১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
তৃতীয় খণ্ডের ১০ম কিস্তি
___________________________________
প্রহারের পৌনপৌনিকতা আর মাত্রা এক পর্যায়ে কমে আসে, কিন্তু সেটাই তখন হয়ে ওঠে আতঙ্কের আরেক নাম—এই বুঝি ফের শুরু হবে। কোনো একটি উত্তর মনঃপুত না হলেই প্রহারের ব্যবস্থা। এখন আর কালো উর্দিধারী ষণ্ডারা নয়, প্রশ্ন করছেন পার্টির বোদ্ধারা। নাদুসনুদুস চেহারার লোকগুলো দ্রুত হাত-পা নাড়িয়ে আর চশমায় ঝিলিক তুলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রশ্নবান চালিয়ে যান। নিশ্চিত নয়, তবে তার ধারণা, একেক দফায় দশ-বারো ঘণ্টা ধরে চলে একেকটি জিজ্ঞাসাবাদ। এই প্রশ্নকারীরা তাকে নির্যাতনে জর্জরিত দেখেছেন কিন্তু তাতেও হয়ত তাদের মন যেন ভরে না। সে কারণেই তারা মুখে চাপড়ে, কান মলে, চুল টেনে, এক পায়ে খাড়া করিয়ে রেখে, প্রশ্রাবের বেগ চাপলেও আটকে রেখে, চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসা পর্যন্ত কড়া তীর্যক আলো ফেলে কষ্ট দিয়েছেন।
এরই মধ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের হত্যা করার স্বীকারোক্তি সে দিয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহী প্যাম্ফেলেট বিলি, সরকারি তহবিল তসরুপ, সামরিক গোপন তথ্য বিক্রি আর সব ধরনের নাশকতা চালিয়েছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছে। সে আরো স্বীকার করেছে ইস্টেশীয় সরকারের বেতনভোগী চর ছিল সেই ১৯৬৮ সাল থেকে। স্বীকার করেছে, সে ছিল এক ধর্মবিশ্বাসী, পুঁজিবাদের সমর্থক আর বিকৃত যৌনাচারী। সে স্বীকার করেছে সে ছিল তার স্ত্রীর হন্তারক, যদিও সে জানে এবং প্রশ্নকর্তারাও অবশ্যই জানবেন তার স্ত্রী এখনো জীবিত।
এসবের একটাই উদ্দেশ্য ছিল—তাকে অপদস্থ করা আর যুক্তি তর্ক চালানোর শক্তি কিংবা যৌক্তিকতার বোধ ধ্বংস করে দেওয়া। মূল অস্ত্রই ছিল নির্মম সব প্রশ্নবাণ, আর একের পর এক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বাণ হেনে চলতেন তারা। থমকে দিয়ে, কথার ফাঁদ পেতে, বক্তব্য বিকৃত করে, পদে পদে মিথ্যাচারের দোষ দিয়ে, স্ববিরোধিতার ধুয়ো তুলে এই চেষ্টা চালিয়ে যান তারা, যতক্ষণ না স্নায়ু দৌর্বল্য কিংবা লজ্জায় ফুপিয়ে কেঁদে দিত—ততক্ষণ। কখনো একদফায় অন্তত আধা ডজনবার তাকে কাঁদতে হয়েছে। প্রতিবারই তারা চিৎকার করে ভর্ৎসনা করেছেন কিংবা উত্তর দিতে সামান্য ইতস্তত করলেই হুমকি-ধমকি দিয়েছেন, ফের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুলে দেবেন এটাই ছিল হুমকি। আবার কখনো তাদের সুরটা পাল্টেও গেছে—তাকে কমরেড সম্বোধন করেছেন, ইংসক আর বিগ ব্রাদারের দোহাই দিয়ে অনুনয় বিনয় করে, দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানতে চেয়েছেন পার্টির প্রতি তার আর এতটুকু আনুগত্যও কি নেই?
যে অপরাধ সে করেছে তা আর করবে না সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে স্নায়ুতে যখন জ্বালা ধরে যেত, তখন এইসব অনুনয় বিনয়েও তার কান্না পেত। এইসব আদুরে গলা তার ভেতরটা যতখানি ভাঙচুর করে দিত, নিরাপত্তারক্ষীদের বুটের লাথি আর ওজনদার ঘুষিগুলোও ততখানি কাবু করতে পারত না। ততক্ষণে সে স্রেফ একটি মুখ ছাড়া আর কিছু নয় যা শব্দ করে, একটি হাত ছাড়া কিছু নয় যা ইশারা করে। তার কাছে যেমনটি চাওয়া হয় সেই শব্দ কিংবা সেই ইশারাটি করে যাওয়াই তার কাজ। তার একটাই উদ্বেগ আর চাওয়া, তা হচ্ছে—সে বুঝতে চায় আসলে ওরা কী জানতে চায়, কোন স্বীকারোক্তিটি পেতে চায় তার কাছে। আর যখনই বুঝতে পারে তখনই, নতুন করে অপদস্থ হওয়ার আগেই দ্রুত স্বীকারোক্তি দিয়ে দেয়।
এরই মধ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের হত্যা করার স্বীকারোক্তি সে দিয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহী প্যাম্ফেলেট বিলি, সরকারি তহবিল তসরুপ, সামরিক গোপন তথ্য বিক্রি আর সব ধরনের নাশকতা চালিয়েছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছে। সে আরো স্বীকার করেছে ইস্টেশীয় সরকারের বেতনভোগী চর ছিল সেই ১৯৬৮ সাল থেকে। স্বীকার করেছে, সে ছিল এক ধর্মবিশ্বাসী, পুঁজিবাদের সমর্থক আর বিকৃত যৌনাচারী। সে স্বীকার করেছে সে ছিল তার স্ত্রীর হন্তারক, যদিও সে জানে এবং প্রশ্নকর্তারাও অবশ্যই জানবেন তার স্ত্রী এখনো জীবিত। স্বীকারোক্তিতে সে আরো জানিয়েছে, গোল্ডস্টেইনের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ, গোপন সংগঠনেরও সে একজন সক্রিয় সদস্য আর এর সবাইকেই সে চেনে। সব কিছু স্বীকার করে নেওয়া আর সবাইকে জড়িয়ে ফেলাই ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। তবে, এক অর্থে এর সবকিছুই তো সত্য। এত সত্যি যে, মনে মনে সে ছিল পার্টি বিরোধী, আর পার্টির চোখে কোনো কিছু মনে ভাবা আর কাজে করার মধ্যে কোনো ফারাক নেই।
অন্য ধরনের কিছু স্মৃতিও রয়েছে। সেগুলো যেন তার মন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে আছে, ঠিক যেভাবে অন্ধকারে ঘিরে ঝুলে থাকে কিছু ছবি।
তৃতীয় খণ্ডের ১২ম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ৩ কিস্তি ১১) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।