ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৪)

ধারাবাহিক রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৪)

পর্ব ৩ পড়তে ক্লিক করুন

নিঃসঙ্গ এই ভারতে.. |
দূর থেকে কল্পনার চোখ দিয়ে ভারতকে দেখা এক কথা আর বাস্তবে তার স্পর্শ পাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। ভারতের মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিলাতি নারীরা এই কঠিন বিষয়টিকে সবার আগে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

বিলেতের জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত এই নারীরা ভারতে এসে হোঁচট খেয়েছেন বৈকি! ১৮৯০ সালে আসা এনি উইলসন ভারতে এসেছিলেন তার সরকারি চাকুরে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি ভারতে এসে নিজেকে নিঃসঙ্গ এবং একাকী ভাবতে শুরু করলেন। বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে তার আভাস পাওয়া যায়—“আমি শপথ করে বলছি অতিমাত্রায় জনতার ভীড়-ভাট্টা আমাকে প্রতিনিয়তই ভীতু করে তুলছে। ”

বলাই বাহুল্য, এই ভয় থেকে এনি কখনো মুক্তি লাভ করতে পারেননি। কিন্তু কিসের ভয় ছিল? শুধুমাত্র দেশটির বিভিন্ন রকম চেহারার মানুষ? নাকি অন্য কিছু? কেউ কেউ মানুষকে ভয় না পেলেও দেশটির মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রঙ, সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক সবকিছু দেখে অবাক হয়ে যেতেন। বাঙালি, পাঠান, মারাঠি, মাদ্রাজি, পারসিক, রাজপুত, পর্তুগিজ ভাষার মানুষ, নেপালের হলুদ বর্ণের মঙ্গোলিয়ান রক্ত—সব যেন একই স্রোতে ভারতে একাকার হয়ে আছে। জাতি ও বর্ণগত এই ভিন্নতা বিলাতি নারীদের চোখে বিস্ময়কর এক নতুন পৃথিবী! কারণটাও সোজা। বেশিরভাগ বিলাতি নারীর ভারতীয় মানুষজনের রঙঢঙ জানার সুযোগ ছিল না। ধর্ম ছিল আরেকটি বিষয়। উল্টো করে ভাবলে যদি বলি ভারতীয়রাই বা এই বিলাতি ফিরিঙ্গিদের কিভাবে গ্রহণ করেছিল? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন গোটা ভারতে তুঙ্গে। সুযোগ পেলেই ফিরিঙ্গিদের একহাত দেখাতে ভারতের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ প্রস্তুত হয়ে আছে। তারও বড় কথা উড়ে এসে জুড়ে বসা এই দখলদার ফিরিঙ্গিরা কখনোই ভারতের বন্ধু হতে পারেনি বা সে চেষ্টাও তারা করে নাই। ভারতও তাদের বন্ধু হিসেবে কখনো তাদের আত্মায় জায়গা দেয়নি। “হিন্দুস্থান এবং হিন্দু সংস্কৃতি ধর্মীয় কারণে সেই সময় বিলাতিদের অস্পৃহ্য জাত হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে একসঙ্গে ওঠা-বসায় স্বচ্ছন্দ ছিল না যা বিলাতিদের সামাজিকভাবে আলাদা করে রাখতে বাধ্য করে। ” (হোয়াইট মোগল, উইলিয়াম ডালরিমপ্লে, পেঙ্গুইন, ২০০৪, পৃষ্ঠা ৩১)




ঘোড়া দৌড়, নৌকা ভ্রমণ, পিকনিক, খেলাধুলার ভেতর দিয়ে বিলাতি নারীরা তাদের বিনোদনের খোরাক খুঁজে পায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে সেই সময় ভারত ছিল অনেক পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকটি অঞ্চলে ট্রেন চলাচল শুরুর আগ পর্যন্ত যোগাযোগের মূল মাধ্যম ছিল বাষ্পচালিত জাহাজ এবং নৌকা। নৌকা ভ্রমণ ছিল বিলাতি নারীদের প্রিয় একটি বিনোদন।



অনেক বিলাতি নারীরা ভাবতেন ভারতে বুঝি শুধুমাত্র হিন্দু আর মুসলমানদের রাজ্য। কিন্তু ভারত যে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, বুদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, পারসিকসহ নানান ধর্মের দেশ—এ কথাটি তারা খুব একটা জানতেন না। আবার প্রায় প্রতিটা ধর্মেই ছিল বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, নিজস্ব কিছু সামাজিক রীতিনীতি এবং আইন-কানুন। খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি এবং তাদের  বিভিন্নরকম চিন্তার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে বিলাতিদের অনেক সময় লেগে যেত। এর চেয়েও বড় কথা, নতুন একটি দেশে এসে দেশের মানুষ, বেশ-ভূষা, ধর্ম, সংস্কৃতির সঙ্গে মনেপ্রাণে মিশে যেতে বিলাতি নারীরা প্রস্তুত ছিল না।

তারপরও এমন বৈরী পরিবেশে বিলাতি নারীরা তাদের জীবনের আনন্দকে খোঁজার চেষ্টা শুরু করে। ঘোড়া দৌড়, নৌকা ভ্রমণ, পিকনিক, খেলাধুলার ভেতর দিয়ে বিলাতি নারীরা তাদের বিনোদনের খোরাক খুঁজে পায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে সেই সময় ভারত ছিল অনেক পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকটি অঞ্চলে ট্রেন চলাচল শুরুর আগ পর্যন্ত যোগাযোগের মূল মাধ্যম ছিল বাষ্পচালিত জাহাজ এবং নৌকা। নৌকা ভ্রমণ ছিল বিলাতি নারীদের প্রিয় একটি বিনোদন। তবে ধারণা করি, সেই সময়ে ভারতের হতদরিদ্র রসিক নৌকার মাঝিরাও বিলাতি মেমদের নিয়ে মাঝ নদীতে নাও ভাসাতে ঠিকই আনন্দ পেত! এমিলি মেটকালফে নামের এক বিলাতি নারী নৌকায় চড়ে কলকাতা থেকে দিল্লি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি সেই ভ্রমণ নিয়ে তার রোজনামচায় লিখেন, “বাতাসের বিপরীতে আমাদের যাত্রা ছিল অনেক ধীর আর শান্ত এবং সেই সাথে আমাদের সময়টা ছিল অনেক উপভোগ্য এবং আনন্দদায়ক। বলা যায় এটি ছিল দিন রাত লাগাতার একটি পিকনিকের মতো। মাসব্যাপী এই ভ্রমণে আমাদের কাজ ছিল নৌকার ছাদে উঠে বইপড়া, বন্ধুদেরকে চিঠি লেখা এবং সেই সাথে বিভিন্ন রকম কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখা। নৌকার ছাদে আমরা খাবার খেতাম এবং সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার নৌকায় ফিরে আসতাম। তারপর কিছুক্ষণ সুন্দর সুন্দর বৈকালিক কথোপকথন বিনিময়ের পর আমরা আবার বিছানায় ঘুমোতে যেতাম। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দি মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দ্য ব্রিটিশ অ্যামপায়ার ইন ইন্ডিয়া; মারগারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৫, পৃষ্ঠা- ২৬)

এমিলি মেটকালফের বর্ণনায় এটা স্পষ্ট যে তৎকালীন সময়ে বিলাতি নারীরা ধীরে ধীরে ভারত নামের দেশটায় আনন্দের সঙ্গে বসবাসের জন্যে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। ভারতের মানুষ এবং প্রকৃতি এই দুই মিলে যে জুজুর ভয় তারা পেয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়। তবে শহরের তুলনায় গ্রাম বা মফস্বলে বসবাসরত বিলাতি নারীদের দশা ছিল খারাপ। মিনি ব্ল্যান তার স্বামীর সঙ্গে যখন প্রথম ভারতে পাড়ি জমান, তখন তিনি ছিলেন ছ’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার স্বামী লন্ডনে বসবাসরত তার মাকে এক চিঠিতে লিখেন, “সে (মিনি ব্লান) ট্রেন থেকে একটি পালকিতে চড়ে ঝিলাম আসে। তাকে চারজন বেয়ারা খালি পায়ে বহন করে নিয়ে আসে। রাস্তায় স্থানে স্থানে তারা বিশ্রাম নিয়ে পরস্পর অদল বদল করে আবার যাত্রা শুরু করে। ”



এমিলি মেটকালফের বর্ণনায় এটা স্পষ্ট যে তৎকালে বিলাতি নারীরা ধীরে ধীরে ভারত নামের দেশটায় আনন্দের সঙ্গে বসবাসের জন্যে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। ভারতের মানুষ এবং প্রকৃতি এই দুই মিলে যে জুজুর ভয় তারা পেয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়।



এই দৃশ্য কল্পনা করলে বিলাতি নারীদের ভারতের মফস্বল শহরে যাতায়াতের একটি চিত্র পাওয়া যায়। কেউ কেউ রেলপথে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। প্রতিটা রেলেই ইউরোপিয়ানদের জন্যে আলাদা করে বিশেষ কক্ষের ব্যবস্থা ছিল। ট্রেনের প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল ইউরোপিয়ানদের জন্য বরাদ্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সত্যিই কি বিলাতি নারীরা দেশটাকে নিজের দেশ বলে ভাবতে পেরেছিল?  প্রকৃতির রঙ বদলের মতোই গোটা ভারতবাসীর মন এবং সংস্কৃতি সম্পূর্ণই আলাদা। রাজস্থানের ধূ-ধূ মরুভূমি পার হয়ে নরম শীতল বাংলার মাটিতে তখন বিলাতি নারীরা মোটামুটি অভ্যস্ত। এই অভ্যস্ততার কারণে বিলাতি নারীদের জন্যে ট্রেনে চলার অভিজ্ঞতা ছিল সবসময়ই প্রাণবন্ত, উৎসাহব্যঞ্জক। মনিকা কেমবেল তার স্বামীর সঙ্গে উত্তর ভারত থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত ট্রেনে ভ্রমণ করেন। ভ্রমণকালে হঠাৎই তাদের টাকা ফুরিয়ে যায় এবং বিপদে পড়েন। তিনি জানাচ্ছেন, “কারগপুরে মি. দাশের সঙ্গে আমাদের আগে কখনোই পরিচয় ছিল না, অথবা আবার ভবিষ্যতেও তার সঙ্গে কখনো দেখাও হবে না। কিন্তু তার কাছে ধার চাইলে তিনি আমাদের টাকা ধার দিলেন শুধু আমাদের কথার ওপর নির্ভর করেই। ” তাহলে কি বলা যায়, ধীরে ধীরে বিলাতি নারীরা ভারতের মানুষের প্রতি তাদের যে স্বভাবসুলভ ভয়ভীতি এবং কুণ্ঠা মনের গহীনে পোষণ করতেন তা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন?

যেহেতু ভারত ছিল বিলাতি নারীদের নতুন জীবনের জাদুর কাঠি, ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতে জীবন যাপনে তাদের খাপ খাইয়ে নেওয়াটা ছিল জরুরি। তাদের শিখতে হয়েছে কিভাবে স্থানীয় চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে নিজেদের সুস্থ করে তোলা যায়, জলবায়ুর বিভিন্ন মেজাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা যায়, সূর্যের প্রখর তাপে কিভাবে গা বাঁচিয়ে চলা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশাপাশি বিলাত থেকে নিয়ে আসা ভারত সম্পর্কে  কিছু বদ্ধমূল অন্ধ ধারণাও তাদের সমূলে উৎপাটন করতে হয়েছে। সর্বোপরি তাদেরকে শিখতে হয়েছে যে, ভারত তাদের এক নতুন ঠিকানা। এই দেশটিতে তাদের থাকতে হবে, জীবনের সুখ-দুঃখ রচনা করতে হবে। ভারতে নতুন আগন্তুক এই বিলাতি নারীরা ভারতে এসে ভারতীয় সমাজের পাশাপাশি তৈরি করে নিল নতুন এক বিলাতি সমাজ। ভারতের আলো-হাওয়ায় তৈরি হওয়া নতুন সমাজটি দূর থেকে এই বিলাতিদের চোখে ছিল কতই না অজানা আর অচেনা এক সমাজের ঠিকানা!

পর্ব ৫ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।