ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কবিতা ও জীবনাচরণে এক অনন্য নারী সুফিয়া কামাল | ফজলুল হক সৈকত

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪২ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫
কবিতা ও জীবনাচরণে এক অনন্য নারী সুফিয়া কামাল | ফজলুল হক সৈকত

বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যকর্মী এবং সমাজসেবক কবি সুফিয়া কামালের [২০ জুন  ১৯১১-২০ নভেম্বর ১৯৯৯] জন্ম বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে। তাঁর মায়ের নাম নবাবজাদী সৈয়দা সাবেরা খাতুন।

বাবা সৈয়দ আবদুল বারি। পৈর্তৃক নিবাস বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। শৈশবে নানার বাড়িতে থাকাকালে বহুভাষায় পণ্ডিত বড়মামার সান্নিধ্য এবং তাঁর সমৃদ্ধ লাইব্রেরির সংস্পর্শে সুফিয়া জ্ঞানচর্চার প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। আগ্রহ আর প্রচেষ্টার ফলে তিনি ক্রমান্বয়ে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তোলেন। মায়ের সহযোগিতায় বাংলা ভাষাও ভালোভাবে রপ্ত করেন তিনি। আর তখন থেকেই, গ্রন্থ-পত্রিকা পড়তে পড়তে সাহিত্যচর্চায়ও অনুপ্রাণিত হন। পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা, রক্ষণশীলতার কঠোর-কঠিন বেড়াজাল আর সামাজিক সংস্কার ভাঙার চিন্তা হয়তো তিনি শৈশবের পাঠনিবিড় পরিবেশেই আত্মস্থ করেছিলেন।

সমাজলগ্ন এবং রাষ্ট্রচিন্তক সুফিয়া কামালের ভাবনা-পরিসর মানবকল্যাণের মহাপথে প্রসারিত ছিল। মসৃণ ও নিরাপদ ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। ব্যক্তিস্বাধীনতাবোধ আর জ্ঞানী-গুণীদের সঙ্গে পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ তার উপলব্ধির প্রখরতা নির্মাণে সহায়ক শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন; মর্যাদার দৃষ্টিতে মূল্যায়নও করতেন। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মরাজি বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে। রবীন্দ্র-নজরুল যুগের এই নরমকণ্ঠ কবি তিরিশোত্তর ধারায় কবিতা না লিখেও আপন আসন স্থিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন সৃজনশীলতা আর চিন্তা-সামর্থ্যরে কারণে। সমাজ-সম্পৃক্ততা তাঁর চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য। কবি ছাড়াও তিনি ছিলেন সমকালের প্রশংসনীয় সমাজসেবক-সমাজসংস্কারক। ‘সাঁঝের মায়া’ (১৯৩৭) তাঁর সর্বাধিক প্রচারিত ও পরিচিত কবিতাগ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য কাব্যগুলো হলো : ‘মায়া কাজল’ (১৯৫১), ‘মন ও জীবন’ (১৯৫৭), ‘উদাত্ত পৃথিবী’ (১৯৬৪), ‘দীওয়ান’ (১৯৬৬), ‘প্রশান্তি ও প্রার্থনা’ (১৯৬৮), ‘অভিযাত্রিক’ (১৯৬৯), ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ (১৯৭০), ‘মোর যাদুদের সমাধি ’পরে’ (১৯৭২)।

প্রকৃতি-রোমান্টিকতা-প্রেমবোধ-সংসার-বিরহ-যন্ত্রণা-সমাজের অগ্রগমণ-ভাবনা তাঁর কবিতাভুবনের প্রধান প্রধান উপাদান। উপন্যাস, নাটক, শিশুতোষ রচনা, দিনলিপি, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী তাঁর সৃজনঝাঁপির ওজন ও মূল্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। এছাড়া ইংরেজি-রুশ-জার্মান-ইতালীয়-পোলিশ-চীনা-ভিয়েতনামি-হিন্দি-উর্দু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতা বিশ্বসাহিত্য-পরিমণ্ডলে বাঙালির সৃজনশীলতার ঐতিহ্যবিস্তারধারাকে সম্প্রসারিত করেছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের যাতনা-গ্লানি তাঁর কবিতাযাপনের প্রথমপর্বের আশ্রয়ভূমি হলেও পরবর্তীকালে তিনি জাতীয় জীবন এবং রাষ্ট্রের বহুবিধ অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম-অর্জনকে আত্মস্থ করেন সাফল্যের সাথে। আর সম্ভবত ‘সাঁঝের মায়া’ কবিতায় রোপিত হয়েছিল সে বীজ। তিনি লিখেছেন : ‘মুক্তি লভে বন্দী আত্মা—সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজনে,/ নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক, পুষ্প-বিকাশের প্রয়োজনে। ’

সাত বছর বয়সে সুফিয়ার কবিতা রচনার আরম্ভ। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম লেখাটি ছিল একটি ছোটগল্প। যখন তাঁর বয়স মাত্র বারো বছর, তখন বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সৈনিক বধূ’ গল্পটি। তার প্রায় তিন বছর পর ‘সওগাত’ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর ‘বাসন্তী’ নামক কবিতা। সেই থেকে শুরু। তারপর কত পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে—শিল্পের পথ, কবিতার পথ, সৃজনের পথ, প্রতিবাদের পথ। সাথে পাথেয় হিসেবে রেখেছেন অনুভব-জ্ঞান; তাঁর ভাষায় :
‘প্রিয় বিরহের নিশি হয়ে আসে মিলন স্বপ্নে ভোর,
আর খেদ নাই, এই মুছিলাম দু’নয়ন হতে লোর।
নব প্রভাতের রবিকরে জাগা এ জীবন ওঠে জেগে,
পৃথিবীর পথে কত যে বিথার, কাল চলে কত বেগে!
আমিও তো আছি বিপুল ভুবনে, বিশাল কর্ম পথে
চলিতে হইবে, কত দিন রাত শেষ নাহি হতে হতে—’ (প্রিয় বিরহের নিশি)
সময় যেন তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ; শেষ করতে হবে কাজ। তাই নেই কোনো অবসর। সত্যিই, সুফিয়া কামাল যেন অবসরযাপন একরকম ভুলেই থেকেছেন সারাটি জীবন। তাঁর কর্মময়-বর্ণাঢ্য জীবন আমাদেরকে তো সেরকমই ভাবতে বাধ্য করে।

বাঙালি নারীর সংগ্রামী ইতিহাসে সুফিয়া নিঃসন্দেহে এক অনন্য নাম। অনুভব-জ্ঞানের স্বচ্ছতা-প্রখরতায় তিনি সমাজের অনগ্রসর এবং পরাধীনতার শেকলে বাঁধা মানুষের জন্য কাজ করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। ধর্মান্ধতা আর অপ্রতিরোধ্য কুসংস্কার তাঁর ভাবনাবলয়কে দারুণরকম প্রভাবিত করেছিল। পূর্ববাংলা-পূর্বপাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে নারীর অধিকার আর মর্যাদা আদায়ের দাবি উত্থাপন এবং আন্দোলনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রগতিশীল আন্দোলন ছিল তাঁর আরাধনার প্রাণভূমি। অনিয়ম-অন্যায়-অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চারকণ্ঠ। সমকালীন সব গণতান্ত্রিক, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম, নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, মানবমুক্তি, বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনে আর শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের পথনির্মাণ-প্রচেষ্টায় কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

ব্রিটিশবিরোধী-আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন, সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ (পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন), ছয়দফা-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা-সংগ্রাম, সামরিক-শাসনের বিরোধীতা প্রভৃতি গণ-জাগরণমূলক প্রতিবাদী অভিযানে তিনি ছিলেন অগ্রগামী সাহসী মানুষের প্রধান কাতারে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন; মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস বন্ধের দাবিতেও সুফিয়া ছিলেন প্রবল সোচ্চার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁকে কখনো মাথা নোয়াতে হয়নি; কোনো প্রলোভনেও হননি পরাভূত—অপরিসীম সাহস আর প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই কবি মানসিকভাবে ছিলেন বলীয়ান। ভয়-লোভ-হতাশাকে কোনোদিনই প্রশ্রয় দেননি কবি সুফিয়া কামাল। বাস্তবকে তিনি চিনে নিতে ভুল করেননি; বুঝে নিতেও বিলম্ব হয়নি তাঁর। তাঁর উপলব্ধিতে আমরাও মিশে যেতে পারি এভাবে :
‘কালচক্রে আবর্তিয়া বয়ে চলে জীবন-প্রবাহ,
সুখ-দুঃখ শান্তি-তৃপ্তি অন্তরের দারুণ প্রদাহ
চলে সাথে সাথে
পুরাতন রাত্রিশেষে, প্রত্যাসন্ন দিনের প্রভাতে। ’ (বৈশাখী নিশিথ)
অদম্য মেরুদণ্ডের ধারক (পিঠে হাড় থাকাকে মেরুদণ্ড বলে না; এটি একটি ধারণার নাম—সত্যের পথে অবিচল অবস্থান আর মানবতার অধিকার-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ন্যায়-সঙ্গত, যুক্তিযুক্ত মানসিক-শারীরিক স্থিতিকে প্রকাশ করে এই অভিজ্ঞানটি) কবি-সমাজকর্মী সুফিয়া কামাল জাতীয় সংকটকালে, সামাজিক বিচিত্র স্থবিরতায় উদ্ভাবনী মনোবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন; পলায়নি মনোভাবের জড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েননি। কোনো অসদাচরণের সাথে কখনো আপোস করেননি তিনি। অকুতোভয় এই সৈনিক সাহিত্যপথে আর সমাজ-রূপান্তর-ভাবনায় স্বদেশ আর নিজ-সংস্কৃতির পথ-পরিক্রমায় অবদান রেখে গেছেন আমৃত্যু। আপাত সুখ, তথাকথিত সামাজিক সাফল্য, সমূহ সুবিধার হাতছানি তিনি সচেতনভাবে পরিহার করে চলেছেন আজীবন। সব ধরনের কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, মৌলবাদ, অবিচারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সত্য-কল্যাণ আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থা নির্মিতিতে তিনি ছিলেন নিবেদিত-প্রাণ কর্মী। স্বদেশ আর সমাজ ছিল সুফিয়ার ব্যক্তিজীবনের আরাধ্য; সাহিত্যচিন্তার পাথেয়। সমাজপরিবর্তনে চিন্তাবিনিয়োগের পথে পা বাড়াতে তাঁকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল বিশ্বখ্যাত কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়র, নোবেল বিজয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কর্ম ও ভাবনা-পরিসর।

‘সর্পিল রঙিন পথ পৃথিবীর মানুষের তরে/ বাঁকে বাঁকে ভ্রান্তি, শ্রান্তি, তবু কত বিস্ময়ের ভরে/ দিগন্তে প্রসারি দৃষ্টি সুন্দরের পথপানে চাই!’ (পৃথিবীর পথ)—এই অভিব্যক্তি কবি সুফিয়া কামালের। তিনি জানতেন সমাজ-সভ্যতার, মানুষের অগ্রগমন সহজ নয়; বিচিত্র বাধা আর জটিলতা অতিক্রম করতে হয় চলার পথে। তাই তিনি সর্বদা সাথে রেখেছেন অসীম মনোবল আর এগিয়ে চলার প্রতিজ্ঞা। ‘অতীতের পথ-চলার সুখদুঃখময় সুদীর্ঘ পথের স্মৃতি’র ওপর ভর করে দারুণ সব সংশয় দুহাতে সরিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছেন জীবনের পথে; শিল্পের অভিযাত্রায়। সৃষ্টিকর্তা-সুন্দর-বিকাশ-প্রসন্নতা তাঁর কবিতার ভাষা আর কাঠামো নির্মাণ করেছে অনবরত; যেন কোনো অধরা প্রেরণা তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে সব সুন্দরের—সব সম্ভবের আবাহন বারতা। তিনি কেবল এক শিল্পশ্রমিকের মতো প্রকাশ করছেন কবিতা-আচ্ছন্নতা।

প্রকৃতির প্রসন্নতা আর সমূহ সৌন্দর্য সুফিয়ার কবিতাচর্চার এক প্রধান প্রেরণা। ঋতু-বৈচিত্র্যের ক্রম-রূপান্তর তাঁকে মোহাবিষ্ট করেছে কখনো কখনো; মানসিক পরিভ্রমণ আর গ্লানিমোচনের ইচ্ছা থেকেও তিনি নিসর্গলগ্ন হয়ে পড়েছেন কোনো কোনো অবচেতন প্রহরে। কিন্তু চারপাশের দেখাজগৎ আর জানাজগৎকে তিনি অনুভব করেছেন সামাজিকের দৃষ্টিতে; বিবেচনা করেছেন দায়িত্ববানের ভঙ্গিতে। তাঁর সমাজ-অভিনিবেশ প্রবণতাটি কবিতাযাপনের প্রথম-পর্ব থেকেই, এভাবে হয়তো তাঁর অলক্ষ্যেই, গড়ে উঠেছিল। ‘ফুল-ঝরা-পথে’ কত না-বলা কথার কলরব মিলিয়ে যায়, তার খবর কে রাখে? সুফিয়া যেন তরুর মর্মের মাঝে’ শুনতে পান ‘আনন্দের মধুর সঙ্গীত’। ব্যর্থতার পরিহাস তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি; আচ্ছন্ন করতে পারেনি তাঁর চলার বিপুল মানসিক আয়োজনকে। কেননা, তিনি বিশ্বাস করতেন—‘রাত্রি শেষে উড়িবে সে নাহি-জানা অন্যদিক্ পানে,/ ব্যাধের আঘাত ভয়ে—নীড় নহে, আশ্রয় সন্ধানে। ’ আশ্রয়-প্রত্যাশি কবি সুফিয়া কামাল জীবনের দীর্ঘ প্রহরে শুধু সাজিয়েছেন আশার বারতা।

প্রশাসনিক প্রতিকূলতা আর সামাজিক কূপমণ্ডুকতার আবর্তে বাঙালি জনজীবন যে ক্রমান্বয়ে হিমশীতল অন্ধকারের গভীরে নিপতিত হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রাগ্রসর চিন্তার ধারক ও লালনকারী কবিতাকর্মী সুফিয়া কামাল। তিনি দেখতে পেয়েছেন আমাদের চারপাশের পরিচিত অধ্যায়গুলো দিন দিন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে; যেন ধরা যাচ্ছে না কিছুতেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর ঐতিহাসিক-ঐতিহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির এই অভিব্যক্তি তাঁর কবিতায় আমরা প্রকাশ পেতে দেখি :
‘এখানে অনেক মেঘ—
ঢাকার আকাশে এখন অনেক মেঘ—
এ মেঘ এসেছে দখিন সাগর হতে,
সেখানে তোমার অনেক দীর্ঘশ্বাস
দিনে দিনে জমে মেদুর করেছে
ছেয়েছে এই আকাশ। ’ (অকাল মেঘ)
দেশীয় পরিমণ্ডল পেরিয়ে সুফিয়ার কবিদৃষ্টি আন্তর্জাতিক পরিসীমায়ও প্রসারিত ছিল। সমকালীন বিশ্বরাজনীতি এবং সভ্যতার ক্রমাগ্রগতি ও অনিবার্য আঘাতের চিহ্ন তাঁর কবিতায় বুলিয়েছে চিন্তার প্রলেপ; অভিশাপ আর অবদমনের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি থেকে মানবতার মুক্তির আনন্দ আশাবাদের প্রেরণা হিসেবে হাজির হয়েছে তাঁর কবিতা-পরিসরে। দূর আফ্রিকার মানুষের কষ্ট আর প্রাপ্তির প্রসন্নতাকে তিনি তুলে আনছেন এভাবে :
‘আফ্রিকার কালো বুকে জ্বলিয়াছে আলো, রাত্রি শেষ
মুমূর্ষু সিংহের চক্ষে মৃত্যুর আবেশ।
সে আবেশ ক্লান্তি নয়, জীবনের অদম্য ইশারা
আফ্রিকার ঘনারণ্যে জাগাইয়া তুলিয়াছে সাড়া। ’ (লুমুম্বার আফ্রিকা)
জাতি-রাষ্ট্রের পরাধীনতা-শোষণের পথ-পরিক্রমায় সুফিয়া ছিলেন শান্তি-অন্বেষার প্রতীক। ব্রিটিশকবলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, দেশভাগ-পরবর্তীকালে শাসক-শোষকের হাতবদলে পাকিস্তানের অবদমননীতি এবং পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক আচরণের দিন-সমাপ্তির আবাহন-ইঙ্গিত দাগ কাটে তাঁর কবিতা-কাঁথায়। ভারত-পাকিস্তান বৈরি-সম্পর্কেরকালে তিনি অনুভব করেন আসন্ন গণ-জাগরণ এবং মুক্তির সুবাতাস। কবি লিখছেন : ‘আর নাই দেরি,/ গভীর রাত্রি শেষ হয়ে এলো, এবার প্রভাত ফেরী/ শোনা যায় ওই। পূর্ব অচলে প্রভাত রবির কর/ দিগন্তব্যাপি আঁধার নাশিয়া আসিছে তিমিরহর। ’ (কারান্তরালে জমীলা) অতঃপর ’ঊনসত্তুরের এই দিনে’ কবিতায় তিনি গণ-অভ্যুত্থানের জন-আবেগ সম্বন্ধে জানাচ্ছেন : ‘শুনি সেই অবিনাশী বাণী/ অন্তর উদ্বেল হয়ে প্রাণাবেগ করে কানাকানি,/ জনতা সমুদ্রে জাগে ঢেউ,/ দিতে এ পাথার পাড়ি পশ্চাতে রবে না আর কেউ। ’

‘বাতাসে বারুদ’, ‘ধূলায় রক্ত’ মায়েদের খালি কোল, প্রার্থনার ভঙ্গি, অশ্রু-অবিনাশী, ভেসে-বেড়ানো অফুরন্ত সঙ্গীত, উত্তাল রাজপথ আর নদীর প্রবাহধারা দেখতে দেখতে; ‘বাংলা অমর মহান’ খুঁজতে খুঁজতে কবি সুফিয়া কামাল সমাজের কল্যাণমালা গলায় পড়ে পাড়ি দিয়েছেন অনেকটা পথ। ঘরে-ঘরে, দ্বোরে-দ্বোরে জয়টীকা অর্পণের আশা-যাপনের মাহাত্ম্যে আর ‘মাটির দেনা’ শোধ করার প্রত্যয়ে তাঁর কবিতা কাল ও কালোত্তরে বহন করবে অশেষ শক্তি; ‘দানবের অস্ত্রের আঘাতে অঙ্গহীন, সঙ্গীহীন, সহায়-সম্বলহারা’ অগণন যুদ্ধাহতের এই দেশে গৌরবের উদ্বিগ্ন ব্যথায়-আনন্দে নতুন প্রজন্মকে জানাবে উদার আহ্বান। কেননা, তাঁর বিশ্বাস :
‘একদা অরণ্য কন্যা জাগিয়া জ্বালিবে দাবানল
দলিতা নাগিনী তার নিঃশ্বাসে ছড়াবে হলাহল।
যত দীর্ঘ হোক দিন, একদিন হবে অবসান
রুদ্ধ হবে মূঢ়তার আত্মম্ভরিতার জয় গান!’ (অরণ্য কন্যারা জাগে)
অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র, যোগ্যব্যক্তির মূল্যায়ন, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা প্রবর্তন-প্রচেষ্টার এই মহাকালে তাঁর এই অনুভব এক অসামান্য ভবিষ্যৎবাণী।

রাষ্ট্রীয় গণ-আন্দোলনে নেতৃত্বদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবি সুফিয়া কামাল পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মান; সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে ‘লেনিন পুরস্কার’ প্রদান করে। এই বিরল সম্মানের পুরস্কার বাংলাদেশের আর কেউ লাভ করেননি। জাতীয় জীবনে চলার পথে তিনি মাতৃহৃদয়ের কোমলতা আর অপরিসীম সাহস নিয়ে সর্বদা অগ্রগামি থেকেছেন; ক্রমাগত নির্মাণ করেছেন ভূমিকাবহুল বৈচিত্র্যঘন যাপিত-জীবন।

দুর্দিনে এবং সংকট-কালে সুফিয়া কামাল জাতিকে অন্ধকারের বিভীষিকা থেকে মুক্ত করে আলোর পথে দাঁড় করাবার জন্য যে পরামর্শ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা নিশ্চয়ই প্রজন্মান্তরে অনুকরণীয়-অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শোষণ-বৈষম্যহীন এবং মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষা-পদ্ধতি প্রবর্তন, নারী-পুরুষের সমান মর্যাদাপূর্ণ সমাজ-কাঠামো নির্মাণ, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণসহ সমকালীন যাবতীয় প্রগতিশীল চিন্তাধারায় সুফিয়া কামালের জীবনাদর্শ আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর স্বপ্ন ধারণ করে; আজকের প্রজন্ম তাঁকে নতুন করে চিন্তা-কাঠামোয় স্থান দিতে আগ্রহী ও সচেষ্ট হলে বাংলাদেশ-বাংলাভাষা আর বাঙালি পেতে পারে নবতর-প্রত্যাশিত প্রতিষ্ঠার পথ-নির্দেশ।



বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।