ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ (শেষ কিস্তি)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৮ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৫
বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ (শেষ কিস্তি) অলংকরণ : মাহবুবুল হক

আগের কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন


১০.
বাসস্টপে একটা পুলিশের গাড়ি।
আবার চেকপোস্ট!
না।


পুলিশ নেই পুলিশের গাড়িতে।
বৃষ্টি বাড়ছে, কমছে, বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এ দেখি আষাঢ় না আসতেই আষাঢ় মাসের বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল!
হোক।
কত লাখ বছর বৃষ্টি হয়ে না আমাদের পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়েছিল?
‘গাছের একটা পাতাও কি তোমাদের কথায় নড়ে, তোমাদের পৃথিবী বলো কেন তাহলে? পৃথিবীটা হলো ঈশ্বরের। ’
বাণী চিরন্তনী।
কে দিয়েছিলেন?
কিয়োর্কেগার্দে?
সম্ভবত।
কথা হলো, পৃথিবী ঈশ্বরের সৃষ্টি। ঈশ্বর ক্রিয়েটিভ। ক্রিয়েটিভ মানুষরা কিছুটা হলেও ঈশ্বরের মতো।
ঈশ্বর কি স্কিৎসোফ্রেনিক?
এ নিয়ে একটা বাহাস করা যায় ছাদে। বক্তা থাকবে, শাকিল, তরলদা, ভাই এবং আঁতেলস্য আঁতেল বগা ওয়াদুদ।
গাড়ি ফ্লাইওভারে ওঠল।

ফ্লাইওভার। ফ্লাইং জোন! ঘটনার শেষাংশ। হা! হা! হা! ক্রিয়েটিভ একটা ঘটনা কত ক্রিয়েটিভভাবে শেষ করা সম্ভব, দেখুক মানুষজন, মিডিয়াকর্মীরা। ব্যাপক একটা প্রচার প্রচারণা হবে। সরগরম থাকবে কিছুদিন মিডিয়া। জ্বালাময়ী কলাম লেখা হবে, টকশোঅলারা দুঃখিত গলায়, রাগান্বিত গলায়, শঙ্কিত গলায় ‘টক’ দেবে।

ভাই, তরলদারা কী করবেন? সান্ত্বনাদানকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? ‘অসহ্যকর’ হয়ে যাবে তাহলে ব্যাপারটা। বুঝতে হবে এটা ফেসবুকিং না, আর্টওয়ার্ক পর্যায়ের ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে অতি সূক্ষ্মভাবে প্ল্যান করে ঘটানো হয়েছে।

হেড লাইট অফ করে দিল গাড়ির।
গান দিল সিডি প্লেয়ারে।
সানশাইন। জন ডেনভারের।
সানশাইন অল মাই শোল্ডারস মেকস মি হ্যাপি
সানশাইন ইন মাই আইজ ক্যান মেক মি ক্রাই...
অন্ধকার এবং বৃষ্টির মধ্যে সানশাইনের গান।
দারুণ একটা ব্যাপার।
ফ্লাইওভারের বাংলাটা ভালো হয়েছে। উড়ালপুল। বজ্রবিদ্যুৎ আর বৃষ্টিভর্তি আকাশ। মনে হলো অনেক দিনের বৃষ্টি জমেছিল আকাশে। উজাড় করে নেমেছে। এখানে কী গাড়ি রেখে নেমে যাবে সে?
হাঁটা দেবে বৃষ্টিতে?
কোথায় যাবে?
ইফ আই হ্যাড আ টেইল দ্যাট আই ক্যুড টেল ইউ...
বৃষ্টির জন্মভূমি কোথায় থাকে? ক্রিয়েটিভ এই রাতটার কথা তাকে কখনও বলা যাবে না হয়তো।
বৃষ্টির জন্মভূমি!
কিছু না, ফ্যান্টাসি।
বৃষ্টির জন্মভূমি কী আবার?
পারফেক্ট একটা ফিগার?
‘আমি যদি বৃষ্টির জন্মভূমি হই?’
কে বলল? বউ?
হ্যাঁ।
সানশাইন অন দ্য ওয়াটার লুকস সো লাভলি
সানশাইন অলমোস্ট অলওয়েজ মেকস মি হাই...
থাক।
সিডি প্লেয়ার অফ করে দিল।
গাড়ির হেডলাইট অন করল এবং ভিউমিররে বউকে দেখল।
তাকিয়ে আছে বউ!
সবুজ চোখের মণি বউয়ের!
মনে হলো সবুজ রঙের জোনাকি। জ্বলছে।
হ্যালুসিনেশন!
স্কিৎসোফ্রেনিয়া!
বউ বলল, ‘কী? আমি যদি বৃষ্টির জন্মভূমি হই?’
‘তুমি আসলে কথা বলছো না, ইলা। আমি এটা কল্পনা করছি। ’
‘কল্পনায় যদি আমি বৃষ্টির জন্মভূমি হই?’
‘চুপ করো। ’
‘চুপ করব? কেন? আমি তো আর কিছু করতে পারব না। ’
‘কথা বলছো কেন তাহলে?’
‘কথাও বলব না?’
‘না। ’
‘তুমি এখন কী করবে? গাড়ি এখানে রেখে চলে যাবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘চলে যাও। ’
‘যাবই তো। ’
‘তাই নাকি?’
বউ হাসল। খিলখিল করে হাসল।
‘বৃষ্টির জন্মভূমি কে হয় গো?’
গরু বহনকারী দুটো ট্রাক চলে গেল।
গরু কি ফ্লাইওভার বুঝে?
ট্রাকে গরুই গেল? না, মহিষ?
গরু?
মহিষ?
গরু?
মহিষ?
গরুরা নাকি মৃত্যু টের পায়।
সব প্রাণীই মনে হয় পায়।
মানুষ ছাড়া।
বউ টের পায়নি একটুও।
এক সেকেন্ড আগেও।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই বউকে মেরে ফেলেছে সে। চোখের সবুজ মণিতে দুনিয়ায় সব বিশ্বাস নিয়ে মরেছে বউ। কিভাবে মরেছে? কে বলতে পারবে? পুলিশ? ডিবি? হা! হা! হা! পুলিশ-ডিবি কি এত ক্রিয়েটিভ? কিছুদিন আগে এক ডিবি অফিসার আর তার বউকে তাদের টিনএজার মেয়েটাই মেরে ফেলেছে। অকর্মার দল!

আচ্ছা, ক্রিয়েটিভ একটা ঘটনার তদন্ত ক্রিয়েটিভ একজন মানুষ করলে হয় না? যেমন ধরা যাক কবি মারজুক রাসেল!
হা! হা! হা!
ফান!

ফোন করতে হবে বউয়ের ধুমসী বোনটাকে। ফিগার সাইজে আনতে সকালে উঠে এক্সারসাইজ করে ধুমসী। ট্রেডমিল করে। তবে এখন মনে হয় করে না। আপাতত তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব।

ধুমসীকে ফোন করে দুঃখ সহকারে কান্না দিতে হবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
গাড়ি রাখল।
নেমে যাবে এখন।
লাইট অফ করে দিল গাড়ির।
বউ বলল, ‘এই!’
‘বলো!’
‘সত্যি তুমি চলে যাবে গো?’
‘অসহ্য! হ্যাঁ। চলে যাব। ’
‘এমা! রাগ করে কথা বলছো কেন তুমি? আমার কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছো?’
‘বিরক্ত হবো না? মরা মানুষ কথা বললে বিরক্ত হবো না? তুমি মরে গেছ তিন ঘণ্টা আগে। তুমি এখন কেন কথা বলবে? এটা কি বাস্তবসম্মত হলো?’
‘সব কী বাস্তবসম্মত হয়? আমাকে মেরে ফেললে কেন বলো তো? থাকতাম আর কয়েকটা দিন। ’
‘থাকো। এভাবে থাকো। ’
‘তুমিও থাকবে। ’
‘কী?’
‘তুমিও থাকবে। আমার সঙ্গে থাকবে। ’
‘তোমার সঙ্গে থাকব মানে?’
বউ হাসল, ‘ক্রিয়েটিভ, ক্রিয়েটিভ সাহেব। ক্রিয়েটিভ প্ল্যান। কে সন্দেহ করবে? বৃষ্টির জন্মভূমি। হ্যাঁ?’
‘উল্টাপাল্টা এসব কী বলছো তুমি? কারোর জন্য না। আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি, ক্রিয়েটিভ একটা চিন্তার জায়গা থেকে। এভাবে আর্টওয়ার্ক হয় কি-না দেখতে। ’
‘কী দেখলে? হয়?
হয়েছে না?’
‘তুমি কী নিষ্ঠুর গো!’
‘দুনিয়ার যে কোনো ক্রিয়েটিভ মানুষই নিষ্ঠুর। তুমি বলতে পারবে তুমি কিভাবে মরেছো?’
‘আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি, আমি কী করে বলব, বলো? তুমি কী আমার গলা টিপে ধরেছিলে?’
‘না। ’
‘তাহলে?’
‘রক্তপাতহীন ক্রিয়েটিভ কিলিং। হা! হা! হা!’
‘আসলেও তুমি ক্রিয়েটিভ। এতটা, আমি চিন্তাও করিনি গো। আমাদের বিয়ের আগেই তুমি সবকিছু ভেবে রেখেছিলে, না? বছর দেড়েক আগে আবু ইয়ামিন সেজে এজন্য বাসায় ফিরলে একদিন। তাও আবার আমার জন্মদিনের দিন। আমি যে কী সারপ্রাইজড হয়েছিলাম! বুঝতেই পারিনি কিছু। দেড় বছর ধরে নাটক চলল। তুমি যখন বাসায় থাকো না আবু ইয়ামিন আসে ফ্ল্যাটে। আমার সঙ্গে শোয়। হায়রে!’
‘চুপ করো। ’
‘বলতে, আমি চলে যেতাম। আমার মার কাছে চলে যেতাম। তুমি বিয়ে করে ফেলতে তোমার বৃষ্টির জন্মভূমিকে। কী বলবে তুমি আমার মাকে? আমি চলে গেছি আবু ইয়ামিনের সঙ্গে?’
‘আর কী বলব?’
‘আমার সরলসিধা বোনটাকেও বলবে?’
‘বলব না ধুমসীকে?’
‘কেন গো? আমি তোমার কী ক্ষতি করেছিলাম?’
‘অসহ্য! ওফ!’
‘এখন তো অসহ্য লাগবেই, আবু ইয়ামিন। ’
‘কী?’
‘আবু ইয়ামিন!’
‘আবু ইয়ামিন? আবু ইয়ামিন কে?’
‘কেন? তুমি। তুমি তো আবু ইয়ামিনই তো। ’
‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’
‘মাথা খারাপ? হি! হি! হি! দেখো তুমি আবু ইয়ামিন কি না? তোমার গোঁফ দাড়ি কি নকল? উইগ পরেছো?’
গোঁফ দাড়ি নকল। উইগ পরেছে। টান দিলেই খুলে চলে আসবে।
বউ বলল, ‘উঁহু। ’
‘কী?’
বউ হাসল।
অবশ্যই নকল দাড়িগোঁফ। নকল উইগ।
কিন্তু খুলছে না।
দাড়িগোঁফ খুলছে না, উইগ খুলছে না।
কসরত করল অনেক।
‘কোনো লাভ নেই, ক্রিয়েটিভ সাহেব। তুমি এখন আবু ইয়ামিন। দেখো মিররে। ’
দেখল।
কে এটা?
আবু ইয়ামিন!

ফ্লাইওভারের নিচে একটা পুলিশের গাড়ি ভিজছে বৃষ্টিতে। এই গাড়িতে গাবরু সরদার এবং পুলিশের সেই এসআই আছে। সাধারণ পুলিশ আছে আরো আটজন। গাবরু সরদার ভ্যানে উঠেই তাদের মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেছে। ফেরত দিয়ে দেবে সময়মতো।
সময়মতো!!
তোর সময়মতো।
এ নিয়ে বাটকুটার ওপর মহা চটে আছে পুলিশ ভাইরা। তারা জানে তারা কাকে ধরতে যাচ্ছে? বাটকুটার অপতৎপরতায় বিষয়টা মিডিয়ার ভাইদের জানানো যাচ্ছে না। কিছু লেনদেনের ঘটনা ঘটত। শালা বাটকু!
‘গল্পটা শেষ করা দরকার না এখন?’ বউ বলল।
তাকিয়ে থাকল আবু ইয়ামিন? না সে?
‘গাড়ি স্টার্ট দাও। ’ বউ বলল।
আবু ইয়ামিন বা সে কি রোবট?
নির্দেশ পালন করল।
গাড়ি স্টার্ট দিল।
‘স্পিড বাড়াও, আবু ইয়ামিন... স্পিড বাড়াও... আরো... আরো... আরো... আরো... টার্ন নেবে না... গো এহেড... গো এহেড!’
টার্ন না নিলে সামনে রেলিং। ধাক্কা খাবে গাড়ি। চুরমার হয়ে যাবে।
দ্রুত কাছে চলে আসছে রেলিং।
দ্রুত!
সে দেখল বউ তার পাশে নেই। গাড়িতেই নেই।
বৃষ্টি হচ্ছে।
অন্ধকার।
নীল একটা গাড়ি অন্ধকারে ছুটে যাচ্ছে বৃষ্টির জন্মভূমির দিকে।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।