ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৫
বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ অলংকরণ : মাহবুবুল হক

দুই পেগ হুইস্কি খেয়েছে।
একশ’ বাঁশিঅলা।


শেষ চুমুক দিয়েছে কতক্ষণ আগে?
এক ঘণ্টা।
মাতাল হয়নি।
স্বাভাবিক আছে।
স্বাভাবিক ঝিমঝিম।
ছাদে বসে মেঘের ওড়াউড়ি দেখছে।
মেঘ কত রকম?
আটাশ রকম।
আন্তর্জাতিক মেঘ-নীতি অনুসারে।
নেটে দেখেছে।
সিরোস্ট্র্যাটাস মেঘ, নিমবাস মেঘ, সিরাস মেঘ, কিউমুলাস মেঘ, নিম্বোস্ট্র্যাটাস মেঘ...। এদের কি বাংলা নাম রাখা হয়নি?
কিউমুলোনিমবাস মেঘপুঞ্জের হাইট আট মাইল পর্যন্ত হতে পারে। মাউন্ট এভারেস্টের হাইটের দ্বিগুণ। এভারেস্টের চূড়ায় না উঠে তাহলে কিউমুলোনিমবাস মেঘপুঞ্জে উঠে বসে থাকলেই হয়। হা! হা! হা!
জাতপাত আছে মেঘেরও।
হা! হা! হা!
এখন কোন জাতের মেঘ আকাশে উড়ছে?
সিরোস্ট্র্যাটাস!
এই মেঘে ঝড়-বৃষ্টি হয়।
হবে?
মনে হচ্ছে, হবে।
হাওয়া দিচ্ছে খুব। বৃষ্টির ঘ্রাণ হাওয়ায়। এমন উথাল-পাথাল, মনে হচ্ছে ছাদ উড়ে যাবে। উত্তপ্ত দিনটার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে। অদ্ভুত এক আলো পড়েছে ছাদে। আকাশে আধখানা চাঁদের জোছনা।
এক ফোঁটা বৃষ্টি কি পড়ল?
না। তবে হচ্ছে অদূরে কোথাও।
দূরে কোথাও?
বৃষ্টি হচ্ছে?
নিঝুম লঞ্চঘাট ভিজছে বৃষ্টিতে?
গাঙপাড়ের স্কুল ভিজছে?
কোন লঞ্চঘাট?
কোন গাঙপাড়ের স্কুল?
তিনশ’ আটষট্টি কিলোমিটার দূরের এক শহরের।
সেই শহরে বিন্দুবাসিনী থাকে। সহিদুল, অমিয়াংশু থাকে।
বিন্দুবাসিনী কী করছে এখন?
কাঠ হয়ে পতিদেবের পাশে শুয়ে আছে। ঘুমাচ্ছে না।
সহিদুল?
মাতাল।
অমিয়াংশু?
কী প্র্যাকটিস করছে?
কামসূত্র?
কার সঙ্গে কথা বলা যায়?
রাত এখন...?
১২টা ১৩।

বিন্দুবাসিনী বন্ধুপত্নী। রাত ১২টা ১৩-তে তাকে উচিতভাবে ফোন করা যায় না। সহিদুলকে ফোন করা যায়। কিন্তু সহিদুল একটা মার্কামারা মাতাল, মেথর পট্টির ধেনো গিলে এতক্ষণে বেহেড হয়ে গেছে। হা হা করে হাসতেও পারে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও পারে। কিছু ঠিক নেই। উথাল-পাথাল হাওয়ার মাতমের মধ্যে মাতালের হাসি কিংবা কান্না, শব্দদূষণের মতো কুৎসিত বোধ হবে দুটোই। অতএব, খারিজ সহিদুলও। অতএব, পড়ে থাকল এক অমিয়াংশু। পড়ে থাকুক। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকুক সরোজিনীর পাশে। দুই বছর আগে বিয়ে করেছে। তারা এখনও বাচ্চা-কাচ্চা নেয়নি। কামসূত্র অনুশীলন করছে। সরোজিনীর সঙ্গে একদিন ফোনে কথা হয়েছিল। সরলসিধা, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। তারা একবার ঢাকায় আসবে বলেছে। বারোদী যাবে। বাবা লোকনাথের মন্দিরে পূজা দেবে। ‘মানসিক’ করে রেখেছে। মানত না, ‘মানসিক’।

১২টা ১৮।
বিন্দুবাসিনী বাদ, সহিদুল বাদ, অমিয়াংশু বাদ।
টেক্সট সেন্ড করল একটা মুখস্থ নাম্বারে।
Ghumie Porecho?
রিপ্লাই এলো,
Nop.
কল দিল।
নাম্বার বিজি না।
এরিক ক্ল্যাপটনের গান শুনল।
ওয়ান্ডারফুল টুনাইট।
হ্যালো টিউন।
ইটস লেট ইন দ্য ইভনিং...
কল কি ধরবে?
নাকি ধরবে না?
ধরবে না।
ধরবে।
ধরবে না।
ধরবে।
ধরল না।
আবার কল দিল।
ইটস লেট ইন দ্য ইভনিং
শি ইজ ওয়ান্ডারিং হোয়াট ক্লথস টু ওয়ার
শি পুটস অন হার মেক-আপ
অ্যান্ড ব্রাশেস হার লং ব্লন্ড হেয়ার...
ধরল। ফিসফিস করে বলল, ‘কী-ই-ই? ঘুম ধরে না?’
‘তোমার ধরে?’
‘হ্যাঁ-এ-এ, ধরে। তবে ধরলেও আমি ঘুমাই না। হি! হি! হি! কী করেন?’
‘ছাদে বসে আছি। ’
‘ছাদে বসে আছেন? এমা! একা?’
‘না, একা না। ’
‘আপনার সঙ্গী-সাথীরা আছে এখনও? ভালো তো। পার্টি হচ্ছে?’
‘না। সঙ্গী-সাথীরা কেউ আজ আসেনি। ’
‘এমা! তাহলে কার সঙ্গে ছাদে বসে আছেন আপনি? আপনার সঙ্গে বসে আছে কে?’
‘কানী লিওন। ’
‘কী? কে? সানি লিওন? হি! হি! হি!’
‘সানি না, কানী লিওন। কানী, লিওন। ’
‘কী? হি! হি! হি! দীপিকা পাডুকোনের সঙ্গে কি আপনার ব্রেকআপ হয়ে গেছে নাকি?’
‘মাথা খারাপ! তা কখনও হয়?’
‘এমা! তাহলে কানী লিওনের সঙ্গে বসে আছেন কেন আপনি?’
‘বসে আছি। কী করব? তুমি কী করো?’
‘কাঁপি। ’
‘কী?’
‘হি! হি! হি! ঠাণ্ডায় কাঁপি। ’
‘ঠাণ্ডা!’
‘ঘরের এসি ফুল করে দিয়েছি। মরচুয়ারি হয়ে যাচ্ছে ঘর। ’
‘অ। ’
‘পছন্দ হলো না?’
‘পতিতুণ্ডু। ’
‘কী-ই-ই?’
‘মনে নেই কী পতিতুণ্ডু?’
‘সায়ন্তনী পুততুণ্ডু?’
‘সায়ন্তনী পুততুণ্ডু কে?’
‘সায়ন্তনী পুততুণ্ডু লেখক। কলকাতার। কেন, আপনি তার লেখা পড়েননি?’
‘না। সব লেখা আমি পড়ি না। সায়ন্তনী পুততুণ্ডু ভালো লেখে? কবি?’
‘কবি না। উপন্যাস লেখে। ভালো লেখে। দেশ পত্রিকায় গত বছর একটা উপন্যাস লিখেছিল। পূজা সংখ্যায়। ’
‘পূজা সংখ্যা আছে, দেখব। ’
‘দেখবেন? পড়বেন না? হি! হি! হি!’
‘টান দিলে অবশ্যই পড়ব। ’
‘টান দেবে। ’
‘তুমি অনেক পড়ো। ’
‘আবার জিগায়! পড়তে পড়তে বলে কানা হয়ে গেলাম! হি! হি! হি! হয়েছে, আপনার পতিতুণ্ডুর কথা বলেন। উনি কী করেন?’
‘এখন কী করেন বলতে পারব না। বেঁচে ছিলেন যখন উপন্যাস লিখতেন। ’
‘উপন্যাস লিখতেন? আপনি কি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনামের কথা বলছেন? দর্পনারায়ণ পতিতুণ্ডু। হঠাৎ তার কথা কেন?’
‘উনি এখন আকাশে। ’
‘কে? বঙ্কিমচন্দ্র?’
‘হ্যাঁ। ’
‘কী? ও। হি! হি! হি! আপনি অনেক মজার কথা বলেন। ’
আকাশজুড়ে বিদ্যুৎ চমকালো।
মেঘ ডাকল।
কাকে ডাকল?
‘মেঘ ডাকল, শুনেছো?’
‘শুনেছি। ’
‘তোমাকে ডাকল?
‘কী?’
‘মেঘ কি তোমাকে ডাকল?’
‘কী বলেন!’
‘তুমি কি বৃষ্টির জন্মভূমি?’
‘কী-ই-ই!’
‘তুমি কি... বৃষ্টির... জন্মভূমি?’
‘কিসের জন্মভূমি? বোঝা যাচ্ছে না। আবার বলেন। ’
‘তুমি কখনও বৃষ্টিতে ভিজেছো?’
‘বৃষ্টিতে ভিজব না! কী বলেন! যাহ্!’
‘শেষ কবে ভিজেছ?’
‘শেষ যেদিন বৃষ্টি হলো দুপুরে। ’
‘ক্যাম্পাসে ছিলে?’
‘না, বাসায়। ছাদে উঠে ভিজেছি। ’
‘তুমি একা?’
‘হ্যাঁ, একা। হি! হি! হি! কাউয়াকে ফোন করেছিলাম, কাউয়া বলল তার ঠাণ্ডা লেগে আছে, বৃষ্টিতে ভিজবে না। বলে দুটো হাঁচিও দিল। ’
‘কাউয়া?’
‘ক্রো। রাসেল ক্রো। গ্ল্যাডিয়েটর। হি! হি! হি! শুটিংস্টার দেখলে আমি কী উইশ করি জানেন? রাসেল ক্রোর সঙ্গে একটা ব্লাইন্ড ডেট। ’
‘কিন্তু ধরো ডেটের দিন বৃষ্টি হলো আর রাসেল কাউয়ার ঠাণ্ডা লেগে থাকল। ’
‘ইশ্! না!’
‘আচ্ছা, বৃষ্টির কথা বল। ’
‘কী বলব? বৃষ্টি পড়ছে, রেইন ইজ রিডিং? হি! হি! হি!’
‘সেদিন বৃষ্টিতে তোমার শরীর স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল?’
‘কী?’
‘তুমি কি রেইনকোট পরে সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিলে?’
‘কী? হি! হি! হি! তা কেন? রেইনকোট পরে কেউ বৃষ্টিতে ভেজে?’
‘ভেজে। তুমি কী পরে ভিজেছো?’
‘শার্ট আর ট্রাউজারস। ’
‘বৃষ্টি তোমার শরীর মেপেজুকে দেখেছে?’
‘আপনি একটা ফ্রিক। হি! হি! হি!’
‘ফ্রিক কী? বাংলায় বলো। ’
‘বলতে পারব না। আমার বাংলা জ্ঞান আপনার মতো না। ’
‘অ। আমি একটা ইন্ডিয়ান শব্দ জানি। ’
‘ইন্ডিয়ান কী শব্দ? হিন্দি না তামিল?’
‘এই ইন্ডিয়ান না, রেড ইন্ডিয়ান। শব্দটা হলো ট্যাটস আইগো। ’
‘ট্যাটস আইগো। মানে কী?’
‘বৃষ্টির খবর নিয়ে আসে যে মানুষটা। বৃষ্টিদূত বলতে পারো। ’
‘দারুণ তো। আপনি কি বৃষ্টিদূত? ট্যাটস আইগো?’
‘না, তবে হতেও পারি। ’
‘হতেও পারেন!’
‘মনে হয়। বৃষ্টির জন্মভূমির সঙ্গে যদি দেখা হয় কখনও। ’
‘অ। আমি তো বৃষ্টির জন্মভূমি না। ’

আট দিন আগে বৃষ্টি হয়েছিল শেষ। দুপুরে একটু। আট দিন ধরে রঙ্গ-তামাশা চলছে। মেঘ হলেও বৃষ্টি হয় না। গরমে অতীষ্ট নগরীর প্রাণিকুল। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রোজ কমছে না বাড়ছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল বেয়াল্লিশ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন আটাশ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ আটত্রিশ দশমিক সাত এবং সর্বনিম্ন আটাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ মনে হয় আরেকটু বেড়েছিল। চিড়িয়াখানার বাঘের ছবি আজ ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। গরমে জলহস্তী হয়ে গেছে বাঘ। পানিতে নেমে পড়েছে। বৃষ্টি নামল এই বাঘ এবং অন্যান্য প্রাণিকুলের জন্য। ঝুম্ম্ম্ম্ম্ বৃষ্টি।

২য় কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৪১৩ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।