পর্ব ৫ পড়তে ক্লিক করুন
ভারতে দ্বিতীয় জীবন |
বলা প্রয়োজন যে, সামাজিক জীবন ব্যবস্থার বিভিন্নরকম কলা কানুন এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক বিবেচনায় আনলে ভারতের বিলাতি সমাজ আর খোদ বিলেতের বিলাতি সমাজের চেহারা একরকম ছিল না। “আঠার শতকের দিকে বিলাতিরা যে সময় থেকে ভারতের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায় তখন থেকেই তারা white Asianism মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের জনস্রোতে টিকে থাকার জন্যে ভারতীয় ভাষা, পোশাক এবং সংস্কৃতিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার প্রয়াস পায়”(Life and Society in British India)।
পলাশীর ষড়যন্ত্রের নায়ক রবার্ট ক্লাইভের কথাই ধরা যাক। তিনি ১৭৪৩ সালে ভারত এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানির চাকুরি বাগিয়ে। পরবর্তীতে ১৪ বছরের ব্যবধানে ১৭৫৭ সালে তিনি বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে হারিয়ে ভারতের প্রভু বনে গিয়েছিলেন। অথচ রবার্ট ক্লাইভের পেছনের জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা ছিল না। পাড়ার মাস্তান হিসেবে তার বেশ নাম-ডাক ছিল। এই ‘অপদার্থ’ পুত্রের একটা গতি করতেই বাবা রিচার্ড ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেন এবং পুত্রের একটা চাকরি জোগাড় করতে সমর্থ হন। বিলেত থেকে অনেক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের ভারতের রেলরুট নির্মাণের জন্যেও আনা হয়েছিল। তারা ভারতে এসে জীবন যাপন শুরু করেন, বিয়ে করেন এবং ভারতেই পাকাপাকিভাবে জীবন অতিবাহিত করেন। অনেকেই ভারতীয় নাগরিক বিয়ে করেন এবং তাদের সন্তানরা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করে।
১৮৮৫ সালে ‘দ্যা পাইয়োনিয়ার’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে তারই আভাস পাওয়া যায়। পত্রিকার ভাষায়, “বিলেতের সেনাবাহিনীর বিশাল একটা অংশ হওয়া সত্ত্বেও, শুধুমাত্র ভারতের মতো দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি দেশে অবস্থান করার কারণে তাদের ব্রিটিশ কমিউনিটির একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। ” মজার কথা হলো ভারতের এই বিলাতি ‘এলিট’ শ্রেণীরাও সে কথা জানতেন এবং সে কারণে তারাও বিলেতের দ্বিতীয় সারির নাগরিক না হয়ে ভারতের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক জীবনের প্রতিই বেশি ঝুঁকেছিলেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সে সময়ের ভারতে বিলাতি সমাজ ব্যবস্থায় দুটো জাতির প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। প্রথম শ্রেণীতে ছিল যারা বিলেত থেকে এসেছেন এবং যারা আদি অকৃত্রিম ‘ইংলিশ’ বা ‘বিলাতি’। তাদের বলা হতো ‘ডোমিসিলড ইউরোপিয়ান’ আবার দ্বিতীয় সারিতে ছিল যারা বিভিন্নভাবে ভারতে এসে শংকর হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের বলা হতো ‘ইউরোশিয়ান’। সমাজের শ্রেণীগত এই ভাগাভাগিতে বিলাতি সমাজ ছিল সিদ্ধহস্ত। আর সে কারণেই বিলাতি বা ইউরোপিয়ান কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে, নামি দামি কোনো ক্লাবে, সামাজিক আড্ডায় এই ‘ইউরোশিয়ান’রা ছিল অনাহূত।
বিলাতি ‘এলিট’ শ্রেণীর যারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তারা ছিলেন মূলত সরকারি চাকুরে। তারা ছিলেন ভারতের সিভিল সার্ভিস(আইসিএস), ব্যবসায়ী, উকিল, জেলা বা মহকুমার বিচারপতি, গভর্নর, ডাক্তার(ইন্ডিয়ান মেডিকেল সেন্টার), ম্যাজিস্ট্রেট, ভিক্টোরিয়া কাউন্সিলের সদস্য, সেনা এবং নৌ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, স্কুলের শিক্ষক ইত্যাদি পেশার অন্তর্গত। আবার দেখা যায় শুধুমাত্র ভারতে বসবাসের কারণে ভারতের এই বিলাতি ‘এলিট’ শ্রেণীভুক্তরাও অনেক ক্ষেত্রে খোদ বিলেতির মাটিতে তাদের যথাযথ সম্মান পেতেন না। ১৮৮৫ সালে ‘দ্যা পাইয়োনিয়ার’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে তারই আভাস পাওয়া যায়। পত্রিকার ভাষায়, “বিলেতের সেনাবাহিনীর বিশাল একটা অংশ হওয়া সত্ত্বেও, শুধুমাত্র ভারতের মতো দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি দেশে অবস্থান করার কারণে তাদের ব্রিটিশ কমিউনিটির একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। ” মজার কথা হলো ভারতের এই বিলাতি ‘এলিট’ শ্রেণীরাও সে কথা জানতেন এবং সে কারণে তারাও বিলেতের দ্বিতীয় সারির নাগরিক না হয়ে ভারতের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক জীবনের প্রতিই বেশি ঝুঁকেছিলেন। কিছুদিন পরপরই অনেক নতুন মুখ বিলেত থেকে ভারতে আসত এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী সমাজে তাদের ঠাঁই হতো। তবে যারা নিম্ন শ্রেণীর চাকুরে ছিলেন তারা মোটেও বিলেতের সম্ভ্রান্ত সমাজের সাথে মিশতে পারতেন না। ১৮৬৫ সালে ভারতে জন্মগ্রহণকারী রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের লেখায় সে সময়ের ভারতে বিলাতি সমাজের নাক উঁচু অনেক বিষয় বিভিন্নভাবেই উঠে এসেছে। কবি এবং লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং ডিসেম্বর ৩০, ১৮৬৫ সালে ভারতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯০৭ সালে সাহিত্যে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। কিপলিংয়ের লেখায় বিভিন্নভাবে ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি সমাজের চালচিত্র উঠে এসেছে। কিপলিংয়ের বিখ্যাত একটি কবিতা ‘Take up the White Man’s burden’-এ চোখ রাখা যাক।
“Take up the White Man’s burden–
Ye dare not stoop to less–
Nor call too loud on Freedom
To cloak your weariness;
By all ye cry or whisper,”
কিপলিং এর ‘কিম’ উপন্যাসেও সে সময়ের বিলাতি সমাজের চিত্রটি দেখতে পাই।
“There is a good spirit in thee. Do not let it be blunted at St.Xavier’s. There are many boys there who despise the black men....[D]o not at any time be led to contemn the black men.”
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারতের মাটিতে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও এই বিলাতি সমাজের চোখে ভারতের মানুষের মন, তাদের জীবনযাত্রা এমনকি সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো ছিল সবসময়ই উপেক্ষিত। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত ডেনজিল ইবেটসনের একটি রিপোর্ট (১৮৮১ সালে প্রকাশিত) এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যায়। তাঁর ভাষায়, “ভারতীয়দের পোশাক এবং বিশ্বাসের প্রতি আমরা যে অবহেলা পোষণ করি তা প্রকারান্তরে যে বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় তা হলো; শুধুমাত্র ইউরোপিয়ানরা এতে নিজেরাই প্রতারিত হয় না, সেইসাথে আমাদের প্রাশাসনিক ক্ষমতায়নের ওপরও এর প্রভাব পড়ে বৈকি। ”
অনেক সময় দেখা যায় ভারতের সমাজ ভাবনা নিয়ে ভালো এবং ইতিবাচক কোনো তথ্য কেউ প্রকাশ চাইলেও করতে পারতেন না। সেক্ষেত্রে বিলেতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ তা বাতিল করে দিতেন। ১৯১৭ সালে আইসিএস-এর একজন নতুন দক্ষ কর্মকর্তা সি.এ. কিনকেইডকে তার প্রতিবেদন প্রকাশ না করতে বোম্বের চিফ সেক্রেটারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কারণটা খুবই হাস্যকর। কিনকেইডের প্রতিবেদনে মারাঠা জনগণের সুন্দর ছিমছাম জীবন, সেইসাথে তাদের অগাধ গুণকীর্তন এবং সতের দশকের—তাদের নায়ক শিবাজির উন্নত চরিত্রের ছবিটি আঁকা হয়েছিল।
অনেক সময় দেখা যায় ভারতের সমাজ ভাবনা নিয়ে ভালো এবং ইতিবাচক কোনো তথ্য কেউ প্রকাশ চাইলেও করতে পারতেন না। সেক্ষেত্রে বিলেতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ তা বাতিল করে দিতেন। ১৯১৭ সালে আইসিএস-এর একজন নতুন দক্ষ কর্মকর্তা সি.এ. কিনকেইডকে তার প্রতিবেদন প্রকাশ না করতে বোম্বের চিফ সেক্রেটারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কারণটা খুবই হাস্যকর। কিনকেইডের প্রতিবেদনে মারাঠা জনগণের সুন্দর ছিমছাম জীবন, সেইসাথে তাদের অগাধ গুণকীর্তন এবং সতের দশকের—তাদের নায়ক শিবাজির উন্নত চরিত্রের ছবিটি আঁকা হয়েছিল। মূল কথা হলো বিলাতি সমাজভুক্তরা স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করার পরিকল্পনা করলেও তারা কখনোই ভারতের মানুষকে নিজেদের করে ভাবতে পারেনি।
ভারতে অবস্থানরত বিলাতি নারীরা ছিলেন বিলাতি সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ১৮৮০ সালে বিলাতি ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি ডুফেরিন তার স্মৃতির খাতায় লিখছেন, “সমাজের সর্বত্রই রাজনীতি, শিল্প সাহিত্য নিয়ে কথা বলা ছিল অনেকটা অভদ্রসুলভ আচরণ। ” বরং চাকরি, খেলাধুলা, চাকর-বাকর, ছেলেমেয়ে—এসব নিয়ে কথা বলাই ছিল সঙ্গত। ১৮৪০ সালে বোম্বের গভর্নরের স্ত্রী লেডি ফকলেন্ড স্থানীয় ভারতীয়দের সাথে এক আড্ডায় মিলিত হয়েছিলেন। তাদের সাথে মেশার পর তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, “খুব একটা প্রাণবন্ত নয়। ” বরং তাদের কথা বলার বিষয় ছিল রাস্তার ধুলাবালি, ঘরবাড়িতে ঠাণ্ডার উপদ্রুপ, বৃষ্টি দিনের আসন্ন তাণ্ডব ইত্যাদি। বিলাতি নারীরা তাদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে বিভিন্ন রকম গুঞ্জনকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। কার স্বামীর কর্মস্থলে কী পদোন্নতি হলো, কে মারা গেল, কোন বিলাতি মেয়ে কার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, কে সদ্য বিয়ে করল, কোন নারী সদ্য বিলেত থেকে এলো ইত্যাদি।
১৮৪৩ সালে জুলিয়া মেইটলেন্ড তার স্মৃতিকথায় সেই সময়ের ভারতে অবস্থানরত অলস বিলাতি নারীদের একটি সুন্দর ছবি এঁকেছেলিনে। তার ভাষায়, “সোফায় শুয়ে থাকাকালে যদি তাদের হাতের রুমাল মেঝেতে পড়ে যেত তখন তারা শুধুমাত্র নিচু স্বরে তাদের চাকরদের ডাক দিত ‘বয়েস!’ সাথে সাথেই বিলাতি নারীকে দেখভালে নিযুক্ত চাকর দৌড়ে এসে মেঝে থেকে রুমালটি উঠিয়ে দিত। ” ঊনিশ শতকের আগেও বিলাতি মেয়েদের এরকম ঘরোয়া আড্ডাতেই বেশি বন্দি হয়ে থাকতে হতো। পরবর্তীতে তাদের বাড়ির বাইরে খেলাধুলা, সামাজিক আচার এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেশ জোরেশোরেই দেখা যেতে শুরু করল। ছেলেদের পাশাপাশি বিলাতি মেমরাও ঘোড়ায় চড়া, বেডমিন্টন, দাবাসহ বিভিন্ন রকম খেলাধুলায় ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেন। খেলাধুলার পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবে তারা নিয়মিত আশা-যাওয়া শুরু করেন। বেঙ্গল ক্লাব বিলাতি সমাজের জন্যে একটি উল্লেখযোগ্য ক্লাব ছিল। কলকাতায় লর্ড মেকলের পুরানো বাড়িটিই পরবর্তীতে ‘বেঙ্গল ক্লাব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সন্ধ্যাকালীন ক্লাবে এসে বিলাতি নারীরা পরস্পরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, আড্ডা, পান, পত্রপত্রিকা পাঠ, উপন্যাস নিয়ে নাড়াচাড়া ইত্যাদি বিষয়ে মগ্ন হয়ে থাকতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে ভারতে অবস্থানরত বিলাতি নারীরা তাদের দ্বিতীয় জীবনটি ফিরে পেতে শুরু করলেন। ভারতীয় সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়েই নিজেদের জন্য নতুন এক পৃথিবী তারা গড়ে তুলতে মগ্ন হয়ে পড়লেন।
পর্ব ৭ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫