রফি হকের ছবিতে পৃথিবীর পড়ন্ত বিকেল আছে। সেই বিকেলের বিষণ্ণ হাসি আছে, গতি আছে, স্থবিরতা আছে; আছে নীরবতার কোলাহল।
রফি হকের ছবির প্রত্যেকটি অনুষঙ্গই স্বাবলম্বী। একে অন্যের সহায়কই শুধু নয়। বরং এক থেকে অন্যের ভিন্নতা কোলাজের অংশরা নিজ দায়িত্বেই দেখিয়ে যায়। রং শিল্পীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তির বন্ধনে স্বতন্ত্র। কারো ওপর কেউ আরোপিত হতে চায় না। রফি হকের রং এবং রেখার ভাষায় সেই সারল্য বিদ্যমান।
রফি হকের ছবির এই প্রকাশটা অদ্ভুত। সে কিছুই বলবে না। কিন্তু দর্শককে দাঁড় করাবেই। প্রকৃত শিল্প ব্যক্তিকে জ্ঞানের উপদেশ দেয় না। বিনোদন দেয়াও তার কাজ নয়। তার কাজ অনুভূতিগুলোকে জোরালো করে তোলা, স্পষ্ট করে তোলা। নতুন অভিজ্ঞতা আর ইতিহাসের আলোকে মননকে গতিশীল করা। রফি হকের ছবিতে সেই গতি আছে। সেটি সাধারণভাবে দেখা যায় না। যেমন খুব সহজেই দেখা যায় না—পৃথিবী ঘুরছে
মানুষ আর প্রকৃতির রূপকে প্রেম এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রচলিত উপস্থাপনায় নয়; বরং রফি হক দেখিয়েছেন আধুনিক মনের দ্বান্দ্বিক জটিল আলোকে। আধুনিক মন সহজ থাকতে পারে না। তাকে সন্দেহ করতে হয়। যেহেতু জানে সে স্বাধীন, তাই দায়িত্বটাও তার নিজেরই। নিজেকে নানা দিক থেকে দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত হয়। নতুন আবিষ্কার, দর্শন বা বিশ্বাসের আনন্দ তার সেই ক্লান্তিকে মুছে দেয়। ব্যক্তির ভাবনার পৃথিবীটা বড় হয়। রফি হকের ছবিতে সেই যাপনটি চলমান। আধুনিক শিল্পে এটাই স্বাভাবিক। রফি হকের শিল্পে স্বাভাবিকতার সাথে অন্য মাত্রাও আছে। তার ছবি প্রশ্ন রূপে উপস্থিত হয় ব্যক্তির ভাবনায়। ছবি কিছুই বলে না। অনেক উত্তরের আকর হয়ে চেয়ে থাকে। দায়িত্বটা দর্শককে নিতে ছবিই উৎসাহিত করে। ছবি দর্শকের আয়নায় দণ্ডায়মান। ব্যক্তি নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের মাঝেই উত্তর খুঁজে পায়। রফি হকের ছবির এই প্রকাশটা অদ্ভুত। সে কিছুই বলবে না। কিন্তু দর্শককে দাঁড় করাবেই। প্রকৃত শিল্প ব্যক্তিকে জ্ঞানের উপদেশ দেয় না। বিনোদন দেয়াও তার কাজ নয়। তার কাজ অনুভূতিগুলোকে জোরালো করে তোলা, স্পষ্ট করে তোলা। নতুন অভিজ্ঞতা আর ইতিহাসের আলোকে মননকে গতিশীল করা। রফি হকের ছবিতে সেই গতি আছে। সেটি সাধারণভাবে দেখা যায় না। যেমন খুব সহজেই দেখা যায় না—পৃথিবী ঘুরছে।
তার ছবিতে একটা পৃথিবী থাকে, থাকে একটা দিন। সকাল থেকে সন্ধ্যায় গড়াতে যে দিনটি ধারণ করে হাজার বছরের রূপ। রং রেখা তার নিয়ন্ত্রণে। মুক্তির বন্ধনে আপন কোলাজ। সাহিত্যের অভিজ্ঞতার সাথে মেলালে দেখা যায়, কবির কবিতা নির্ভর করে উপমা-চিত্রকল্প, রূপক উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ, বিষয় ভাষাসহ বেশ কিছু উপকরণের ওপর। এসবের মার্জিত রুচিসম্মত ব্যবহারই কবিতাকে প্রধান করে তোলে। হাত-পা, চোখ-নাক ইত্যাদির সমন্বয়ে মানুষ গঠিত, কিন্তু উপকরণগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হলে শুধু মানুষই প্রধান হয়, হাতের মানুষ বা পায়ের মানুষ না হয়ে—হয়ে ওঠে মানুষের হাত পা... ইত্যাদি। আর এসব শুধু জ্ঞান অনুশীলনেই সঠিকভাবে সম্পূর্ণ হয় না, তার জন্য প্রয়োজন গভীর অনুভবের সজাগ যাপন। অনেক জীবনকে অধিকার করতে হয়। শিল্পীকে অনেকগুলো জীবনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে হয়। তা করতে পারলেই রং তার ঔজ্জ্বল্যে থেকেও শিল্পের অনুগত হয়। রেখা তার পথে থেকেও শিল্পের অভিজ্ঞতার আলোকেই পথ দেখায়। রফি হক সেই শিল্পীদেরই একজন যার শিল্প তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সমষ্টিকে ধারণ করে।
libaration war 1971
‘মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১’ শিরোনামের ছবিটিতে পেপার লিথোগ্রাফে শিল্পী মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন। ছবিটির নিচের অংশে খুব ছোট করে শিল্পী মানুষের জটলা দেখিয়েছেন। উদ্বাস্তু জনতা লাশের স্তূপ দেখছে। হৃদয়ে তাদের শোকের আশ্রয়হীনতা। জীবনের চেয়ে তাদের কাছে মৃত্যুই সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছে। জীবন-মৃত্যু এত কাছাকাছি যে তারা নিজের কাছে নিজেরাই উচ্ছিষ্ট। সাদাকালো ছোট দুটো ছবি সেই করুণ সত্যকে উদ্ভাসিত করেছে। একেবারে উপরে রয়েছে আশ্রয় হারিয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে যাবার তাড়াহুড়ো। তার একটু নিচের দিকে চারটি মানুষের মাথা মনুষ্যত্বের আঘাতে আহত কিন্তু বিবেক তাদের ভাবনাকে প্রশ্ন করেই চলেছে নৃশংসতা বিষয়ে, লজ্জা দিচ্ছে মানুষরূপী অমানুষদের কর্মকাণ্ড দেখিয়ে। এই চারটি মাথা যেন হাজার বছরের মনুষ্য প্রজাতির কলহের অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর বহন করছে। তারা বেঁচে আছে—যেভাবে জীবনকে থাকতেই হয়, কোনো না কোনো ভাবে। এই সত্যের ছবিও চার মাথায় শিল্পী এঁকেছেন। চারদিকে হলুদ সবুজ শুকনো পাতা রয়েছে প্রবাহমানতার স্বাক্ষী হয়ে। রয়েছে কঠিন আঘাতের কালো ক্ষত। মাঝখানে ইতিহাস লেখা নতুন পুরনো পথগুলো বলছে—এভাবেই চলছে, চলে আসছে পৃথিবী তার বয়সের কাছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আঁকা ছবিটি মানব জাতির অমানবিক কর্মকাণ্ডের প্রতি যন্ত্রণা ছুঁড়ে দিচ্ছে। এক ধরনের অহিংস প্রতিবাদ, গভীর অভিমানে ঘৃণা মাখানো চোখে চেয়ে আছে ঘাতকের দিকে। দৃষ্টিটা চিরন্তন। এই চাহনি ১৯৭১ সাল বা তার ঘাতকদের দিকেই শুধু নয়, এই চাহনিটি আগামীর অনাকাঙ্ক্ষিত নরপশুদের দিকেও।
when I draw a circles
‘যখন আমি বৃত্ত আঁকি’ শিরোনামের তেল রং মাধ্যমের ছবিতে যাপনের প্রাত্যহিকতাই দেখা যায়। আধুনিক জীবনের নানান সমীকরণের জটিলতা। খণ্ড খণ্ড স্বপ্ন। স্বপ্ন ভাঙার ছোট ছোট কষ্টের কলরব স্বপ্নের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া। এখানে জীবনের নদী আছে। পারাপারের চেষ্টা আছে। অনিশ্চয়তার গোধূলিময় ছায়ায় জীবনকে মানুষের বয়ে বেড়ানো আছে। কারো জীবনে ফুল ফোটার দৃষ্টান্ত অন্যদের আশান্বিতও করছে। ছবিটিতে শিল্পী তার নিজের জীবনের প্রতিবেশি হয়ে ধরা দিয়েছেন। এবং অন্যদেরকেও সেভাবেই ভাবিয়েছেন। কোনো সিদ্ধান্ত তিনি দেননি। এমনকি কোনো মন্তব্য—তার ছবি—শিল্পীর পক্ষের হয়ে দর্শকদের করেনি। এটা চিত্র। একটি সামগ্রিক বহমান জীবনের ছবি। যেখানে শিল্প শুধু শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আলোড়িত না থেকে—হয়ে উঠেছে জীবনের প্রতিচ্ছবি। সকলের জীবনকথা।
দুটো ছবির যৎসামান্য পরিচিতি ছবির শিল্পমূল্যায়নের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। ছবির সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো শেয়ার করা মাত্র। শিল্পব্যাখ্যায় খুব বেমানান। শিল্পের ভূমি মাপতে যাওয়া অর্থহীন। অবিরাম শিল্প ধারণ ক্ষমতা অর্জন করতে চাওয়াই মানুষের সাধনার বিষয়। ক্লাসিক শিল্প সে কথাই বলে। যা শুনতে পাই রফি হকের চিত্রকর্মেও। রফি হকের শিল্পে শিল্পীর জীবন দেখার দর্শন আছে। মানব জীবনকে আরো বেশি করে চেনার আগ্রহ আছে। রফি হক জীবন দেখবেন, মানুষ দেখবে। আমরা তার ছবিতে খুঁজে পাব সময়ের পরিচয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫