পর্ব ৭ পড়তে ক্লিক করুন
ভারতীয় হওয়ার উপায়?|
বিলাতি নারীরা ভারত নিয়ে গোপনে গোপনে নানারকম স্বপ্ন পোষণ করলেও তারা কি সত্যি কখনো ভারতীয় হতে পেরেছিলেন? এর উত্তর আমাদের সবারই জানা। ভারতীয় জনগণের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি বিলাতিদের কখনোই খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
কিন্তু তারপরও কেন এই বিলাতি নারীরা তাদের জীবন ধারণের জন্য সেই ভারতকেই আকড়ে ধরে পড়ে রইলেন? কী ছিল সেই ভারতে?
ভারতীয়দের সাথে বিলাতিদের এই দূরত্বের কারণে বিলাতিরা কখনোই ভারতের মাটিতে নিজেদের সুখী এবং নিরাপদ ভাবতে পারেনি। ঊনিশ শতকের আগ পর্যন্ত বিলাতিরা তাদের নিজেদের এই মনোভাবকে পরিবর্তন করতে সমর্থ ছিলেন না। বলা যায় সেদিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কাজের সুবিধার জন্যে ভারতীয়দের সঙ্গে প্রথম লেনদেন শুরু করে। এই লেনদেন প্রথম দিকে ব্যবসা সংক্রান্ত হলেও পরবর্তীতে তা সামাজিক লেনেদেনেও পরিণত হয়। ইউরোপিয়ানদের সাথে ভারতীয় সমাজের এই দূরত্বের কারণে ওই আমলে বিলাতিরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বৈকি! সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক এই সীমাবদ্ধতার কারণে বিলাতিরা তাদের নিজেদের তৈরি করা জগৎ থেকে খুব একটা বের হতে পারেনি। বিষয়টা বিলাতিরা যখন অনুধাবন করেছিল, ততদিনে বেলা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে।
উন্নত সামাজিক জীবন যাপন, অর্থ আর খ্যাতির প্রতিই বিলাতি নারীদের বেশি লোভ ছিল। ভারতে বিলাতি সমাজে বিভিন্ন পেশা শ্রেণী অনুযায়ী তাদের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ হলেও বিলাতিরা তাদের জাতিগত প্রশ্নে ছিল এক। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রেলওয়ে কর্মচারি সর্বস্তরের বিলাতি মোটামুটি ভারতীয়দের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে সবসময়ই সচেষ্ট ছিল। ট্রেনে, স্টিমারে, রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই ‘ইউরোপিয়ান অনলি’ ট্যাগের সুযোগ সুবিধা নিতেন এই বিলাতিরা। যে কারণে বিলাতি নারীরা ভারতীয় হওয়ার চেয়ে নিজেদের ‘মেমসাহেব’ ভাবতেই বেশি ভালোবাসতেন। রবার্ট ক্লাইভ যখন বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে হারিয়ে বাংলার মসনদ দখল করে নিলেন তখন তার স্ত্রী মার্গারেট নিজেকে ‘রানী’ সম্বোধন করে তার বোনকে চিঠি দিয়েছিলেন। মূল কথা হলো বিলাতি নারীদের পক্ষে বিলেতে যা করা বা হওয়া সম্ভব ছিল না—তাই তারা ভারতে আহরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
তবে ভারতীয়দের সঙ্গে বিলাতিদের এই দূরত্বের কারণে বিলাতিরা কখনোই ভারতের মাটিতে নিজেদের সুখী এবং নিরাপদ ভাবতে পারেনি। ঊনিশ শতকের আগ পর্যন্ত বিলাতিরা তাদের নিজেদের এই মনোভাবকে পরিবর্তন করতে সমর্থ ছিলেন না। বলা যায় সেদিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কাজের সুবিধার জন্যে ভারতীয়দের সঙ্গে প্রথম লেনদেন শুরু করে। এই লেনদেন প্রথম দিকে ব্যবসাসংক্রান্ত হলেও পরবর্তীতে তা সামাজিক লেনেদেনেও পরিণত হয়। ইউরোপিয়ানদের সাথে ভারতীয় সমাজের এই দূরত্বের কারণে ওই আমলে বিলাতিরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বৈকি! সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক এই সীমাবদ্ধতার কারণে বিলাতিরা তাদের নিজেদের তৈরি করা জগৎ থেকে খুব একটা বের হতে পারেনি। বিষয়টা বিলাতিরা যখন অনুধাবন করেছিল, ততদিনে বেলা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ভারতীয়রাও ঠিক বুঝতে পেরেছিল, আর যাই হোক, এই জাতি তাদের বন্ধু হওয়ার নয়। একটা সময় এমন দাঁড়ায় যে, ভারতীয়রাও কিছুটা ভয়ে আবার কিছুটা ঘৃণার সাথেই ইউরোপিয়ানদের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে শুরু করল। পরবর্তীতে গান্ধিজী ভারতের মাটিতে আসার পর বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে আরো প্রকট আকার ধারণ করল। তবে ইংরেজরা তাদের এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল একটু দেরিতে। ‘কিভাবে ভারতীয়দের সাথে আন্তরিকভাবে মেশা যাবে’—এই উদ্দেশ্যে ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একটি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে উচ্চপদস্থ বিলাতি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের ‘প্রাথমিক উর্দু শিক্ষা’র ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিলাতি নারীদের উঁচু নাকের সামনে উর্দু শিক্ষার জোয়ার খুব একটা বেগবান হতে পারেনি। তবে ভারতীয়দের সাথে বিলেতিদের সামাজিক এবং ভাষাগত ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য চতুর ইংরেজ শাষক বিভিন্নরকম ফন্দি ফিকির শুরু করে দিয়েছিল।
ইংরেজদের সঙ্গে ভারতীয়দের সামাজিক দূরত্ব যোজন যোজন মাইলের হলেও অনেক বিলাতি নারী ভারতীয়দের সাথে মেশার সুযোগ পান এবং ভারতের সংস্কৃতি এবং ভাষার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ১৮৪৮ সালে এমিলি মেটকালফে নামের এক বিলাতি নারী তার বাবার সাথে দিল্লিতে ছিলেন। তার বাবা ছিলেন দিল্লির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মেটকালফের সঙ্গে একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের সখ্য হয়েছিল। তিনি তাদের সম্পর্কে লিখেন, “মিসেস ফস্টার এবং তার বোন মিসেস ফুলার তারা উভয়ই খুব ভালো মানুষ। শংকর হওয়ার কারণে তাদের চামড়ায় বাদামি বর্ণের প্রভাব লক্ষণীয় এবং তাদের ভাষার উচ্চরণও ছিল অনেকটাই কৌতূহলদীপ্ত। তাদের পরনে ছিল সুন্দর তুলা দিয়ে নির্মিত সাদা লম্বা গাউন। তারা উভয়েই ছিলেন অসাধারণ ভালো দুজন বৃদ্ধা, যাদের পুত্র এবং কন্যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দ্য মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দ্য ব্রিটিশ অ্যামপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড,২০০৫)।
অনেকেই ভারতীয়র সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন। লেডি লগিন নামের এক বিলাতি নারী তার স্বামীর সঙ্গে লখনৌতে বসবাস করতেন। তার স্বামী ছিলেন লখনৌর কোর্টের একজন ডাক্তার। লেডি লগিন সেখানকার কোর্টে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তিনি কোর্টে উপস্থিত সব ভারতীয়দের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতেন। লগিনের ভাষায়, “ভারতীয়রা এক কথায় অসামান্য। তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে। ” মিসেস ফানি পার্ক যিনি ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের একজন বিলাতি নারী—ভারতীয় নারীদের শাড়ির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। তার ভাষায়, “অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত এক পোশাক। ” ১৮০০ সালের দিকে মিসেস মারিয়া গ্রাহাম ভারতে ভ্রমণ করতে এসে তার স্মৃতিকথায় লিখেন, “ভারতের প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থগুলোতে সর্বত্রই শুদ্ধতা এবং নৈতিকতার কথা খুঁজে পাওয়া যায় যা মানুষের সামাজিক এবং বাস্তবসম্মত চরিত্রকেই ধারণ করে” (ওমেন অব দ্যা রাজ: দ্যা মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দ্যা ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৫৪)
পর্ব ৯ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫