ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গঘশিল্পকিতাবের পাঠ | শফিকুল কবীর চন্দন

চিত্রকলা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৫
গঘশিল্পকিতাবের পাঠ | শফিকুল কবীর চন্দন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ (মার্চ ৩০, ১৮৫৩-জুলাই ২৯, ১৮৯০)

“শিল্প সৃষ্টির পথ হলো পোঁড়াও আর ধ্বংস করো
 সাদামাটা ধারণা আর তার প্রতিস্থাপনে
 নতুন সত্যে যা মস্তিষ্কের চূড়া থেকে দৌঁড়ে নামে
 আর বেড়িয়ে আসে হৃদয় থেকে। ”
- জন মার্টিন

এই নদীর মালিক তুমি না, এই গম ক্ষেতও তোমার না, এই নরম রোদের আলোর মালিক তুমি আমি কেউ না।

কিন্তু এইসব মিলিয়ে যে আনন্দ, সৌন্দর্য তা সম্পূর্ণ আমাদের। আনন্দিত হতে চাইলে, আনন্দে থাকলে চাইলে সব কিছুর মালিক হতে হবে এমন নয়। কিন্তু গঘের আনন্দের চিত্রকলার মালিক তিনি নিজে হয়েও ছিলেন প্রচলিত অর্থে নিঃস্ব, পক্ষান্তরে গোটা পৃথিবীর শিল্পামোদী মানুষ গঘ কীর্তিকে পরম মমতায় তার মনের অলিন্দে ঠাঁই দিয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো পরিস্থিতিতে সে সব ক্ষেত, নরম রোদের আলো, রোদের রঙ, সূর্যমুখীর দখলিস্বত্বে মালিক না হয়েও তাদের আনন্দের মালিকানা ঘোষিত হয়, এই সাফল্য গঘীয় শিল্পমহালের।

ভ্যান গঘ খালি চোখে রঙের রোদ পোহান। একজন কামেল চিত্রী লোক। তাঁর মধ্যে আপাত অগোছালপনা দেখা যায় হয়ত কিন্তু চিন্তায় ছিলেন একেবারে টান টান। ভিনসেন্ট গরিব গোবরা, চাষা-ভূষাদের আলু, কয়লা, গম, নদী, জমিজিরাতসহ তাঁর ক্যানভাসে হাজির করার বাসনা পূরণ করেন। একজন কমপ্লিট আর্ট ওয়ার্কার হিসাবে যার আবার কারো মহিমার লগেই টাক -টক্কর  দেয়ার টেন্ডেন্সি ছিল না। এটাই বুঝি ছিল তাঁর রিয়েল ফুয়েল।



যেন ক্রুশবাহী এক যিশুর যন্ত্রণাদায়ক একেকটা স্টেশন অতিক্রম, তফাত শুধু ক্রুশের বদলে আঁকার সরঞ্জাম পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই যিশু, যাঁর নাম ভিনসেন্ট। বন্ধু এমিল বের্নাড এর মতে—‘তীব্র মরমিয়াবাদে আলোড়িত হয়ে বিচ্ছিরি সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে হতচ্ছাড়া মানুষদের বাইবেল শুনিয়ে আমার এই বন্ধু শেষ পর্যন্ত ভেবে নিয়েছিল, ও নিজেই যিশু খ্রিস্ট ইশ্বর। ’



কবিতা আর গল্প বিছানো বিকেল জুড়ে এক বেতালা জীবন তাঁর। যে জীবন লালনে পথচারী। কেননা তার গৃহস্থ বোধ শূন্যে। তবু ন্যূনতম নুন, আলু, রুটি, রঙের মাসকাবারি বোধের সাথে উইথ একশন, ড্রইং, স্কেচ, পেইন্টিং। একক যাত্রী। ভ্রুক্ষেপহীন। যেন পৃথিবীর প্রকাশমান চরাচরে রৌদ্রপ্রভায়, হারানো বিভোর ভুবনে আর কেউ নেই। এক পাগল আগন্তুক। একদম ধূলিধূসরিত গেঁয়ো পথে অপূর্ব দ্বিধাহীন। প্রকৃত নাগরিক। কখনো বা মননের বোহেমিয়ানায় ঋদ্ধ, হদ্দ বেকার।

অথচ মুঠো মুঠো ইচ্ছেকে খুচরো করে দেবার জন্য দিবস রজনীকে খামচানোর বিদ্যা আয়ত্ত করতে তাঁর আদিম পেরেশানি ছিল। তাতে বিস্তার পেয়েছিল রঙ রেখার প্রকৌশল। তিনি আচার্যের মতো ঠিকুজি রচনা করতে শুরু করেছিলেন পরবর্তী কালের অবশ্যম্ভাবী এক ভিন্নমাত্রার চিত্রকলাদর্শের।

সাদা কাগজে, ক্যানভাসে গঘীয় রঙের সন্ত্রাস কামিয়াব হচ্ছে তখন। সেটা গঘের শিল্পের দ্বিপ্রাহরিক ওয়াক্তের আগের ধলপ্রহর। যখন আজানের আগে পাখপাখালির প্রভাতি কলরবের প্রাক্কাল গোছের। সেটাই ছিল কোনো ভবিষ্যত বিরলপ্রজ শিল্প সত্যের জন্মকাল। যার শিল্পভাজে তীব্র রাগিনী নিয়া সৃজন উপশমের গাঢ় শৃঙ্খলা খোঁজে এক নিগুঢ় তাপে। ভিনসেন্টের শিল্প বুদ্ধির গোমর ভেঙ্গে সক্রিয় হচ্ছিল, বর্ণস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বেরুচ্ছিল। কোনো চোথামারা কায়কারবার তাতে ছিল না তা বলাই বাহুল্য। আর ছিল না কোনো দিব্য আলস্য।

তাঁর সৃজন তখন জীবনের পত্র লেখে। কোনো নতুন নাজিলের ইশারা খোঁজে। জীবনের ফুসরত খোঁজে। গঘের আত্মার সহচর আঁকা ছবিতে কথারা খলবলিয়ে ওঠে। তাঁর অস্তিত্ব তোলপাড় করা অস্বস্তিদায়ক এক নিনাদ হয়। নাম গোত্র সমেত প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়ে যায়।

এমন কোনো নতুন চেতনার আচমকা জন্মের তারিখ, দিন, ক্ষণ সচরাচর উল্লেখিত থাকে না। তাই তাঁর  সৃষ্টির এমন আদিম মৌলিকতায় কোনো হৈ হৈ পড়েনি। আর আকাট বেবুঝ শিল্পব্যাপারীরা তা করবেই বা কেন? হৈ হৈ বিকি বাট্টার সাথে বিখ্যাত হয়ে ওঠার যে যুক্তি তার সঙ্গে আর দশ জনের মতোও সেই বস্তাপচা বিশ্বাসে লালিত হয়েছে তখনকার শিল্পমন। যদিও এসব খাড়া থাকা ধ্যান ধারণা উবে গিয়েছিল একসময়।
 
আমরা কে না জানি, ব্যক্তিগত সুখ ও তৃপ্তির অভাব তাকে চাতালহীন ধরার উপর নাচিয়ে ছেড়েছে। সমকালীন শিল্পীদের থেকে আলাদা, চোখে পড়ার মতো আলাদা মনোভূমি, দর্শন, চেতনা, উপলব্ধি, মুন্সিয়ানায়, সাতন্ত্র্যে একেবারে নতুন ঝকঝকে গঘ। তাঁর নিজের ভাষা জগত, ভাষা পৃথিবী। যিনি আবার তাঁর এই পৃথিবীর মালিকানার ষোলো আনা হক ভুবনমাঝে জারি রাখার দলিলে দস্তখত এঁকে দেন। তাঁর শিল্পমহালের জমিনে মনোনিবেশ করে তার উৎপাদনের মালিকানা স্বত্ব দাবি করতে হয় না। অথচ তাঁর অধিগত হয় এসব স্বত্ব ফত্ত্ব।

বলা বাহুল্য রূপের ‘গুহ্য কায়াসাধনার’ স্পর্শে সুপ্ত যা ভিনসেন্ট সাধুর সঙ্গে প্রকৃতির মৈথুনবাসনার লোকভাষা তৈরির রহস্য। যার জন্য তাঁর ছিল আজন্ম অনুভব, এক চোরাটানের মনপ্রহরা।
 
ভ্যান গঘ এমন এক জগতে বাস করতেন যা তাঁর স্বসৃষ্ট জগতও বটে। যে জগতে বস্তু ও কল্পনা, মাটি ও আকাশ, মানুষ ও প্রকৃতি একই সঙ্গে এক গভীর প্রেম ও প্রীতিময় মৈথুনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বিরাজ করে। যেখানে তার উপলব্ধিজাত নতুন নতুন জীবনাকুতির মর্ত্য দৃষ্টি বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে অন্তর্চক্ষুর তেজোময় দীপ্তি দিয়ে বর্ণায়ণ করেছেন।

তাঁর জীবনের ওয়ানম্যান শো তিক্তভাবেই শিল্পী ও পাবলিকের ভিতরকার স্ফারিত ফাটলটা বিদারক নিঃসঙ্গতার আলেখ্য সিরিজ হয়ে উঠেছে। যেন ক্রুশবাহী এক যিশুর যন্ত্রণাদায়ক একেকটা স্টেশন অতিক্রম, তফাত শুধু ক্রুশের বদলে আঁকার সরঞ্জাম পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই যিশু, যাঁর নাম ভিনসেন্ট। বন্ধু এমিল বের্নাড এর মতে—‘তীব্র মরমিয়াবাদে আলোড়িত হয়ে বিচ্ছিরি সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে হতচ্ছাড়া মানুষদের বাইবেল শুনিয়ে আমার এই বন্ধু শেষ পর্যন্ত ভেবে নিয়েছিল, ও নিজেই যিশু খ্রিস্ট ইশ্বর। ’



বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।