ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

স্বপ্নে আপনের সঙ্গে | জুয়েল মোস্তাফিজ

স্মরণ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫
স্বপ্নে আপনের সঙ্গে | জুয়েল মোস্তাফিজ ছবি : রুদ্র আরিফ

শূন্য দশকের অন্যতম কবি আপন মাহমুদ। আকস্মিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভোরে।

‘সকালের দাড়ি কমা’ নামে তাঁর প্রথম ও একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় জীবদ্দশায়।

আপন মাহমুদ। বন্ধুর বুকটা কত চওড়া ছিল। ওর কবরটা বড় বাড়াবাড়ি করে ফেলল। ওর জীবনটাও অনেক বাড়াবাড়ি করত। ওর সিগারেটটাও আঁকাবাঁকা হয়ে পুড়ত। ওর কফিন বড় হাসাহাসি করেছে সারা পথ। ওর কবিতাগুলো পৃথিবীকে দেখে নিয়েছে একচোট। ... আপন রোজ রোজ স্বপ্নের ভেতর ঘুরতে লাগল...

১.
ঘাড়ে অনেকগুলো শালিক বসে আছে। আপন শালিকগুলোকে হাসি শেখাচ্ছে। জায়গাটা চিনতে পারলাম না। ওর সাথে আরো কে কে যেন ছিল। দেখা হতেই আপন না চেনার ভান করল। আমি বললাম, আপইন্ন্যা তুই এখানে কী করস? তোরে সবাই খুঁজছে? আপন কইল, ‘আমারে খুঁজবি ক্যান? আমি কি মরে গেছি বন্ধু? চল বাদাম খাই। জাদুঘরের সামনে। ’ এবার জায়গাটা চেনা যাচ্ছে। বাদাম কিনল আপন। বাদামওয়ালা টাকা না নিয়ে ওপর দিকে উড়তে লাগল। আপন বাদাম খাচ্ছিল গুনে গুনে। যেমন ১০ বার খাওয়া হলো তেমনি ওর হাত লম্বা হতে শুরু করল। লম্বা অনেক লম্বা হাত। আমি বললাম এই হাত তুই কই পাইলি? এত লম্বা হাত তোর তো ছিল না? আপন কইল, ‘আমি এখন লম্বা লম্বা হাত বানাই। ’ এই বলে ও চলে যেতে লাগল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। যেতে যেতে বলল, ‘জুয়েল, গেলাম রে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তোদের মতো কষ্ট ওরা বুঝে না। আর শোন মামুন কে বলিস তো...। ’
ঘুম ভেঙে গেল। মামুন খানকে ফোন দিলাম। মামুন?
- হ্যাঁ বল বন্ধু।
না কী বলব, আপন তো তা বলল না। ...

২.
চারদিকে পানি। না একবারে শুকনা। পিঠের ওপর দুধ বয়ে যাচ্ছে যেন। আপন ডাকছে। আমি পাল্লাচ্ছি। আপন বলছে, থাম থাম জুয়েল। থামলাম। আপন বলল, তোর বাসায় যাব। আমি বললাম, আমি জানি না। তুই সফেদ ফরাজীকে ধর। কিন্তু ওটা তো তোর ঘরে আছে। হ্যাঁ আছে, কিন্তু ওটুকু তুই নিয়ে যাস না। রুদ্র তোরে অনেক গালি দিছে। তুই মরতে গেলি ক্যান? ওটুকু তোর বুক থেকে আমরা নিয়ে এসেছি। আপন বলল, আমার কবরের মাটি আমাকে দেখা। বললাম, না বন্ধু তুই দেখিস না। আপন বলল, কখন নিলি? ওই তো একটু পরেই, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। তোকে রেখে আসতে চাইনি আমরা। সফেদ তোর কবরের মাটি তুলে কাঁদছিল। রহমান মাসুদ আর আমি দেখছিলাম। তারপর ওই মাটি নিয়ে এলাম। দোহাই তোর মাটিটুকু নিয়ে যাস না আপন। এরপর দেখি আপন একটা লাঙল হয়ে গেল। লাঙলটা চলে গেল মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে। খুব করে ওকে ডাকলাম। ফিরল না। ভয় লাগল খুব।

ছট করে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে ওর কবর থেকে তুলে আনা মাটি দেখলাম। মাটিটুকু একটা কাচের বোয়ামের ভেতর ফুফরে ফুফরে উঠল। ...

৩.
যেন এক প্রাণী বহরের নদী। মনে হচ্ছে সহস্র ঘোড়া ওই নদীর ঢেউ হয়ে ছুটছে। আমি নদীর কোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি তা ঠিক বুঝতে পারছি না। হঠাৎ দেখি নদীর মাঝখানে একটা ঘোড়া একবার উঁচু হচ্ছে একবার স্রোতে মিলে যাচ্ছে। একটুপরেই দেখা গেল ওই ঘোড়াটার পিঠে আপন। চিৎকার করলাম আপন... আপন... কই যাস। আপন কইল, ‘কোথাও যাই না, কদিনের জন্য এখানে এসেছি। খুব ভালো হলো, ভাবছিলাম তোদের কারো সাথে যদি দেখা হতো। ’ বললাম কেন আপন? আপন কইল, ‘একটা ঠিকানা দরকার। কিন্তু কার ঠিকানা দরকার তা ভুলে গেছি। অনেক চিঠি লিখেছি, পাঠাতে হবে। এখানকার কলমের কালিগুলো ভালো না। ওখান থেকে একটা আনছিলাম কিন্তু এখানে আর লেখে না। তুই ঠিকানাটা জোগাড় করে দে। আমার আঙুলে কিছু কালি আছে, ঠিকানাটা দিস কিন্তু। ’

এই বলে তার ঘোড়াটা স্রোতের সাথে তুমুল হয়ে উঠল। শেষবার আপন বলছিল, ‘লেবুপাতার গন্ধটা কেমন একটু বলতো, খুব মনে পড়ছে। খুব মনে পড়ছে। ছট করে ঘুম ভেঙে গেল। আরো কী কী যেন বলেছিল আপন মাহমুদ।

৪.
‘এই যে হাঁসগুলো দেখছিস এগুলো আমার। এরা খুব ভালো। কয়েকদিন আগে আমজাদ সুজন আসছিল ছবি তুলতে। ছবি উঠে নাই। হাঁসগুলোকে কত বুঝালাম, সুজন আমার বন্ধু একটু ছবি হও। না হাঁসগুলো শুনল না। তুই কি এদের সাথে কথা বলবি? মনে হয় কথা বলবে না। কত বুঝাই আমার অনেক বন্ধু আছে। আসবে একটু সম্মান কর না, করবে না। হাঁসগুলো আমাকে বলেছে, তোমার ক্যামেরা কলমকে আমরা পছন্দ করি। আমরা কেবল তোমার ছবি হতে পারি। এই হাঁসগুলো আমার। এখানে কোনো ঋতু নাই। এরা বৃষ্টি রোদঝড় কিছুই বুঝতে পারে না। আয় এখানে দাঁড়া, একটা জিনিস দেখাই। ’

এরপর মিলিয়ে গেল আপন আর তার হাঁসগুলো। হঠাৎ দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখি—আপন, ফেরদৌস, বিজয়, মামুন মুখে অনেক রঙ মাখছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে আজ থেকে তারা ডাকাত হবে। এই জন্য তারা প্র্যাকটিস করছে। আপন বলছে, তোরা ডাকাত হতে পরবি তো? এই বলে পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। এটা কোন জায়গা, চেনা যাচ্ছে না। দেখলাম ওরা হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল...

ঘুম ভাঙল। তখনও ভোর হয়নি। মনটা কেমন জানি লাগছিল। আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আর খুব করে স্বপ্নটা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাহ!

৫.
কলার ভেলার ওপর বসে আছে আপন মাহমুদ। পা দুখানা পানির নিচে। মুখটা ধবধবে শাদা। দেখে চমকে উঠলাম। আপন তো দেখতে কালো ছিল। হাত বাড়ালেই ওকে ধরা যায়, এমন দূরত্বে থেকেও ধরতে পারছিলাম না। আপন ভেলার ওপর বসে আছে নদীর দিকে মুখ করে। দূর থেকে বললাম, এখানে কী করছিস তুই। আপন বলল, ‘ধুর তোরা কই থাকিস, অনেকদিন এখানে বসে আছি। একটা কবিতা লিখছি। ভাবলাম তোরা এখানে আসবি। তাই বসে আছি। ’ বললাম, কী লিখেছিস পড় শুনি। আপন বলল, ‘ওতো সোজা এখন আর পড়া যাবে না। সফেদ আর শামীম ভাই গোসল করতে এসেছিল। তাদের শুনিয়েছি। এখন আমার কবিতা কেবল দুইজন শুনতে পারে। এটা এখন শেষ হয়ে গেছে। ’

এরপর দেখি আপন আর ওখানে বসে নেই। এদিক ওদিক দেখি আপন আর নাই। একটু পর সেখান থেকে চলে আসি। যেখানে এসে দাঁড়ায় সেটা ছিল একটা ডালিম গাছ। অস্বাভাবিক বড় বড় ডালিম ধরে আছে। সেখানে বসে পড়ি। এর একটু পর কী কী যেন হলো মনে নেই। তার খানিক পর দেখি একসাথে চার-পাঁচটা ট্রেন চলছে। সব ট্রেনের ছাদে আপন মাহমুদ। আপন বলছে প্রথম ট্রেনের ছাদ থেকে, ‘শোন গোলাম রাব্বানী একটা ফুলের নাম রেখেছে আমার নামে। নামটা একটু বলতো? সোমেশ্বর অলিকে বলিস দেখা করতে। হানযালা ছেলেটাকে বলিস সে একদিন ট্রেনে উঠতে পারবে। ...

***
এরপর বেশ কিছুদিন আমি আপন মাহমুদকে স্বপ্নে দেখিনি। এই স্বপ্নগুলো ছিল খুব বিস্তারিত। অনেক কথাই ঘুম থেকে জেগে আর মনে করতে পারিনি। কোনো কোনোদিন বিমর্ষ হয়ে আর লেখা হয়নি। এসব কারণে ওর কবিতার বইটা আর পড়তে পারতাম না। প্রতিদিন অনেক ঘুম পেয়েছি কিন্তু আপনকে আর পাইনি। তবে এর কিছুদিন পর আবার দেখা পাইলাম আপনের।

৬.
বড় একটা পেঁপের বাগান। মাঝখানে অনেক মানুষ। সবার হাতে একটা করে বাঁশি। কিছু লোক বাগানের ভেতর ঢুকছে। তাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে একটা করে ঢোল। কিছু লোক ওই আসর থেকে চলে যাচ্ছে, তাদের গলায় একটা করে মাফলার। কিছু লোক বাগানের মাঝখানে যেতে চাইছে কিন্তু তাদের চোখের ভ্রু নাই বলে যেতে পারছে না।

বাগানের মাঝখানে তুমুল বাজনা। বাজনার তালে তালে আপন নাচে। হায়রে তার নাচ। একবার দেখা গেল আহমেদ স্বপন মাহমুদকে। আপনের হাত ধরে তালে তালে নাচছে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ওইসব লোকের সাথে যাদের চোখের ভ্রু নাই। আপন-স্বপনের নাচ দেখে দৌড়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু যেতে পারলাম না। আপন এটা দেখে বলল, মামুন জুয়েলকে আসতে দে...। হঠাৎ পাশে দেখি মামুন। যেতে যেতে মামুনকে যেন বলছি, দেখছিস পুংটা আপনের কী ক্ষমতা? নাচের কাছে গিয়ে দেখি বেসামাল নাচ। নাচতে নাচতে স্বপন ভাই বলছে, আপন? কবি রে কবি চল সেই নাচটা নাচি? আপন স্বপন ভাইয়ের ঘাড়ে উঠে নাচে। কেমন করে এখন বলি নাচটা কেমন? মাঝে মাঝে মামুন বলে ওঠে, এহই! ওহই! আপইন্ন্যা ফাটাইয়্যা ফালা। আপন কইল, ‘এই আসরটা কেমন রে মামুইন্যা? তোরা আসছিস খুব ভালো হইছে। বলছিলাম না, আমি পেঁপের বাগানে একটা আসর দিব। ’

এরপর ঘুম ভেঙে গেল...

৭.
মাটিতে দাগ কেটে আমরা ষোলগুটি খেলছি। আশফাক বারবার বলছে, আপন ভাই এতদিন কোথায় ছিলেন? আপন বারবার আশফাককে বলছে, ‘খুব কাজরে ভাই, একদম সময় পাই না। ’ এই বলে আপন গুটির চাল দিচ্ছে। আমিও চাল দিচ্ছি। (এরপর আর মনে নেই...)

পরের দৃশ্যটা এমন—মাটি খুঁড়তে শুরু করেছি পাল্লা দিয়ে। কোদালের এক কোপ মারি আমি। আপন মারে আরেক কোপ। এমন সময় আপনের ফোন আসে। আপন হাসতে থাকে। বলতে থাকে, ফিরতে দেরি হবে। এই বলে আবার কোদালের কোপ। আমি মারি কোপ, আপন মারে আরেক কোপ। পাল্লাপাল্লি চলতে থাকে। এরপর আবার আপনের মোবাইল বাজে। রিংটোনে শোনা যায়, ‘কান্না কেন কান্না কেন তোর’। আপন ফোন ধরে। কী কী সব কথা বলে বোঝা যায় না। এরপর কাঁদতে থাকে সে। বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘ধুর আগে জানলে মরতামই না। ’ ফোন রেখে বলে, ‘চল, তাড়াতাড়ি কর। ’ এরপর যখন আমরা মাটি কোপাতে গেলাম, দেখলাম আমাদের কোদাল ভাত তোলার চামচ হয়ে গেছে। এরপর আবার আপনের মোবাইল বেজে উঠল। আপন ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর পেছন ফিরে তাকাল। বললাম, একটু পরে যা। চা খেয়ে যা। আপন বলল, ‘গাধা, আমি এখন চা খাই না...’

৮.
আমরা সবাই কবিতা শুনতে গেছি। মাঝখানটা গোলাকার ফাঁকা জায়গা। চারদিকে কিসের যেন গাছ। যারা কবিতা শুনতে এসেছে তারা সবাই এক-একটা গাছে উঠে বসে আছে। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় খালি গায়ে বসে আছে আপন। সে আজ কবিতা পড়বে। তাই সবাইকে ডেকেছে কবিতা শুনতে।   শামীম ভাই একটা গাছ থেকে বলে উঠল, আপন কবিতা পড়া শুরু করো। এই বলে শামীম ভাই কাঁদতে লাগল। খোকন ভাই শামীম ভাইয়ের চোখ মুছে দিল। এরপর কুমারদা বলে উঠল আপন কবিতা শুরু করেন। এই বলেই কুমারদা কাঁদতে লাগলেন। যে গাছে কুমারদা ছিলেন সেই গাছে মুজিব ভাই কুমারদার চোখ মুছে দিল। এবার সবাই চুপ। কিছুক্ষণ পর চঞ্চলদা বলে উঠলেন, আপন কবিতাটা পড় তো ভাই। এই বলে চঞ্চলদা ফোঁফাতে লাগলেন। জুয়েল ভাই চঞ্চলদাকে জড়িয়ে ধরলেন। আবারও সবাই চুপ। এবার কামাল ভাই কাঁদতে লাগলেন। হামীম ভাই কামাল ভাইকে থামালেন। এই করতে করতে গাছের ওপর থেকে মিল্টন মামা বললেন, আপন শুরু কর। এ কথা শুনে মাসুদ আর কাফি কাঁদতে লাগল। ওদের কান্না দেখে ইমতিয়াজ কাঁদতে লাগল। তাকে সান্ত্বনা দিলেন স্বরোজ। এরমধ্যে একটা গাছ থেকে স্বপন ভাই হাসান ভাই সবাইকে বললেন, আপনারা কেউ কাঁদবেন না। এই বলে তারা দুজনেই কাঁদতে লাগলেন। এই দেখে মাসুদ ভাই আর জাহানারা গাছ থেকে নেমে গেলেন। তারা দুই দিকে মুখ করে চোখ মুছলেন। একে একে সবাই গাছ থেকে নামলেন আর চোখ মুছলেন। পরে দেখা গেল, ফাঁকা জায়গাটা ফাঁকা। কেউ নেই। আপন চলে গেছে...



বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।