ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

চক্রকেদারা রহস্য | মুহাম্মাদ তালুত

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৫
চক্রকেদারা রহস্য | মুহাম্মাদ তালুত

১.
নৈর্ঋত আহমেদের কথা আপনাদের অনেকেই পুলিশ অফিসার তৌফিক আর সড়ক ও জনপথের প্রকৌশলী ফারহানের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন। আমার সাথেও নৃ’র একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে, যার খানিকটা আপনারা অনেকেই পত্রিকা মারফত জেনেছেন কিন্তু ভেতরের খবরটা বাদে।

সেটাই শেয়ার করতে চাই কেননা অমন চমকদার কাণ্ড আমার লাইফে আর ঘটেনি আর আমি মনে করি ঐ ঘটনার সাথে নৈর্ঋতের যোগসূত্রটা সবার জানা দরকার।

আমি সুষেণ অধিকারী, বিসিএস কাস্টমস ক্যাডারের সহকারী কমিশনার। আর বিসিএস প্রশাসনের সদস্য সদালাপী নৃ’র সাথে আমারও পরিচয় ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ের সময়, চার মাসেই বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি, ওর যেকোন বিষয়ের গভীরে ডুব দেবার অসীম ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তারপর থেকে মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগ হতো। বছর দেড়েক আগে সারা দেশে একটা তোলপাড় হয়েছিল, সবারই মনে থাকার কথা। স্টিলের তৈরি পিস্তল টাইপের একটা ননব্র্যান্ড হ্যান্ডগানে গোটা দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। সন্ত্রাসীরা তো বটেই, আন্ডারগ্রাউন্ডের পলিটিক্যাল গ্রুপগুলোও হাতে পেয়ে যাচ্ছিল অস্ত্রগুলো। কোথা থেকে কিভাবে আসছিল তার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার পোস্টিং তখন চিটাগাং পোর্ট কমিশনারেটে। সরকার খুব কড়াকড়ি করার নির্দেশ দিল, সব এন্ট্রি পয়েন্টে, সীমানার টহল বাড়াল, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ঐ অস্ত্রের চালান বেড়েই চলল।

পিস্তলটার আকৃতি বড় অদ্ভুত, পুরাই চকচকে মজবুত স্টিলের তৈরি, বেশ চ্যাপ্টা, মাত্র ইঞ্চিখানেক। একেবারে সিম্পল ডিজাইন, কনভেনশনাল নয়; কিন্তু শক্তিশালী রিকয়েল স্প্রিং থাকায় আর খুব নিখুঁত মাপে বানানোর ফলে একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র এটা। ব্র্যান্ড নেইম তো দূরের কথা, একটা অক্ষরও কোথাও লেখা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যাদের কাছ থেকে উদ্ধার হচ্ছে, তারা কেউই নাকি কারো কাছ থেকে সেটা পায়নি। কোনো টাকাও খরচ করতে হয়নি। তাদের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে অটোমেটিক। বেছে বেছে সন্ত্রাসী আর নিচতলার এক্সট্রিমিস্টদের পাঠানো হচ্ছে। ওরাও মুফতে গিফট পেয়ে রেখে দিচ্ছে, ইউজও করছে সুযোগমতো। সবমিলিয়ে দেশজুড়ে এক অশনিসংকেত! কারা এভাবে বিনেপয়সায় অস্ত্র ছড়াচ্ছে? প্রশ্নের জবাব খুব সোজা, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। বিদেশ স্বদেশ দু’খানেই এমন পক্ষ আছে—জানা কথা, কিন্তু কোনো যোগসূত্র না পেলে তাদের কিভাবে ধরা সম্ভব?



“আমাকে পিস্তলটার একটা স্যাম্পল দেখানো যায়?”—নৃ জিজ্ঞেস করল।
“খুব সোজা হবে না, ওটা আবার গোয়েন্দা পুলিশ দেখছে, শুনেছি স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। তবে তৌফিককে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে। ”
আমাদের কমন বন্ধুবর সহকারী পুলিশ সুপার তৌফিককে ফোন দিলাম। ও জানাল, একটা স্যাম্পল ওদের হাতে সদ্য এসেছে, কিন্তু আমাদের কাছে পাঠাতে পারবে না। আমাদেরকেই ওর কাছে গিয়ে দেখতে হবে আর এই মুহূর্তে ও সিলেটে পোস্টেড।



ফোনে মাঝেসাঝে নৃ’র সাথে এইসব বিষয়ে খুচরো আলাপ হচ্ছিল। ও বলল চোখকান খোলা রাখতে, কেননা একবার দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই ঢুকেছিল, সে নিয়ে তো সারা দেশেই ধুন্ধুমার; প্রতিবেশি রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছিল, ঐ ঘটনা উপমহাদেশের কূটনৈতিক ভূগোল রাতারাতি পালটে ফেলে।
“আমাকে পিস্তলটার একটা স্যাম্পল দেখানো যায়?”—নৃ জিজ্ঞেস করল।
“খুব সোজা হবে না, ওটা আবার গোয়েন্দা পুলিশ দেখছে, শুনেছি স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। তবে তৌফিককে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে। ”
আমাদের কমন বন্ধুবর সহকারী পুলিশ সুপার তৌফিককে ফোন দিলাম। ও জানাল, একটা স্যাম্পল ওদের হাতে সদ্য এসেছে, কিন্তু আমাদের কাছে পাঠাতে পারবে না। আমাদেরকেই ওর কাছে গিয়ে দেখতে হবে আর এই মুহূর্তে ও সিলেটে পোস্টেড। নৃ এসি ল্যান্ড হিসেবে আছে দুর্গম খাগড়াছড়িতে, প্ল্যান করলাম একসাথে চিটাগাং রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে করে সোজা সিলেট যাব বৃহস্পতিবার রাতে। নৃ বলল, চেষ্টা করলে এই অস্ত্ররহস্যের জট ছাড়ানোটা হবে ব্যাপক রোমাঞ্চকর; যদিও বিপদের গন্ধও কম পাচ্ছি না! নিশ্চয় সিন্ডিকেটটা মোটেও দুর্বল না।

২.
সৌভাগ্যক্রমে ট্রেনে বার্থে সিট পেয়েছিলাম, তাও রেলওয়ে ক্যাডারের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার রাশেদের বদান্যতায়, যার ফলে এখন দুজনে আরামে শুয়ে রেলের ঝিকঝিক শব্দের তালে তালে দুলছি। আমাদের কম্পার্টমেন্টে আর কেউ নেই, এটা দুই বার্থেরই কেবিন। সুবিধে হয়েছে, অস্ত্রের কথা সবার সামনে বলা মুশকিল।

“রেল ভ্রমণই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। ছেলেবেলায় প্রচুর ট্রেনে চড়েছি। উত্তরবঙ্গে ছিলাম। গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ—এই ক’টা জায়গা কতবার যে রেলে পার হয়েছি!”—শৈশবের কাহিনী শোনাচ্ছে নৃ, ওর বাবাও ছিল সরকারি চাকুরে; সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
“আমারও ভালো লাগে, তবে টাইম টেবিল না ঠিক থাকায় আমি বিরক্ত। ”
“অথচ দেখো ভারতে রেলের কী অবস্থা! দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রেল নেটওয়ার্ক, সব কিছুই নিজেরা বানাচ্ছে। এমনকি বুলেট ট্রেনও নাকি নিজেরাই বানিয়ে নামাবে। ষোল কোটি মানুষের এই ছোট্ট দেশে রেলের বিজনেস খারাপ চলতে পারে না। কিন্তু আমরাই ইচ্ছা করে রেলটাকে বসিয়ে দিলাম। সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধায় রেলের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। চতুর্দিকে অন্যায় প্রেসার আর মিসম্যানেজমেন্টের চূড়ান্ত!”
“আবার আমরাই কিনা আশির দশকে রেলকে লাভজনক খাতে পরিণত করেছিলাম! আমারই পরিষ্কার মনে আছে তখন রেলের কী জাঁকজমক অবস্থা, ঈশ্বরদী স্টেশন রাতের বেলায় দিনের মতো গমগম করত! টাইম ধরে ট্রেন চলত। ”
“মাঝে মাঝে মনে হয় এই দেশের জন্য গণতন্ত্র উপযুক্ত নয়, অন্তত আমরা এখনও গণতন্ত্রের সুফল আস্বাদনের যোগ্য হয়ে উঠিনি। আবার মনে হয়, জুভেনাইল জাতি আমরা, ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছি, সময় তো একটু লাগবেই। ”
“আমি তোমার সাথে একমত নই, নৃ। কোরিয়া বা মালয়েশিয়াকে দেখো, কোথায় চলে গেছে!”
“ওরা স্বাধীনতা পেয়েছে আমাদের সামান্য আগে পরে, কিন্তু একক জাতি হিসেবে আমাদের থেকে অনেক প্রাচীন আর বেশ পিউরিটি মেইন্টেনও করতে পেরেছে। ওদের সবার চেহারা, গায়ের রং, এমনকি মতামতের বা চিন্তাধারার বেসিক জায়গায় এক, কিন্তু আমরা? একজন বেঁটে তো, আরেকজন উঁচু, একজন ব্রিটিশদের মতো ফর্সা, তো আরেকজন আলকাতরার মতো কালো, কারো চেহারার সাথে কারো মিল নাই! আমরা মিশ্র জাত। আমাদের চিন্তাধারাও মিশ্র, ঐক্য কম, তাই জাতীয় স্বার্থটাও কম বুঝি। এই জাতিকেই আরো অনেক সময় ধরে চলতে দিতে হবে, টিকে থাকলে একসময় ঠিক হয়ে যেতেও পারে। আমেরিকার কথাই ধরো, ওদের এক হতে সময় লেগেছে দুই শতকেরও বেশি। ”
“তোমার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমি বিদেশ থেকে ঘুরে এসে রীতিমত বিরক্ত আমাদের নিজেদের ওপর। জাতি হিসেবে খুব নিচ মনে হয়। ”
“দেশের মানুষ যদি ঢিলও ছোঁড়ে, তবুও ভালোবেসে যাও স্বদেশকে। আমি আমার জাতিকে দুনিয়ার অনেক জাতির চেয়েই বেটার মনে করি। দেশে প্রায় বিশ কোটি লোক, অথচ ডেইলি খুন হয় গড়ে দুই কি তিনটা, আমেরিকায় ত্রিশ কোটিতে প্রতিদিন কয়েক ডজন খুন হচ্ছে। ধর্ষণ এখানে নাই বললেই চলে, ওখানে প্রতি বিশ সেকেন্ডে একটা ধর্ষণ হয়ে যাচ্ছে। ”
“দেশটা সম্ভাবনাময়, তবে দেশের নেতারা সুবিধার না। ”—আমি ফোঁড়ন কাটলাম, “এরাই দেশের বারোটা বাজাচ্ছে। ”
‘তাই যদি মনে হয় তবে তুমি নেতা হচ্ছো না কেন? কে মানা করেছে? রাজনীতিতে আগ্রহ নাই? সেটাই তো আমাদের জাতীয় ক্রাইম। যোগ্য লোকদের অনাগ্রহ আর সাহসের অভাবেই তারা আজ নেতৃত্বে। দোষটা আসলে সামগ্রিকভাবে আমাদেরই। ”
“আরে ধুর বাদ দাও এসব ক্যাঁচাল, পলিটিক্সের আলাপ আসলেই মেজাজটা চড়ে যায়!”—বিরক্ত হয়ে বললাম আমি।
“তোমার কাছে পিস্তলটার কোনো ছবি আছে?”—টপিকটা নৃ-ই চেঞ্জ করল।
“খবরের কাগজে দেখেছিলাম। ”
“ওতে কিছু বোঝা যাবে না। তবে বিষয়টা খুব পরিষ্কার। কেউ অস্থিরতা তৈরি করতেই মুফতে অস্ত্র বিলাচ্ছে। কারা হতে পারে? হার্ডলাইনে যাওয়ায় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এখন বেশ কোণঠাসা। তারাই হয়ত করছে। কিন্তু এটা ঠেকাতে হবে। নয়ত দেশজুড়ে অস্বাভাবিক রকমের খারাপ অবস্থা তৈরি হতে পারে। ”
“ঠিক বলেছো, চরম খারাপের থেকে মন্দের ভালো বেটার। ”—আমি সায় দিলাম। “তুমি পিস্তলটা দেখতে কেন চাইছো? কী লাভ তাতে?”
“পিস্তলটা নাকি ননব্র্যান্ড, আবার খুব নিখুঁতভাবে ফিনিশিং দেওয়া, অর্থাৎ কোনো সাধারণ ওয়ার্কশপে তৈরি নয়। এখানেই আমার খটকা লাগছে। তাহলে কিভাবে এতগুলো একই রকম গান এভাবে প্রোডাকশন হচ্ছে? কে বানাচ্ছে এগুলো? কোন দেশ? কিভাবে ঢুকছে?”
“বর্ডারে তো চারদিকেই ভারত। তারা ইতোমধ্যেই আমাদের আশ্বস্ত করেছে এগুলো তাদের কাছে থেকে আসছে না। ঐ মাল ভারতের না, আর ভারতের মাটিও ক্রস করছে না। ”
“মায়ানমার?”
“মায়ানমারের ব্যপার স্যাপার চিরকালই আলাদা। ওদের কাছ থেকে খাঁটি তথ্য পাওয়া মুশকিল, তবুও ওরা বলেছে ওদেরও কাজ না এটা। কিছু জানেও না। পোর্টগুলোতেও প্রতিটা আইটেম থরোচেক করে ঢোকানো হচ্ছে। একটা সুঁইও বাদ দিচ্ছি না এখন, তবুও ধরা যাচ্ছে না। ”

নৃ আর কিছু বলল না। শুধু দেখলাম চিন্তায় ওর কপালে ভাঁজ ফুটল, ভ্রুগুলো কুঁচকে গেল।



নৃ খাওয়া থামাল। হাত ধুয়ে মুছে নিয়ে প্যাকেটটা খুলল। একটা ধাতব অস্ত্র, পুরো চকচকে স্টিলের। তৌফিক জানাল ওজন প্রায় কেজি খানেক হবে, জিনিসটা অটোম্যাটিক নয় আর গুলি আঁটে মোটে একটা, একবার ফায়ার করার পর আবার ঢোকাতে হয়। কোনো ম্যাগাজিন নেই, দোনলা বন্দুকের মতো নল ভেঙে গুলি ঢুকাতে হয়। অদ্ভুত পিস্তল। এযুগে এসব চলে না। প্রিমিটিভ ডিজাইন, অনেক আগের শটগানের মতো, কিন্তু ছোট্ট। চমৎকার ফিনিশিং।



ক্রমে রাত বেশ গভীর হলো। আমরা সন্ধ্যায় ট্রেনে উঠেছিলাম। নৃ বেশি রাত জাগে না। ট্রেনিঙের সময় ওকে কোনোদিনও রাত দশটার পর সজাগ পেতাম না, তবে খুব ভোরে উঠে পড়ত। ও ঘুমিয়ে পড়লে আমি একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

৩.
“এই নাও তোমাদের জিনিস”—টেবিলের ওপর সেলোফেন এনভেলপে মোড়ানো একটা পিস্তল এনে ফেলল তৌফিক। সকালে ট্রেন থেকে নেমেই তৌফিকের অফিসে ব্রেকফাস্ট সারছি আমরা। শুক্রবার হলেও আজ ডিউটি পড়েছে ওর।

নৃ খাওয়া থামাল। হাত ধুয়ে মুছে নিয়ে প্যাকেটটা খুলল। একটা ধাতব অস্ত্র, পুরো চকচকে স্টিলের। তৌফিক জানাল ওজন প্রায় কেজি খানেক হবে, জিনিসটা অটোম্যাটিক নয় আর গুলি আঁটে মোটে একটা, একবার ফায়ার করার পর আবার ঢোকাতে হয়। কোনো ম্যাগাজিন নেই, দোনলা বন্দুকের মতো নল ভেঙে গুলি ঢুকাতে হয়। অদ্ভুত পিস্তল। এযুগে এসব চলে না। প্রিমিটিভ ডিজাইন, অনেক আগের শটগানের মতো, কিন্তু ছোট্ট। চমৎকার ফিনিশিং।

একটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস হাতে নিয়ে খুব ভালো করে লক্ষ্য করল নৃ। জানাল ব্যারেলটা লেদ বা কোনো শেপার মেশিনে ম্যাশিনিং করা হয়নি। করা হলে সূক্ষ্ম দাগের সারি থাকত, এটা একবারে ঢালাই করা হয়েছে ছাঁচে ঢেলে, তারপর হয়ত শুধু বেন্ডিং বা হনিং করা হয়ে থাকতে পারে। ঢালাইয়ের অর্থ একটাই, কোথাও এই জিনিসের ম্যাস প্রোডাকশনের আয়োজন আছে।

“তৌফিক, কম্পিউটার সারানোর স্ক্রু ড্রাইভার সেট আছে তোমার অফিসে?”—নৃ জানতে চাইল।
“নাই, তবে এখুনি আনিয়ে দেওয়া যাবে। ”—তৌফিক ওটা আনার ব্যবস্থা নিল। “পিস্তলটায় তো কোনো স্ক্রু দেখলাম না। খুলতে পারলে খোলো, তবে আবার লাগিয়ে দিতে হবে। ”

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটটা চলে এলো। নৃ প্রথমেই বাঁটের কাছটায় একটা সরু প্লেট ছুরির ডগা দিয়ে চাড় দিয়ে খুলে ফেলল। তারপর দেখা গেল একটা খুব ছোট স্ক্রুর মাথা। সেটের সবচেয়ে ছোট ড্রাইভারটা দিয়ে খুলতে শুরু করল ও। বেশ লম্বা সেটা, পুরো বের করতে সময় লাগল বেশ কয়েক সেকেন্ড। আরো কয়েকটা স্ক্রু পাওয়া গেল এরপর, সেগুলোও খুলে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল পার্ট বাই পার্ট খুলে পড়ে আছে টেবিলের ওপর।

“এইটার পার্টস সংখ্যা খুব কম, সারদায় আমাদের অস্ত্র বিষয়ে কিছু কিছু পড়ানো হয়েছিল। ”—ছোট্ট একটা অস্ত্রে অনেক কিছু থাকে, কিন্তু এটায় খুব কম জিনিসপাতি, মাজল স্প্রিংটা পর্যন্ত লিফস্প্রিং, কয়েল স্প্রিং না”—তৌফিক জানাল।
“বুয়েটে পড়ার সময় একবার অস্ত্র নিয়ে খুব আগ্রহ হলো, বিশেষত ফায়ারিং মেকানিজম নিয়ে, ওটা আবার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙেরই একটা সাবটপিক, খানিকটা পড়াশোনাও করে ফেললাম। যা বুঝতে পারছি, এটা অনেকটা বহুকাল আগের রেমিংটন ডেরিঞ্জার টাইপের ডিজাইন, কোনো ম্যাগাজিন নাই, গুলিটা মাজলেই লোড করতে হয়। এখন এইটা নিয়েই ভাবতে হবে। মন বলছে যাবতীয় রহস্য এই অস্ত্রটাতেই লুকিয়ে আছে, বাইরে নয়! যার কাছে এটা ছিল, তার হদিস মিলেছে?”—বলে নৃ একটা আপেলে কামড় লাগাল।
“হ্যাঁ। ইন্টারোগেশনে বলল, কে নাকি ওর বাড়ির ছাদে রেখে গেছে। সিলেটের একটা উঠতি মাস্তান। সরকারি দলের তকমা লাগিয়ে হাল্কা চাঁদাবাজিরও অভ্যেস আছে। উপরের চাপে পিস্তলটা রেখে ছেড়ে দিতে হলো। ”—তৌফিক গম্ভীর গলায় জবাব দিল। “আজকে নিয়ে এ পর্যন্ত তিনশো ছাব্বিশটা উদ্ধার হয়েছে, সবক’টা একই মাল। এইমাত্র হেডকোয়ার্টার থেকে রিপোর্ট পেলাম। ”
“প্রথম কবে উদ্ধার হয়েছে?”—জানতে চাইল নৃ।
“তাও তো মাস দুই হয়ে গেল। ”
“তোমার সন্দেহটা কোথায়?”—গরম ফেনিল কফিতে চুমুক দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম নৃকে।
“পিস্তলটায় পার্টস কম থাকলেও কিছু ব্যাপার আবার অতিরিক্তও মনে হচ্ছে। এই যেমন ধর ব্যারেলের আগায় শুধু ফ্রন্ট সাইট থাকার কথা থাকলেও দুপাশ দিয়েও দুটো পাতের মতো বেরিয়ে আছে, দুটো ফুটোও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটার দরকার কী? চেষ্টা করা হয়েছে পিস্তলটা যতটা সম্ভব ছোট বানাবার, সেখানে এ দুটো কেন? আবার বিভিন্ন পার্টসের গায়ে ছিদ্রও দেখা যাচ্ছে!”
“নাহ, ব্যাপারটা আসলেই গোলমেলে মনেও হচ্ছে, কিন্তু কেন, তার জবাব শুধু ওয়েপন মেকারই দিতে পারবে”—তৌফিক জানাল।
“একটা ব্যাপার মাথায় খেলছে, কিন্তু একটু ভাবতে হবে”—নৃ বলে উঠল। “ততক্ষণে চলো, বাহির থেকে খানিক ঘুরে আসা যাক। ”

৪.
সারাদিন চা বাগান আর সাইট্রাস নার্সারিতে ব্যাপক ঘোরাঘুরির পর সরকারি রেস্ট হাউজে ফিরে বিশাল লাঞ্চ সারলাম। সারাটা পথে নৃকে বেশ ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখেছি। একটু বিশ্রাম নেবার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নৃ’র চিৎকারে ঝাঁকি খেলাম।
“সুষেণ, একটা হেল্প দরকার। পারবা? তোমাদের কাস্টমস সংক্রান্ত। ”— নৃর কণ্ঠে উত্তেজনা।
“কেমন সেটা, শুনি আগে। ”
“যেসব জিনিসপত্র দেশে ইম্পোর্ট করা হচ্ছে, সেসবের তালিকার ডেটাবেইজ আছে না তোমাদের কাছে?”
“হ্যাঁ, তা আছে, একটা ডিজিটাল আর্কাইভে রাখা হয়। অনলাইনেই আইটেমগুলোর ডিটেইলস এন্ট্রি দেওয়া হয়। আইডি পাসওয়ার্ড থাকলে সেটা দেখা যেতে পারে যেকোন জায়গা থেকে। ”
“তোমার কাছে আছে আইডি আর পাস?”
“এখন নাই, তবে ম্যানেজ করা যাবে। ”
“এখুনি ম্যানেজ করার চেষ্টা করো। মনে হচ্ছে কিছু একটা পেয়েছি। ”



চিটাগাং পোর্টের ডেটাবেইজের আইডি পাস পাওয়া গেল খুব দ্রুত, মংলা বন্দরেরটাও চলে এলো কিছু পরেই। তৌফিকের ল্যাপটপটা আনিয়ে ওয়েবসাইটে ঢুকে ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টে লগ ইন করলাম। দিনতারিখ অনুসারে কবে কোন জিনিস কতগুলো পোর্ট দিয়ে দেশে ঢুকেছে তার তালিকা পাওয়া গেল। তারিখ, আইটেম বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে সার্চ করারও ভালো সিস্টেম আছে ডেটাবেইজটায়। নৃ সেগুলোয় ডুবে গেল।



আমি আমার কয়েকজন কলিগকে ফোন লাগালাম। চিটাগাং পোর্টের ডেটাবেইজের আইডি পাস পাওয়া গেল খুব দ্রুত, মংলা বন্দরেরটাও চলে এলো কিছু পরেই। তৌফিকের ল্যাপটপটা আনিয়ে ওয়েবসাইটে ঢুকে ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টে লগ ইন করলাম। দিনতারিখ অনুসারে কবে কোন জিনিস কতগুলো পোর্ট দিয়ে দেশে ঢুকেছে তার তালিকা পাওয়া গেল। তারিখ, আইটেম বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে সার্চ করারও ভালো সিস্টেম আছে ডেটাবেইজটায়। নৃ সেগুলোয় ডুবে গেল। আমি গেলাম ঘুমাতে।

বিকেলে ঘুম ভাঙবার পর নৃকে দেখলাম থুতনির নিচে হাত রেখে টেবিলে কনুইয়ে ঠেস দিয়ে ল্যাপটপে একটা হুইলচেয়ারের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে, স্কিমেটিক ডায়াগ্রাম, সব পার্টস লেবেল করা। তারপর জানাল একটা কিম্ভুত আবিষ্কারের কথা। ও প্রায় বছর দুয়েকের ইম্পোর্টেড আইটেমের লিস্টে চোখ বুলিয়ে ফেলেছে। প্রচুর আইটেম, তাই ধাতব বস্তু আর মেশিন পার্টসেই বেশি নজর দিয়েছে। বছরের পরিক্রমায় আইটেমগুলার তালিকায় একটা রেগুলার প্যাটার্ন আছে। একই ধরনের আইটেমই কম বেশি আসছে সারা বছর। গাড়ি, ফ্রিজ, সিকেডি পার্টস, মেটাল শিট, বার—এরকমের আরো হাজারো জিনিস। কোনো আনকমন আইটেম খেয়াল করেনি নৃ, যেটা বেশ কিছুদিনের মধ্যে আর আসেনি।
“শুধু একটা জিনিস ছাড়া!”—বোমা ফাটাল নৃ।
“অ্যাঁ! কী সেটা?”—আমি আঁতকে উঠে জানতে চাইলাম!
“একটা বিশেষ হুইলচেয়ার এসেছে পাকিস্তান থেকে, গত তিন মাসে মাত্র দুই চালানে, পাঁচশত পিস!”
“তা আসতেই পারে। ওদের মেটাল ইন্ডাস্ট্রি জগতজুড়ে বিখ্যাত, শিয়ালকোটের ইস্পাতশিল্পের নাম ছেলেবেলা থেকেই শুনছি, সার্জারির ছুরি কাঁচি তো ওরাই সাপ্লাই দেয়। তা ঐ নিরীহ যন্ত্রে কী সমস্যা দেখলা? ওটার সিটের ভেতর ঐ মাল পাচার হয়েছে? তা অসম্ভব, দুনিয়ার সেরা স্ক্যানার বসানো হয়েছে এখন দুই পোর্টেই। ”
“কিন্তু এত বেশি হুইলচেয়ার আগে কখনও একসাথে আসে নি। দেশে কি হঠাৎ পঙ্গুর সংখ্যা খুব বেড়ে গেল? কোনো ভূমিকম্পও তো হয়নি সেরকম! কারা নিয়ে এসেছে এই হুইলচেয়ার? কেন? আমার একটু জানা দরকার। ”
“হু, তা একটু সন্দেহজনকই বটে, কোম্পানির নাম পাওনি?”
“পেয়েছি, কিন্তু নেটে সার্চ দিয়ে কিছুই পেলাম না। তানিম স্টিল কোম্পানি। ঢাকা বেইজড ঠিকানা, তবে ফোন নম্বরও বন্ধ। আমি হুইলচেয়ারগুলো দেখতে চাই। ”

তৌফিককে দিয়ে ঢাকার ঐ ঠিকানায় খোঁজ লাগালাম। ওখানে গিয়ে দেখা গেল একটা ট্রেডিং হাউস কিন্তু তানিম স্টীল নয়, আগেও নাকি ছিল না। অর্থাৎ ঠিকানাটা ধাপ্পা।

“পণ্যের গতিবিধি ট্র্যাকিং করারও কিছু সিস্টেম আছে আমাদের, কোন পণ্য কিভাবে কোথায় যাবে তারও একটা ডেটাবেইজ রাখা হয়। ”—আমি জানালাম।
“তাতে কোনো লাভ নেই, কেননা ঐ জায়গায় জিনিসগুলো যাচ্ছেই না। ”—বলল নৃ।
“তাহলে আর কী? নেক্সট চালানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পাকিস্তানের কোত্থেকে ওটা আসছে সে খবর লাগাও, কে পাঠাচ্ছে, ফরেন মিনিস্ট্রির হেল্প নেওয়া যেতে পারে। ”—আমি মত দিলাম।
“ফরেন মিনিস্ট্রিকে কিছুই জানানো ঠিক হবে না। একটু খোঁজ নেওয়া শুরু করলেই হয়ত নেক্সট চালান আর কোনোদিনই আসবে না। সুতরাং থাক। ”
“আচ্ছা একটা ব্যাপার বলতে পারবা? যে গাড়ি বা কন্টেইনারে করে মালগুলা পরিবহন করা হয় সেগুলোর ডিটেইলস থাকে? কত নম্বর গাড়ি, কোন কোম্পানির পরিবহন এসব?”
“সেভাবে হয়ত থাকে না, তবে এখন সিসি টিভি ক্যামেরায় সব কিছু ধারণ করা হয়। মাল নামানো, ওঠানো, ইন্সপেকশন  সব। ”
“তাহলে আমাকে কিছু ইনফরমেশন বের করে দাও। আমি তারিখ দিচ্ছি, লট নাম্বার, চালানের ডিটেইলস সব দিচ্ছি। আমাকে বলতে হবে, চালানটা কোন ট্রাকে চড়ানো হয়েছে। ”

আমি খবর লাগালাম। জানা গেল চালান দুটোই রেল কন্টেইনারে ওঠানো হয়েছে, ট্রাকে নয়। নৃ চেয়েছিল ট্রাকটা ট্র্যাক করতে। কমলাপুরে জানা গেল কন্টেইনার থেকে নামিয়ে জিনিসপত্র আলাদা ট্রাকে করে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটার হদিস আর রাখা হয় না।



এদেশে পুলিশ পারে না—এমন কিছুই নেই। আবার প্রমাণ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল। মালিকও গ্রেফতার। কিন্তু ফোর্স জানাল গোডাউনে কয়েকটা নিরীহ হুইলচেয়ার ছাড়া আর কিছুই নাই। এভাবে নিরীহ লোককে অ্যারেস্ট করলে সমালোচনা হয়, ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়। হাজত থেকে তাকে ছাড়িয়েও নিয়ে যাওয়া হলো প্রভাবশালী মহলকে প্রভাবিত করে। তবে একটা হুইলচেয়ারের স্যাম্পল সিলেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ততক্ষণে।



অবশেষে আমিই বুদ্ধি বাৎলে দিলাম। এই চালান আনার জন্য পাকিস্তানে যে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেটা কোন একাউন্ট থেকে এলসি খুলে, তা বের করতে হবে, তারপর ঐ একাউন্ট হোল্ডারকে বের করতে হবে। ওটায় নিশ্চয় তানিম স্টিলের নামই আছে। কিন্তু আজকে আর হবে না, কেননা শুক্রবার।
“কিন্তু ঐ ঠিকানাতেও যদি না পাওয়া যায়? খুবই স্বাভাবিক যে ঐ ঠিকানাও সে ভুয়া দিয়েছে!”
“তাই তো! ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। তবে চেষ্টা করতে দোষ কী? কোনো না কোনো জায়গায় তো সেও ভুল করতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো কেন এত সিরিয়াস হচ্ছো এই হুইলচেয়ার নিয়ে?”
“হচ্ছি, তার খুব সিগনিফিক্যান্ট রিজন আছে। বলব, কিন্তু তার আগে আমার হুইলচেয়ারটা দরকার। ”
“অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়িয়ে কী লাভ?”
“সমস্যা নাই, হুইলচেয়ার আমি যোগাড় করে দেব। একটু সময় দাও শুধু। ”—দরজায় দাঁড়িয়ে তৌফিক, হাস্যোজ্জ্বল মুখ। জানাল ঢাকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে সার্চপার্টি লাগিয়েছে ও। কিছুক্ষণের ভেতর পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী। পুলিশ লাগানো হয়েছে হুইলচেয়ারের সমস্ত এজেন্টদের কাছে, যারা বানায় এবং যারা বাহির থেকে আনায়।

এদেশে পুলিশ পারে না—এমন কিছুই নেই। আবার প্রমাণ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল। মালিকও গ্রেফতার। কিন্তু ফোর্স জানাল গোডাউনে কয়েকটা নিরীহ হুইলচেয়ার ছাড়া আর কিছুই নাই। এভাবে নিরীহ লোককে অ্যারেস্ট করলে সমালোচনা হয়, ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়। হাজত থেকে তাকে ছাড়িয়েও নিয়ে যাওয়া হলো প্রভাবশালী মহলকে প্রভাবিত করে। তবে একটা হুইলচেয়ারের স্যাম্পল সিলেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ততক্ষণে।

সকাল নাগাদ সেটা এসে পৌঁছল। আগের রাতে নৃ প্রচুর স্টাডি করেছে হুইলচেয়ার আর পিস্তলের পার্টস নিয়ে। ওর সামনে হুইলচেয়ারটা আনার পর মেঝেতে রেখে চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখল। ওর মুখে ফুটে উঠল মুচকি হাসি।
“জিনিয়াসরা যখন ক্রিমিনাল হয় তখন সমাজে ঘটে যায় মহাবিপর্যয়। তবে সুখের কথা এই যে, সব মরিয়ার্টির সাথে লড়ার জন্য এক একটা শার্লক হোমসেরও জন্ম হয়। ”—নৃর কণ্ঠে রহস্যভেদের আভাস পেলাম! “তৌফিক, এখুনি ঐ লোককে আবার অ্যারেস্ট করতে বলো, যদিও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তাকে আর পাওয়া যাবে কি না!”

আমরা দুজনেই উৎসুক হলাম। নিরীহ হুইলচেয়ারটায় কিছুই নাই। আমি অধীর হয়ে রেক্সিনের সিটটা একটা ছুরি দিয়ে ফেড়ে ফেললাম, নিচটা খেয়াল করলাম। তাও কিছু নাই।
“এটা কী করলা? শুধু শুধু সিটটা নষ্ট করলা?”—নৃ একটু বিরক্ত হলো, তারপর পাশের ঘর থেকে স্ক্রু ড্রাইভার সেটটা নিয়ে এসে যা করল তা আমার চিরকাল মনে থাকবে।

ধীরে ধীরে চেয়ারটার বিভিন্ন পার্টস খুলতে শুরু করল নৃ। আশ্চর্যের পর আশ্চর্য। ফুটরেস্টের সাথে যে ফাঁপা টিউবরডটা লাগানো ছিল সেটা খুলে আনার পর দেখলাম, হুবহু পিস্তলটার মাজলের মতো গড়ন। এইবার বুঝলাম কেন পিস্তলটায় এত বেশি ছিদ্র আর সূক্ষ্ম উদ্গত পাত ওয়েল্ডিং করে লাগানো। ওগুলো আসলে স্ক্রু দিয়ে লাগিয়ে এই হুইলচেয়ারটা তৈরির জন্য। এভাবে আরো অনেক জায়গায় বুদ্ধি করে লাগানো হয়েছে প্রতিটা পার্ট, যেমন ফায়ারিং পিনটা পাওয়া গেল আর্মপ্যাড বোল্টের লোকেশনে, ট্রিগার স্প্রিং পাওয়া গেল দুইটা স্ক্রুর নিচে কুশন সিল হিসেবে, ক্যাস্টর হুইলের ফর্কে পাওয়া গেল পিস্তলের হ্যান্ডেলটা। সবকিছু খোলার পর দেখা গেল প্রতিটা পার্ট হয় এক জোড়া নয়ত দুই জোড়া, অর্থাৎ একটা হুইলচেয়ারে মোট দুইটা পিস্তলের পুরো রসদ।

আমরা হতবাক হয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ, নৃ একটা পিস্তল পুরো সেট করে দেখাল। তৌফিক ফোন দিল হেডকোয়ার্টারে, নৃ বরাবরের মতো ওর বৃত্তান্ত জানাতে সম্পূর্ণ নিষেধ করল। আমি অবাক হলাম না, জানা আছে অন্তরালে থাকার প্রতি সুতীব্র বাসনা ওর।

৫.
“আমি ভাবতে পারিনি যে এটা হুইলচেয়ারটাই হবে, তবে নিঃসন্দেহ ছিলাম একটা ব্যাপারে, সেটা হলো এটা অন্য কোনো যন্ত্রের ছদ্মবেশে দেশে এন্টার করছে। ”—সেদিন রাতে তৌফিকের সৌজন্যে সিলেটের সেরা রেস্তোরাঁয় ডিনার সারতে সারতে বলল নৃ। “ঐ যে বললাম, অস্ত্রটায় মধ্যে কিছু এক্সেস এবং ল্যাকিং ব্যাপার স্যাপার পাওয়া যাচ্ছিল, যা ঠিক পিস্তলের সাথে যায় না, আর অমন নিম্নমানের ফায়ারিং মেকানিজম এখন আর চলে না, সুতরাং বোঝা গেল পিস্তলের এই দশাটা করা হয়েছে শুধুমাত্র পরিবহনের স্বার্থে। কোনো এক ক্রিমিনাল জিনিয়াসের মাথায় এসেছে এই বুদ্ধি। কিন্তু কিভাবে আর কিসের ছদ্মবেশে? যখন কোনো স্ক্যানারে ধরা পড়ছে না, তখন বুঝলাম এটা এমন নিরীহ কিছুর ছদ্মবেশে ভেঙে ভেঙে আসছে যা মেটালিক আর পরে খুব সহজে খুলে জুড়ে নেওয়া যাবে। তারপর সুষেণের কাছ থেকে ডেটাবেইজ খুঁজে পেলাম ঐ হুইলচেয়ারের ঐ অ্যাবনরমাল চালান। নেট ঘেঁটে কিছু ছবি খেয়াল করে দেখলাম পিস্তলটার প্রতিটা অংশ ঐ চেয়ারের ভিন্ন ভিন্ন পার্টকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। তখন সন্দেহটা প্রকট হলো। আবার যখন ঐ তানিম স্টিলের ঠিকানা ভুয়া পাওয়া গেল, তখন সন্দেহটা পুরাই দূর হয়ে গেল, মানে বুঝলাম আমি যা ভেবেছি সেটাই ঠিক। কেননা, ডাল মে কুছ কালা না হলে কেন সে ভুয়া অ্যাড্রেস দিবে? তৌফিককে ধন্যবাদ, ওর থ্রু দিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হেল্প না পেলে আমরা এখন পর্যন্ত অন্ধকারেই থাকতাম। ”
“গোডাউনের নিচের বেইজমেন্টে আরো অনেক চেয়ার পাওয়া গেছে। সব জব্দ করা হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে আবার টানাপোড়েন শুরু হতে যাচ্ছে, জাতটা আর জাতে উঠল না। ”—তৌফিক একটা চিকেন বল চিবুতে চিবুতে জানাল।
“হ্যাঁ, অদ্ভুত সব যুক্তিহীন অ্যাক্টিভিটিজ, কী যে লাভ এসবে, বুঝি না। ”—আমি বললাম।
“বিকৃত আদর্শের লড়াইয়ে আদর্শহীন পদক্ষেপ, মনুষ্যত্বের অধঃপতনের সর্বনিম্ন স্তর। ”—নৃ শান্ত কণ্ঠে মতামত দিল।



বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।