ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দিল্লি বুয়া | পলাশ মাহবুব

রম্যগল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩১ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫
দিল্লি বুয়া | পলাশ মাহবুব

আম্মার বুয়া ভাগ্য ভয়াবহ।

তিনি মাঝে মাঝে আফসোস করে বলেন, আল্লায় অনেক কিছু দিছে কিন্তু বুয়া ভাগ্য দেয় নাই।

ওই উছিলায় শান্তিও দেয় নাই। আম্মার ভাষায়, শান্তি আর অশান্তি দুটোর মূলেই আছে বুয়ারা। যেহেতু তার বুয়া ভাগ্য খারাপ সেজন্য তিনি আছেন অকূল পাথারে। আম্মার কথায় আমরা বুঝতে পারি, বুয়া ভাগ্যই তার অশান্তির মূল কারণ।

আমাদের বাসায় সর্বশেষ যে বুয়া ছিল সে কানে কিছুটা কম শুনত। এক কথা তিনবারে শুনত। তাও পুরোটা না। ডাল রাঁধতে বললে চুলায় চাল চড়িয়ে দিত। দোকান থেকে ডিম আনতে বলতে ভিম নিয়ে হাজির হতো।

তবে আমাদের কথা শুনতে না পেলে কী হবে, লো ভলিউমে চলা হিন্দি সিরিয়ালের ডায়লগ সে ঠিকই শুনতে পেত। কোনো ডায়লগই তাকে দু’বার বলতে হতো না। সে সুযোগও নেই। হিন্দি সিরিয়ালের প্রতিটি দৃশ্যে সে নানাভাবে আলোড়িত হতো। কখনো হাসত কখনো তার দু চোখ ছলছল করত। কখনো কখনো বিরক্তি আর রাগে সিরিয়ালের কোনো চরিত্রের গুষ্টি উদ্ধার করত।

আমাদের বাসায় সিরিয়াল দেখা দোষেয় কিছু না। তাছাড়া কাজে ঢোকার আগে বুয়ার শর্তই ছিল টানা কাজ করতে পারবে না। বিনোদনের সুযোগ দিতে হবে। বিনোদন মানে দুই চ্যানেলের দুই সিরিয়াল। সিরিয়াল দেখা নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা হতো সিরিয়াল দেখার পরে।

প্রতিটি হিন্দি সিরিয়ালই কমপক্ষে দশ বছরের টার্গেট নিয়ে পর্দায় উপস্থিত হয়। যে কারণে প্রতিটি পর্বেই কোনো না কোনো প্যাঁচ লাগানো হয় সেসব সিরিয়ালে। প্যাঁচের কারণে তৈরি হয় জটিলতা। আর সেই জটিলতা প্রভাব ফেলে বুয়ার ওপর। সিরিয়াল দেখে প্রথমে বুয়ার মুখ কালো হয়। তারপর হয় মন ভারি। সবশেষ তার দু চোখ দিয়ে ভারি বর্ষণ। তার কান্না দেখে মনে হয় এইমাত্র কোনো নিকটাত্মীয়র মৃত্যু সংবাদ পেয়েছে।

তাতেও আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না। যদি না সেই প্রভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে খাবারের ওপর গিয়ে পড়ত। সিরিয়ালের কাজের বুয়ারাও সেজে-গুজে থাকে। তাদের রান্নার ঝামেলা নেই। আমাদের বুয়াকে সেই ঝামেলা পোহাতে হয়।

একে তো সিরিয়ালের প্যাঁচে পড়ে মন খারাপ। তারওপর রান্নার ঝামেলা। চাপা কষ্ট নিয়ে চুলায় হাঁড়ি চাপায় বুয়া। যার পুরো চাপটা গিয়ে পড়ে রান্নার ওপর। যে চাপ রান্না করা খাবারের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয় না। আর যারা খাবার খায় তাদের পক্ষেও না। এ নিয়ে বুয়াকে অনেক কথার চাপ দেয়া হয়েছে। ফলাফল হয়েছে আমাদের রিজিয়া বুয়া নিউটন হয়ে আমাদের মাঝে ধরা দিয়েছে। প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। পড়াশোনা না জানলেও এই বিষয়টা কিভাবে যেন জেনে গেছে রিজিয়া। আমাদের বলপ্রয়োগ তাই কোনো রকম ফল প্রয়োগ করে না।

দিন দিন সিরিয়ালের জটিলতা যত বাড়ে বুয়ার খাবারের মানও তত পড়তে থাকে। খাবারের মান এবং আমাদের জান বাঁচাতে রিজিয়া বুয়াকে একদিন বিদায় করতে হয়। নতুন বুয়ার সন্ধানে নামেন আমাদের আম্মা। শর্ত একটাই আর যাই হোক হিন্দি সিরিয়াল দেখার অভ্যাস থাকলে লালকার্ড। লালকার্ড হাতে নিয়ে আমাদের আম্মা বুয়া খুঁজতে থাকেন। অনেক খোঁজখুঁজি করে এক বুয়ার সন্ধানও পেয়ে যান তিনি। আম্মা খুশি। কারণ নতুন বুয়ার হিন্দি সিরিয়াল দেখার অভ্যাস নেই। তবে এই বুয়া সাক্ষাত হিন্দুস্থান ফেরত।
দিল্লিতে কোনো এক বাসায় অনেকদিন কাজ করেছেন। ভিসা বা এ সংক্রান্ত জটিলতায় তার দিল্লিবাস দীর্ঘতর হয়নি। পোটলা-পুটলি নিয়ে তাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছে।

কিন্তু স্বদেশ  প্রত্যাবর্তন তার জীবনে নতুন কিছু দেয়নি। দিল্লি ফেরত হলেও পুরাতন পেশাতেই ফিরতে হয় তাকে।

এদিকে দিল্লি ফেরত বুয়া পেয়ে আম্মার পাশাপাশি আমরাও আনন্দিত। দিল্লির লাড্ডুরই যেখানে এত কদর। দিল্লির বুয়া তো সেখানে কেজির ওপর কিলোগ্রাম। আশপাশের দশ বাসায় অহেতুক বুয়া প্রসঙ্গ তুলে গল্প করি আমরা। উদ্দেশ্য একটাই। আমাদের বুয়া যে আর দশ বাসার বুয়াদের মতো গঞ্জ-গাঁয়ের না সেটা জানান দেয়া।

নিয়োগ পাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর দিল্লি বুয়া কাজে যোগ দেয়।

আশায় বুক বাঁধি আমরা। আম্মার বুয়া ভাগ্য এবার ফিরবে। ‘দিল্লি বুয়া’র কল্যাণে বাসায় ফিরে আসবে হারানো খাবাবের মান। সাথে বাড়তি পাওনা হিসেবে দিল্লিও আইটেম। কিন্তু না। দিল্লি সম্পর্কে আমাদের যে উচ্চ ধারণা ছিল তার প্রায় পুরোটাই দিল্লি বুয়ার কারণে ধুয়ে-মুছে গেল। সিরিয়াল দেখার কারণে আগের বুয়ার রান্না খারাপ হলেও দিল্লি বুয়ার রান্না কোনো কারণ ছাড়াই খারাপ। প্রায় অখাদ্য। আমি নিশ্চিত ভিসা নয়, রান্না সংক্রান্ত কারণেই তাকে দিল্লিচ্যুত করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে বুয়ার কোনো মাথাব্যাথা নেই। তার ঠাট-বাট অন্যরকম। কথা বলেন প্রায় হিন্দিতে। কথায় কথায় ঢাকা আর দিল্লির তুলনা করেন। আমাদের কাছে যা প্রায় দুর্বোধ্য। তার রান্না খাবার যেমন খেতে পারি না তেমনি তার অর্ধেকের বেশি কথা বুঝি না।

বুয়ার হিন্দি বুঝতে এবার হিন্দি সিরিয়ালের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন আমাদের আম্মা। আমাদের চেনা-জানা আম্মা বদলে যেতে শুরু করেন। তার মুখ দিয়েও মাঝে-মধ্যে বেরিয়ে পড়ে হিন্দি সিরিয়ালের ডায়ালগ। হিন্দিতে আম্মার উন্নতি হলেও রান্নায় বুয়ার উন্নতি হয় না। তবে বুয়ার একটা জিনিস খাদ্যের পর্যায়ে আছে, লাড্ডু। দিল্লি ফেরত বুয়া প্রমাণ করেছেন তিনিও দিল্লির লাড্ডুর মতো। উভয় ক্ষেত্রেই পস্তানো কমন। আর আমাদের আম্মা আবারও প্রমাণ করেছেন, তার বুয়া ভাগ্য ভয়াবহ।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।