগল। তবে বড্ড complicated (sic) বলে মনে হয়। দেখা যাক বেরুলে লোকে কী বলে। তবে কেউ কেউ বলে মুক্তধারার চাইতে নাকি সহজ হয়েছে। ” (পত্র সংখ্যা: ২৪, সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ, ভীষ্মদেব চৌধুরী সংগৃহীত-সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৩)

১৩৩১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে মাসিক প্রবাসীতে নাটকটি রক্তকরবী নামে ছাপা হয়েছিল। নাটকটির প্রচলিত সংস্করণে ‘প্রস্তাবনা’ নামে কবির যে লিখিত অভিভাষণ রয়েছে, তার অংশবিশেষ হাজির করছি পাঠকের জন্য:

আজ আপনাদের বারোয়ারি-সভায় আমার “নন্দিনী” পালা অভিনয়। ...আপনারা প্রবীণ। চশমা বাগিয়ে পালাটার ভিতর থেকে একটা গূঢ় অর্থ খুঁটিয়ে বের করবার চেষ্টা করবেন। আমার নিবেদন, যেটা গূঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার সার্থকতা চলে যায়। হৃৎপিণ্ডটা পাঁজরের আড়ালে থেকেই কাজ করে। তাকে বের করে তার কার্যপ্রণালী তদারক করতে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ...বৈজ্ঞানিক শক্তিতে মানুষের হাত পা মুণ্ড অদৃশ্যভাবে বেড়ে গেছে। আমার পালার রাজা যে সেই শক্তিবাহুল্যের যোগেই গ্রহণ করেন, গ্রাস করেন, নাটকে এমন আভাস আছে। ...কর্ষণজীবী এবং আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজার করে দিচ্ছে। তা ছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।

রবীন্দ্রনাথ আকর্ষণবিদ্যার প্রতি প্রবল ঝোঁককে পেছনে ফেলে কর্ষণবিদ্যার আনন্দের দিকে মানুষের নজর আকৃষ্ট করবার চেষ্টা করেছেন। কেননা কৃষিকে বাদ দিয়ে; মাটির উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অবহেলা করে নগরসভ্যতার করকারখানার ওপর নির্ভর করে জীবন চলে না। আর দিনদিন যন্ত্র-দানবের সংখ্যা ও গতি বাড়বার সাথে সাথে কৃষিকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। খনি থেকে মূল্যবান নির্জীব সম্পদ আহরণের চেয়ে মাটি চিরে তার মমতারসে ফসল উৎপাদনের যে অনন্দ ও সৌন্দর্য, তা থেকে জীবনকে দূরে রাখলে প্রকৃত সুখ ও শান্তি লাভ করা যায় না। যেমনটি পারেননি এই নাটকের রাজা। সাধারণ মানুষ এবং জমি ও ফসলাদি থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্ষমতা ও শক্তির জালের আড়ালে নিজেকে আবদ্ধ রেখে তিনি কেবল নিজেকে সৌন্দর্য ও শান্তি থেকেই বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। তার ক্লান্তিবোধ এবং মুক্তি-অন্বেষার মধ্যে নাটকে এর বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যায়। নন্দিনীকে পাবার মাধ্যমে; তাকে জয় করবার মধ্য দিয়ে যন্ত্রণার জাল ছিঁড়তে চান রাজা।

পুরাণে রাম ও রাবণের কাহিনীতে শান্তি এবং অশান্তির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করা হয়েছে। রাম হলো আরাম, শান্তি; আর রাবণ চিৎকার, অশান্তির প্রতীক। রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ এবং তার ফলে রাবণের প্রতাপ ও লংকাপুরী ধ্বংস রামায়ণের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ঠিক তেমনই বর্তমান নাটকে যক্ষপুরীতে নন্দিনীর প্রবেশ এবং এই নরকযন্ত্রণার অবসানের মধ্যে দিয়ে মুক্তির বারতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন নাট্যকার রবিবাবু। রবিঠাকুরের রাজা পুরাণের রাবণের প্রতিনিধি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে অনেক হাত-পা (শক্তির দাপট ও যোগাযোগের প্রাবল্য বোঝাতে) গজানো মানুষের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন রাজার গ্রহণ ও আগ্রাসনের মনোভাব রূপায়ণের মাধ্যমে। নাটকটির শুরুতে এর পরিবেশ ও আবহ বর্ণনার ছলে লেখক বলছেন:

“এই নাট্যব্যাপার যে-নগরকে আশ্রয় করিয়া আছে তাহার নাম যক্ষপুরী। এখানকার শ্রমিকদল মাটির তলা হইতে সোনা তুলিবার কাজে নিযুক্ত। এখানকার রাজা একটা অত্যন্ত জটিল আবরণের অড়ালে বাস করে। প্রাসাদের সেই জালের আবরণ এই নাটকের একটিমাত্র দৃশ্য। সেই আবরণের বহির্ভাগে সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে। ”

রামায়ণে সীতা হরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাম-রাবণের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। আর রক্তকরবীতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে কর্ষণজীবীতা আর আকর্ষণজীবীতার মধ্যে। সীতা অর্থ হলচালনরেখা; তাকে নিয়ে মত-বিরোধ দুই ভিন্ন গোত্রের সভ্যতায়। তেমনই এই নাটকে নন্দিনীর আবির্ভাব ওই কৃষিবিদ্যার রক্ষার প্রতীকরূপে। মানব নন্দিনীকে নাট্যকার রক্তকরবীপুষ্প প্রতীকে রূপায়িত করতে চেয়েছেন। আর নন্দিনী সম্বন্ধে লেখক জানাচ্ছেন তাঁর পাঠককে:

রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি “নন্দিনী” বলে একটি মানবীর ছবি। চারিদিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। ফোয়ারা যেমন সংকীর্ণতার পীড়নে হাসিতে অশ্রুতে কলধ্বনিতে উর্ধ্বে  উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, তেমনি। সেই ছবির দিকেই যদি সম্পূর্ণ করে তাকিয়ে দেখেন তাহলে হয়ত কিছু রস পেতে পারেন। নয়ত রক্তকরবীর পাঁপড়ির আড়ালে অর্থ খুঁজতে গিয়ে যদি অনর্থ ঘটে তাহলে তার দায় কবির নয়। নাটকের মধ্যেই কবি আভাস দিয়েছেন যে, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়, মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের নৃত্য, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সেই সহজ সৌন্দর্যের। (“গ্রন্থ পরিচয়”, রক্তকরবী)

রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে রাজপুরীতে নন্দিনী আনন্দ ও মুক্তির বারতা নিয়ে প্রবেশ করেছে, সেখাসে প্রত্যেকে কিসের যেন সন্ধানে আপনমনে ব্যাকুল রয়েছে; অধ্যাপক ও পুরাণবাগিশ খুঁজছে জটিল-কঠিন শব্দের অর্থ ও উৎস, খোদাইকরেরা মাটির তলায় খুঁজছে সোনার দলা, জালের আড়ালে রাজা খুঁজে মরছে নিজের পরিচয় ও অস্তিত্ব, আর নন্দিনীও যেন অনবরত সন্ধান করে ফিরছে প্রাণের ধন; বিপ্লবের শক্তি রঞ্জনকে। কবি বোধহয় চেয়েছিলেন নারীর মোহময়তা ও রূপের আলো ও আনন্দের মধ্য দিয়ে পুরুষের সৃজনশীলতাকে, ক্লান্তিকে সরিয়ে সুখের পৃথিবী নির্মাণের পথ বাতলে দিতে। খনি থেকে তুলে আনা সোনার চেয়ে যে আনন্দের দাম বেশি; প্রতাপের মধ্যে যে সত্যিকারের কোনও পূর্ণতা নেই—প্রেমের মধ্যেই যে প্রকৃত স্বস্তি, সে কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠককে হয়ত আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন এই বর্ণিত রাজবাড়ির ভেতরে জমে-ওঠা অশান্তি-ক্লান্তি আর নন্দিনী নামক প্রাণখোলা বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি করে। অন্যকে দমন ও শাসনের মধ্যে দিয়ে আমরা যখন শান্তির পায়রা খুঁজতে গিয়ে ভুল পথে ঢুকে পড়ি, তখন লেখক রবিঠাকুর আমাদেরকে ওই জাগতিক বন্দিদশা থেকে মানসিক মুক্তির আহ্বান শোনাতে পাঠিয়েছেন নন্দিনীর আবেগ ও অফুরান প্রচেষ্টা। যন্ত্রসভ্যতা কিংবা যান্ত্রিকজীবনের জটিলতা থেকে সহজ ও ধীর জীবনে পদার্পণের জন্য তিনি তৈরি করতে চেয়েছেন প্রাণের গীতল আহ্বান। যাত্রী গ্রন্থে ‘পশ্চিমী-যাত্রীর ডায়ারি’ অংশে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ তারিখে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গত রক্তকরবী সম্বন্ধে লিখেছেন:

“নারীর ভিতর দিয়ে বিচিত্র রসময় প্রাণের প্রবর্তনা যদি পুরুষের উদ্যমের মধ্যে সঞ্চারিত হবার বাধা পায়, তা হলেই তার সৃষ্টিতে যন্ত্রের প্রাধান্য ঘটে। তখন মানুষ আপনার সৃষ্ট যন্ত্রের আঘাতে কেবলই পীড়া দেয়, পীড়িত হয়। এই ভাবটা আমার রক্তকরবী নাটকের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। ”

কবি জানেন প্রাণের মৃত্যু নেই, প্রকৃতির কোনও সৃষ্টির মরণ নেই; মরে কেবল মানুষের তৈরি জাগতিক বস্তু। তাই তিনি সন্ধানস্বভাবি ও অগ্রগমণ-প্রত্যাশি পুরুষের পাশে দাঁড় করিয়েছেন প্রেরণাময়ী নারীর রূপ ও স্পন্দন। রাজ্যের প্রশাসককে, বুদ্ধিজীবীকে, পণ্ডিতকে মুক্তির পথের সন্ধান দিতে নাট্যকার যেন কানে কানে মন্ত্রণা দিয়ে পাঠিয়েছেন নন্দিনী নামক আনন্দের খবর-বাহককে। নন্দিনী সম্বন্ধে নাটকে বর্ণিত অধ্যাপকের একটি উক্তি আমাদের অনুভবকে নাড়া দেয়। অধ্যাপক বলছেন: “সকালে ফুলের বনে যে আলো আসে তাতে বিস্ময় নেই, কিন্তু পাকা দেয়ালের ফাটল দিয়ে যে আলো আসে সে আর-এক কথা। যক্ষপুরে তুমি সেই আলো। ” আর সুড়ঙ্গ-খোদাইকর গোকুল নন্দিনীকে ভেবেছে রাঙা আলোর মশাল। অবশ্য নন্দিনীর আগমন ও আচরণ বিষয়ে গোকুলের সামান্য অভিযোগ এবং খটকা আছে: “কিছুই করে না, তাই তো খটকা লাগে। এখানকার রাজা খামকা ওকে আনালে কেন। ওর রকমসকম কিছুই বুঝি নে। ”

নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিনীর সাথে প্রত্যেকটি প্রধান ও অপ্রধান চরিত্রকে সম্পর্কের নিবিড় বাঁধনের সুতো দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই নারীর চঞ্চলতা ও সত্য-অনুসন্ধানের আহ্বানে সবগুলো চরিত্রের মধ্যে অকল্পনীয় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে; রাজা-অধ্যাপক-পুরাণবাগিশ-কিশোর-গোঁসাই-ফাগুলাল-বিশু ও সর্দার—সকলে, এমনকি শেষতক রাজাও, নন্দিনীর ভালোবাসার ও চমকের স্রোতের টানে যেন ভেসে চলেছে অদেখা কোনও সত্য দুনিয়ার দিকে। অবশ্য, নাটকের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে-থাকা রাজা নন্দিনীর প্রতি দুই ধরনের মনোভাব পোষণ করছেন প্রতিনিয়ত। এক. প্রবল আকর্ষণের। দুই. মারাত্মক বিকর্ষণের। একদিকে নন্দিনীর আনন্দঘন মন ও সৌন্দর্য তাকে কাছে টানতে উৎসাহ যোগায়, অন্যদিকে রাজার আগ্রাসি মন নন্দিনীকে রাজরাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে যেন প্রাণে বাঁচে। একবার সে নন্দিনীর হাত ধরে মাটির পৃথিবীতে সহজ জীবনে পদার্পণ করতে চায়; অপরদিকে ক্ষমতা ও শক্তির মোহ থেকে কিছুতেই সরতে তার মন চায় না। রবীন্দ্রনাথ এখানে রূপকের আড়ালে বিজ্ঞানের সাথে কৃষিসভ্যতার কিংবা গ্রামজীবনের পার্থক্যকে, আকর্ষণ-বিকর্ষণ খেলাকে, তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিজ্ঞান আমাদেরকে অনেক পথ দেখিয়েছে, দিয়েছে শক্তির বহুধা রূপ; কিন্তু আমরা হয়ত বিজ্ঞানকে কল্যাণকাজে প্রয়োগ না করে তার সুফল ভোগ থেকে নিজেকে ও অন্যকে বঞ্চিত করছি ক্রমাগত।

সমাজ ও সংসারে নিয়ম থাকাটা একটা দরকারি প্রসঙ্গ। কিন্তু যদি সে নিয়মতন্ত্র মানুষের প্রাণের বিকাশের পথকে বন্ধ করে দেয়, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেওয়া কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। যে নিয়ম মানুষের আনন্দকে হরণ করে, তাকে ভেঙে ফেলবার আয়োজন করাটাও মাঝে মাঝে জরুরি হয়ে পড়ে। সমাজের সর্দার-মাতুব্বররা পর্যায়ক্রমে নিয়মকে ধরে রেখেছে; আবার নিজেদের নিয়মের আগুনে পুড়েও মরেছে। তবু নিয়মকে ছাড়েনি। এইভাবে সভ্যতার গায়ে মোটা দাগের মতো নিয়মতন্ত্রের বিষচক্র লেপ্টে আছে যুগ যুগ ধরে। এই নাটকেও সে কথা বলার চেষ্টা আছে। আর রয়েছে প্রাণের বিকাশে বাধা সৃষ্টিকারী নিয়মভাঙার অপ্রকাশ নির্দেশ। নাটকে বর্ণিত সর্দার-গোঁসাই-চিকিৎসকরা সমাজনির্মিত নিয়মের দাসানুদাস। সমাজধর্মের উপদেশ ও বাণীকে আঁকড়ে ধরে প্রাণের বিকাশ হয় না—তা জানতেন কবি-নাট্যনির্মাতা রবীন্দ্রনাথ। তাই হিতোপদেশের জটিল আবর্ত থেকে সরল মানুষকে স্বাভাবিক পথের সন্ধান দিতে এগিয়ে এসেছেন তিনি।

ফাগুলাল-চন্দ্রা দম্পতি রাজবাড়ির জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও কৃষিজ উৎপাদন-নির্ভর জগতের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন মনের টান তারা অনুভব করে। আর সে কারণেই তো নবান্নের উৎসবে যোগ দিতে তারা মনের টান অনুভব করে। এই ঝোঁকের অন্তরালেও তো লুকিয়ে আছে নগরযন্ত্রণা থেকে গ্রামীণ বাতাসে ফিরে যাবার বহুদিনের গোপনে লালিত বাসনা; ক্ষুধা-তৃষ্ণা, যন্ত্রণা এবং কাজের রুটিনের চাপ থেকে বনের সবুজে আর রোদের মায়ায় গা রাখবার নেশা। যেন আকাশের নিচে অবকাশ যাপনের নীল মত্ততার ডাক। অবশ্য নন্দিনীর আবাহন বারতা এবং তাতে ফাগুলাল ও বিশুর ঘোর আগ্রহে চন্দ্রার কতক আপত্তি আছে; এ আপত্তির পেছনে রয়েছে নারীর স্বভাবজ আশা ও প্রাপ্তির প্রতিফলন-ইচ্ছা। কিশোর রাজবাড়ির সমূহ প্রতিকূলতা পার হয়ে নন্দিনীর জন্য রক্তকরবীর ফুল যোগাড় করার জন্য সদাপ্রস্তুত। অপরদিকে বিশুপাগল প্রকৃতঅর্থে মুক্তপুরুষের প্রতীক। এই রকম মুক্তিপাগল পুরুষ বা নারী কিংবা ঠাকুরদাদা অথবা বাউল রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বনাটকে হাজির হয়েছে অনেকভাবে; তারা সকলে কেবল বাহিরপানের মুক্ত বাতাসে যাবার আলোক-মশাল নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। জীবনের যাতনাকে, যন্ত্রের যন্ত্রণাকে আঘাত করে করে ভেঙে ফেলবার প্রেরণার সামর্থ্য দিয়ে এইসব মুক্তমনের মানুষকে রূপ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আর এই নাটকের রঞ্জন হলো সমস্ত বাধা অপসারণে ক্রমে এগিয়ে আসতে-থাকা প্রবল ঝড়। নাটকে রঞ্জনের জন্য নন্দিনীর প্রতীক্ষা প্রকৃতঅর্থে অসত্যের পিঠে চপেটাঘাত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার অধীর অপেক্ষারই নামান্তর মাত্র। নন্দিনীর জবানিতে পাওয়া যায় রঞ্জনের পরিচয়: “ওরা জানে না ওরা কী অদ্ভুত। ওদের মাঝখানে বিধাতা যদি খুব একটা হাসি হেসে ওঠেন, তা হলেই ওদের চটকা ভেঙে যেতে পারে। রঞ্জন বিধাতার সেই হাসি। ” নন্দিনী মনে করে রঞ্জন মুক্তির হাওয়া বহন করে পথ চলে সর্বদা; তার অগ্রগমণ বা অভিযাত্রাকে কেউ প্রতিহত করতে পারে না। আর পর্দার আড়ালে, কঠিন জালের ওপারে অবস্থান যে রাজার, রঞ্জন সম্বন্ধে তার অনুভব: “আমি জানি রঞ্জনের সঙ্গে আমার তফাতটা কী। আমার মধ্যে কেবল জোরই আছে, রঞ্জনের মধ্যে আছে জাদু। ” রঞ্জনের আগমন-ইঙ্গিতের মধ্যে নতুন প্রজন্মের কিংবা অনাগতকালের প্রতিবাদী ও সত্যসন্ধানি মানুষের জেগে-ওঠার গল্পের হাতছানি আছে।

কৃষি-নির্ভর সভ্যতার উদারতাকে বোঝানোর জন্য নাট্যকার ফসলকাটার গান সন্নিবেশ করেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যাদের জন্য এই গানের আয়োজন, তাদের কানে কোনওকালেও গানের বাণী পৌঁছয় না। তারা গান শোনে কি-না কিংবা গান তাদেরকে আদৌ টানে কি-না, সে বিষয়েও রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। নাটকটির ঘটনার কাল পৌষমাস; ফসল কাটার ও নবান্নের প্রবল মৌসুমের প্রাক্কাল। শীতকালে যেমন ফসল কাটার ধুম নামে, তেমনই চলে খোদাইকরের খোঁজাখুঁজির ব্যস্ততা। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া এই দ্বন্দ্বের স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ কৌশলে নাটকের ক্যানভাসে তুলে এনেছেন। যাদের কানে ফসল কাটার গানের শব্দ পৌঁছে না, তারা যে কৃষিতন্ত্র থেকে কতো দূরে রয়েছে, কিংবা বলা চলে নিজেকে কিভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে, তা সহজেই অনুমান করা চলে। পৌষের ফসল কাটার গানের খানিকটা শোনা যাক:

পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে—আয় রে চলে,
আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,
মরি, হায় হায় হায়। ...
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হলো—
ঘরেতে আজ কে রবে গো। খোলো দুয়ার খোলো।

শিল্পকারখানা স্থাপন ও এর ক্রম-বিকাশের ফলে জীবনে যে যান্ত্রিকতা নেমে এসেছে, নিয়মতান্ত্রিকতার জাটিল্যে মানুষের জীবন যে কীরূপ অসাড় হয়ে পড়ছে, তারই বাস্তবতা আঁকতে চেষ্টা করেছেন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর রক্তকরবী নাটকের পুরো ক্যানভাসে। মূলত নাট্যরচয়িতার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে যে, শিল্পবিপ্লব মানুষের গতিকে বাড়িয়ে দেয়নি, পক্ষান্তরে মানুষকেই করে তুলেছে আধাপঙ্গু প্রাণী; অথবা কোনও স্বেচ্ছাবন্দী অবলা (নীরব অর্থে) জীব। আর সে হিসেবেই তিনি নাটকের চরিত্রগুলোকে ব্যক্তিবিশেষে রূপ না দিয়ে এক একটি শ্রেণির প্রতিনিধিরূপে পরিবেশন করেছেন। অসীম ক্ষমতার অধিকারী রাজাও যে ক্লান্ত তার আভাস দিচ্ছেন নাট্যকার। নন্দিনীর প্রতি রাজার নেপথ্য কণ্ঠ জানাচ্ছে সে কথা: “আমি প্রকাণ্ড মরুভূমি—তোমার মতো একটি ছোট্ট ঘাসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছি, আমি তপ্ত, আমি রিক্ত, আমি ক্লান্ত। তৃষ্ণার দাহে এই মরুটা কত উর্বরা ভূমিকে লেহন করে নিয়েছে, তাতে মরুর পরিসরই বাড়ছে, ঐ একটুখানি দুর্বল ঘাসের মধ্যে যে প্রাণ আছে তাকে আপন করতে পারছে না। ”

নন্দিনী এই পৃথিবীর সকল প্রাণময় মানুষের প্রতিনিধি—যে সব মানুষ জীবনকে চাহিদা দিয়ে নয়; পাবার আনন্দ দিয়ে অনুভব করতে শিখেছে। রক্তকরবী বিশুদ্ধতা লাভের প্রতীক; মধু আর বিষের আধার যেন এই ফুল। রাজবাড়ির লোহার জাল থেকে মুক্তির জন্য নন্দিনী নামক আনন্দের শক্তি আর যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের জন্য রক্তকরবীর বীজের বিষরস পানের প্রয়োজনীয়তার গল্পও বোধকরি রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে শোনাতে চেয়েছেন। লোহার জাল ছিন্ন করে করবী গাছ তার রক্তাক্ত বিদীর্ণ বুক নিয়ে বেড়ে উঠেছে; তার মানে প্রাণের কাছে জড়ের পরাজয় নিশ্চিত। যন্ত্রদানব যতই শক্তি বিস্তার করুক না কেন, প্রাকৃতিক উৎপাদনশক্তি ও মাহাত্ম্যের কাছে তাকে একদিন না একদিন পরাজয় মানতেই হবে—এ সত্যই বোধকরি কবি-দার্শনিক-নাট্যনির্মাতা রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে, সত্যকে ভুলে-থাকা মানুষকে, নাটকের কথামালার আড়ালে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন।
সম্ভবত আশাহীন, আলোহীন জীবনের যাতনা থেকে, দুর্বল মনের অশান্ত জমিন থেকে শান্তিমন্ত্রে অবগাহনের প্রয়োজনে জন্ম হয়েছে নন্দিনী-বিশু-ফাগুলাল ও রঞ্জনদের। বিশুপাগলের কাছ থেকে নন্দিনীর শেখা গানে আছে জগতকে সুন্দরের দিকে ডাকবার গভীর সুর:

ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে-স্থলে বাজায় বাঁশি।
আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে,
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় গো ভাসি।
সেই সুরে সাগরকূলে
বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে
অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন হাসি।

নাটকে বর্ণিত যক্ষপুরীতে মানুষ কোনও ব্যক্তি নয়; তাদের পরিচয় কেবল সংখ্যায়। নাট্যকার খোদাইকরের প্রতীকে যেমন অনিমেষ অশেষ প্রাপ্তির-অন্বেষায় ব্যস্ত-থাকা মানুষকে বুঝিয়েছেন, তেমনই শ্রমিকের বা রাজকর্মচারীর পরিচিত সংখ্যা দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন—এখানে মানুষ অন্যান্য পণ্যের মতো লাভ-লোকসানের বস্তু হিসেবে গণনার বিবেচনার মধ্যেই নিবদ্ধ থাকে। যেমন বিশু পাগল বলছে: “ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা। আমি ৬৯ঙ। গাঁয়ে ছিলুম মানুষ, এখানে হয়েছি দশ-পঁচিশের ছক্। ”

লোভ আর লাভের হিসেবের দুনিয়ায় রাজক্ষমতায় (অবশ্য ক্ষমতা না বলে দায়িত্ব বলা ভালো ছিল; কিন্তু আমরা বোধহয় দায়িত্বে থাকার চেয়ে ক্ষমতায় থাকতে বেশি পছন্দ করি!) থাকা ব্যক্তিরা আরও অধিক পাবার লোভে মত্ত থাকে দিনরাত। অন্যের শান্তি হরণ করে তারা নির্মাণ করতে চায় নিজেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। অপরদিকে যারা এই অভিশাপের বেড়াজাল থেকে নিজেকে ও অন্যকে বাইরে টেনে আনতে চায়, তাদের মনে কাজ করে একধরনের সরলতা; তাদের কথায় ও কাজে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। সমাজকে সঠিকটা শিক্ষা দেবার জন্য এই মুক্তিপাগল জনতা অনবরত জীবনকে উৎসর্গ করার পথে অগ্রসর হতে থাকে। নাট্যকার দেখিয়েছেন মুক্তির শলাকা হাতে নিয়ে ধাবমান নন্দিনী এবং বিশু পরস্পরের চিন্তা ও চাহনিতে আকৃষ্ট হয়েছে। নিজের ভেতরের আমিকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করেছে তারা একে অপরের চাহনি ও চলার ভঙ্গিতে। বিশু বলছে:

“যক্ষপুরীতে ঢুকে অবধি এতকাল মনে হতো, জীবন হতে আমার আকাশখানা হারিয়ে ফেলেছি, মনে হতো, এখানকার টুকরো মানুষদের সঙ্গে আমাকে এক ঢেঁকিতে কুটে পিণ্ড পাকিয়ে তুলেছে। তার মধ্যে ফাঁক নেই। এমন সময় তুমি এসে আমার মুখের দিকে এমন করে চাইলে, আমি বুঝতে পারলুম আমার মধ্যে এখনও আলো দেখা যাচ্ছে। ...একজন মেয়ে। হঠাৎ তীর খেয়ে উড়ন্ত পাখি যেমন মাটিতে পড়ে যায়, সে আমাকে তেমনি করে এই ধুলোর মধ্যে এনে ফেলেছে। আমি নিজেকে ভুলেছিলুম। ”

আর নন্দিনীর অনুভবও প্রায় একই রকম। বিশুকে বলছে: “কী মনে করে বাজিখেলার ভিড় থেকে একলা বেরিয়ে গেলে। যাবার সময় কেমন করে আমার মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারলুম না—তার পরে কতকাল খোঁজ পাই নি। কোথায় তুমি গেলে বলো তো। ”

যক্ষপুরীর রাজা নন্দিনীর মধ্যে পেয়েছে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার মোহময় আহ্বান; যেন বহুদিনের জমে-থাকা অচলতার মধ্যে একফোঁটা স্পন্দন। কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার জন্যে, ক্ষমতার মধু লেহন করবার জন্যে রাজার মধ্যে ভয়ানক ব্যাকুলতা, নন্দিনী এই ব্যাকুলতা নামক পাথরের দুর্গ আর রঙিন চশমার আড়াল থেকে রাজাকে বাইরের খুশির বারান্দায় নিয়ে আসতে চায়।

নন্দিনী-বিশুদের দৈনন্দিন পদচিহ্ন আর রঞ্জনের মহাআবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ রাজবাড়ির গ্রাস ও গ্রহণের শক্তি এবং সকল বাধা ও জটিলতার অবসানের ছবি আঁকবার চেষ্টা করেছেন । তিনি যেন নীলকণ্ঠ পাখির পাখার বাতাসে জয়যাত্রার শুভসূচনা করতে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে তুলেছেন যক্ষপুরীর ভেতরের ও বাইরের সব মানুষকে। পুরাণবাগীশ এবং অধ্যাপকও সকল তত্ত্বের মধ্যে যেন নতুন বারতার আভাস পেয়েছেন; নির্বোধের অহেতুক গাম্ভীর্যের দেয়াল চাপচাপ অন্ধকার ধসে পড়ার মতো ভেঙে পড়তে দেখেছেন প্রলয়কাণ্ডের ভয়ংকর শব্দে। রবীন্দ্রনাথ সমকালের যাবতীয় চলমানতা, ঐতিহ্য ও পুরাণের সমূহ চেতনার ভেতরে জানার টানের কাছে প্রাণের টানের বিজয়পতাকা ওড়াতে চেয়েছেন—উৎপাদন-নির্ভর কৃষি-ব্যবস্থার পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে। তাই তো তিনি নন্দিনীর গায়ে জড়িয়ে দিয়েছেন ধানীরঙের কাপড়। গ্রামের সরল মানুষগুলোর সকল প্রাণশক্তি ও প্রেরণা নষ্ট করেছে যে যন্ত্রসভ্যতা, তার খোলস থেকে সত্যিকারের মানুষগুলোকে বাইরে আসার আহ্বান ছড়ায় নন্দিনীর এই ধানীরঙের (ধানের রঙে রাঙানো) শাড়ির আঁচলে মাখা মায়া। মানুষ শব্দটি নন্দিনীর কাছে বিশেষ তাৎপর্যে ধরা দিয়েছে। ছোট ছোট মানুষের অর্থাৎ ব্যক্তির (ইনডিভিজুয়াল্স্) সম্ভাবনাকে হত্যা করে যে বড় মানুষ বা ক্ষমতালিপ্সুরা বড় হবার তত্ত্বচর্চা করছে তাকে নন্দিনী ভাবনা-আকাশে সাজিয়েছে এভাবে: “বাঘকে খেয়ে বাঘ বড় হয় না, কেবল মানুষই মানুষকে খেয়ে ফুলে ওঠে। ” মানুষ বিষয়ে এই নাটকে নন্দিনীর আরও কয়েকটি অনুভবের পাঠ দেখে নেওয়া যাক:

“এ কোন্ সর্বনেশে দেশ গো। তোমরাও মানুষ নও, আর যাদের চালাও তারাও মানুষ নয়। ”
“ওরা তোমাকে পশুর মতো রাস্তা দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলেছে, ওদের নিজেরই লজ্জা করছে না? ছি ছি, ওরাও তো মানুষ!”

পৃথিবীর তাবৎ মানবতাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, যখন একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে হত্যা করে তখন পুরো মানবতাকেই নিহত করা হয়। অবশ্য হত্যাকারীরা এই যুক্তি মানে না; তাই তারা অনায়াসে মানুষকে অপমান করে কিংবা তার নিজস্বতাকে হত্যা করে আনন্দ লাভ করতে চায়। দুনিয়ার সব আগ্রাসি রাজা ও তার লোকেরা এই ভয়ংকর অপমানের খেলায় মেতে আছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর রক্তকরবী নাটকে ভুলের জগতে বাস করা মানুষগুলোর ভুল শুধরে তাদের সত্যের পথে দাঁড়াবার মনোবল যোগাতে চেষ্টা করেছেন। ডাকঘর (প্রকাশকাল: ১৯১১) নাটকে যেমন মোড়লদের মোড়লিপনার যন্ত্রণা থেকে অসুস্থ ও ঘরবন্দি অমলের মহামুক্তির বারতা নিয়ে হাজির হয়েছেন রাজকবিরাজ, তেমনই এই রক্তকরবীতে চিকিৎসক রাজার মনের ভেতরে ফসল কাটার গানের সুর শুনতে পেয়েছেন। রাজ্য-পরিসরের সর্দারদের চোখেও লেগেছে রক্তকরবীর রঙ; নন্দিনীর ডাকের অমিত বাণীর বাতাস। আমাদের বিশ্বাস, মানুষের প্রাণকে ছিঁড়ে, জালের আড়ালে থেকে যে মানুষ অজগরের মতো মানুষকে গিলে খায়, অসীম শক্তি ও লালসার ধারক ও বাহক ওই রাজাকে টেনে বার করবার প্রত্যয় বুকে নিয়ে নন্দিনীর আগমন।

নাটকের শেষদিকে আমরা দেখতে পাই স্বয়ং রাজা এবং তার কারিগরের দল মানবমুক্তির এই মহা-আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। রঞ্জনের প্রতীকী মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নাট্যনির্মাতা রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ঘোষণা করতে চেয়েছেন—মহামুক্তির মহাবীরের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আর এও জানাতে ভোলেননি যে, প্রকৃত বীরের, সত্য-অনুসন্ধানী মানুষের, মুক্তির বার্তাবাহকের মৃত্যু নেই। যতদিন শোষণের ও ক্ষমতা-অপপ্রয়োগের জাল ছড়িয়ে থাকবে পৃথিবীতে, ততদিন রঞ্জনের মতো বীরের আর নন্দিনীর মতো সুবাতাসের প্রয়োজন শেষ হবে না। চরম প্রাণের সন্ধান পেলে, ভালোবাসার পথের হদিস মিললে, কোনও শক্তিই কাউকে কঠিন জালে আটকে রাখতে পারে না—এ সত্যের আভাসই নাটকে, শেষতক, আমরা উপলব্ধি করি—“জয় রঞ্জনের জয়!” এবং “নন্দিনীর জয়!” কথামালার মধ্য দিয়ে। ফসল কাটার গানের সুরে যখন নাটকের যবনিকা পর্দা নামে, তখন সকল মোহ আর আকর্ষণের অন্তরালে কর্ষণবিদ্যা আর উৎপাদন এবং অশেষ আন্দের জয়গানই বোধকরি সূচিত হয়।

লেখক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর



বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।