“আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি। ” ট্রেনের জানালার বাইরে, আলোর ঝাঁপি ফেলে শাঁ শাঁ ধেয়ে চলা ভোরে চোখ রেখে বলল শারমিন।
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। ভিমরি খেয়ে জিব পুড়িয়ে ফেললাম গরম চায়ে। চায়ের কাপ নামিয়ে মনোযোগী চোখে ওকে দেখলাম। উদাস মুখে বাইরেই তাকিয়ে আছে। ভাসা ভাসা চোখে রাতজাগা ক্লান্তি। এছাড়া ওকে দেখতে সজীবই লাগছে। চুলগুলো পরিপাটি। শাড়ি পরেই রাতে শুয়েছিল, তবু কোথাও কোনো ভাঁজ নেই। জার্নিতে ওকে কখনো এলোমেলো দেখিনি। অথচ আমি অল্প দূরত্বে কোথাও গেলেও মোটামুটি আলুথালু হয়ে যাই। চা-টা বেশ ভালোই ছিল। ভাবছিলাম, আগে চা শেষ করব কিনা। কিন্তু ও যে কথাটা বলল তাতে ওর দিকে মনোযোগ না দিয়ে চা খাওয়ায় মন দেয়া ঠিক হবে না। চায়ের কাপ একপাশে সরিয়ে বললাম, “আমার দিকে তাকাও। কী বলছো এসব?”
দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলল, “সত্যিই, আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসিনি। আমি পথিককে ভালোবেসেছিলাম। ”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিয়ে বসলাম। বিয়ের পর থেকেই এই এক যন্ত্রণা প্রায় বছর দুই ধরে জ্বালিয়ে মারছে আমাকে। পথিক আমার গল্প-উপন্যাসের একটা চরিত্র। বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছি ওই চরিত্রটি নিয়ে, গল্পও। মূলত, পথিককে নিয়ে লেখাগুলো পড়েই শারমিন আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। সে ভেবেছিল পথিকের সব বৈশিষ্ট্যই আমার মধ্যেও আছে। বিয়ের আগে প্রায় বছর খানেক সম্পর্ক ছিল আমাদের। তখন অনেক বুঝিয়েছি—আমি রক্তমাংসের বাস্তব আর পথিক কল্পিত চরিত্র। লাভ হয়নি। প্রতিনিয়তই সে আমার মধ্যে পথিকের ছায়া খুঁজেছে। অবশ্য বিয়ের আগে ওকে খুশি রাখতে নিজের চরিত্রের বাইরে গিয়েও অনেক আচরণ করেছি, পথিকের মতো করে। কিন্তু বিয়ের পর একসময় ক্লান্ত হয়ে পথিক চরিত্রে আর অভিনয় করিনি। আমি যা নই তা প্রমাণের চেষ্টা শুধু অনর্থকই নয়, ভীষণ মনোকষ্টেরও। দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত পর বললাম, “বাস্তবে নামো শারমিন, কল্পনায় ভেসে কি জীবন চলে?”
মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। “কেন কল্পনাটাই বাস্তব হবে না?” ওর চোখে জল আর পাতলা ঠোঁটে রাজ্যের অভিমান।
হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ভাগ্যিস এসি সিট না নিয়ে একেবারে কেবিনই নিয়ে নিয়েছিলাম। নইলে নিশ্চিত অন্য সবার সামনে অপমানিত হতাম। ও কখনোই রেগে বা চেঁচিয়ে কথা বলেনি আমার সাথে।
বিয়ের পর থেকেই এই এক যন্ত্রণা প্রায় বছর দুই ধরে জ্বালিয়ে মারছে আমাকে। পথিক আমার গল্প-উপন্যাসের একটা চরিত্র। বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছি ওই চরিত্রটি নিয়ে, গল্পও। মূলত, পথিককে নিয়ে লেখাগুলো পড়েই শারমিন আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। সে ভেবেছিল পথিকের সব বৈশিষ্ট্যই আমার মধ্যেও আছে। বিয়ের আগে প্রায় বছর খানেক সম্পর্ক ছিল আমাদের। তখন অনেক বুঝিয়েছি—আমি রক্তমাংসের বাস্তব আর পথিক কল্পিত চরিত্র। লাভ হয়নি। প্রতিনিয়তই সে আমার মধ্যে পথিকের ছায়া খুঁজেছে। অবশ্য বিয়ের আগে ওকে খুশি রাখতে নিজের চরিত্রের বাইরে গিয়েও অনেক আচরণ করেছি, পথিকের মতো করে।
অবশ্য চেঁচিয়ে ওঠা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বুঝতে পেরে ও বলল, “সরি। আসলে আমার অনেক কষ্ট!”
“কী কষ্ট? তুমি জানো তোমাকে ভালোবাসি আমি, এতে কোনো খাঁদ নেই। তবু কেন কষ্ট তোমার?”
“আমার কষ্ট পথিককে না পাবার। ”
“বারবার এ কথা কেন বলো। তুমি ওই চরিত্রটার প্রতি অবসেস্ড। এটা তোমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আর তর্কের খাতিরে ধরে নাও না, আমিই পথিক। কেবল সময়ের সাথে সাথে আমার কিছু পরিবর্তন এসেছে। ”
“তুমি পথিক নও। যদিও অনেকবারই ওর চরিত্রে অভিনয় করার চেষ্টা করেছো। আমারই ভুল। তুমি বিয়ের আগে বুঝিয়েছো আমাকে, তবু আমার কেবলই মনে হয়েছে তোমার মধ্যেই ওকে পাব। কিন্তু তুমি ওর মতো নও একদম। তোমাকে ওর মতো কখনো কোনো কিছুর জন্যে সংগ্রাম করতে হয়নি। পৈতৃক সম্পত্তির সুবাদে তুমি যখন যা চেয়েছো তা পেয়ে গেছো। এমনকি তোমার লেখক হয়ে ওঠাও তোমার অনেক টাকা ছড়ানোর জন্যই। নইলে তোমার মতো তরুণ প্রতিভাবান অসংখ্য লেখক একটা বই ছাপানোর জন্যে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ভিখারির মতো ঘুরছে। ”
“এসব...”
আমাকে থামিয়ে দিল শারমিন। ‘প্লিজ শাহেদ, আমাকে বলতে দাও। আজ আমাকে এসব বলতেই হবে। সবসময়ই তোমার একঘেঁয়ে সুটেড-বুটেড হয়ে চলা ফেরা, এসি ছাড়া থাকতে না পারা, সবসময় দামি রেস্টুরেন্টে সবচেয়ে দামি খাবারটা খাওয়া, নিয়ম করে ঘুমানো, নির্দিষ্ট রুটিনের বাইরে এক কদমও না ফেলা—সবই আমার অপছন্দ আর এসবের কিছুই পথিকের চরিত্রে নেই। ”
“শেষ হয়েছে তোমার বলা?” অধৈর্য হয়ে বললাম।
“না। তুমি কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসো না। তুমি বরং নিরাপদে বসে বৃষ্টি দেখতে ভালোবাসো। মধ্যরাতে জোছনা দেখতে ছাদে উঠে যাওয়া তোমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। অথচ শুধু পথিকই নয়, তোমার গল্প-উপন্যাসের অনেক চরিত্রই ভীষণরকম বৃষ্টি-জোছনা ভালোবাসে। লেখার উপকরণ তুমি বাস্তবতা থেকে না নিয়ে কল্পনা থেকেই পেতে ভালোবাসো। একটা উদাহরণ দিই, দু’মাস আগে আমরা কক্সবাজার থেকে ফিরছিলাম। পথে একটা এক্সিডেন্টে একজন রক্তাক্ত মানুষ রাস্তায় পড়ে কাঁতরাচ্ছিল, অথচ তুমি গাড়ি থামিয়ে নামোনি। আমি অনেকবার অনুরোধ করেছিলাম, তবু থামোনি। অথচ তোমার একটি উপন্যাসেই, পথিক এরকম একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে আহত মানুষটিকে নিজে বুকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে আর মানুষটা যখন মারা যায় তখন আপনজন হারানোর মতো কষ্টে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। এছাড়াও আরো একদিন এক রিক্সাচালক তার ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের কিডনি অপারেশনের জন্য সাহায্য চাইতে এলে একশ’ টাকা দিয়ে তুমি বিদায় করে দিয়েছো। কিন্তু পরের সপ্তাহেই দেখলাম এটা নিয়ে পত্রিকায় চমৎকার একটা গল্প ছাপা হলো তোমার। যেখানে যথারীতি তোমার জনপ্রিয় চরিত্র পথিক মেয়েটির চিকিৎসার টাকা তোলার জন্য নাওয়া-খাওয়া, কাজ-টাজ সব বাদ দিয়ে খেটেছে এবং তার একার চেষ্টাতেই মেয়েটি সুস্থ হয়ে ওঠে। অথচ পথিক তোমার মতো ধনী নয়। তোমাকে কখনো সব ফেলে কোনো মানুষকে সাহায্য করতে ছুটে যেতে দেখিনি। অবশ্য কিছুদিন আগে একইরকমভাবে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে তুমি প্রজন্ম চত্বরে যেতে শুরু করেছিলে। যদিও জানি না ওখানে তোমার দ্বারা কার কতটা উপকার হয়েছে। তোমাকে কখনো পথিকের মতো স্ট্রাগল করতে হয়নি, ওর মতো হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে হয়নি, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবার জন্যে রাত জেগে গাদাগাদি করে বাস-ট্রেনে চলাফেরা করতে হয়নি। পথিক কল্পিত হয়েও জীবন্ত আর তুমি বাস্তব হয়েও প্রাণহীন। তুমি...”
এবার আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “কেন এসব বলছো? কী চাও তুমি?”
“মুক্তি! আমি পুতুল জীবন থেকে মুক্তি চাই। আমি মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই পুতুল হয়ে নয়। ”
“মানে?”
“তোমার সাথে বিয়ের পর থেকেই আমাকে পুতুলের মতো থাকতে হয়েছে। যখন যা চেয়েছো তা-ই করে গেছি। তোমার বই প্রকাশিত হয়েছে তো হাসিমুখ করে সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তুমি বইমেলায় ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছো, সেখানেও মেকি হাসি ধরে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা আমার। তুমি পুরস্কার নিতে যাও, সেখানে দর্শক সারিতে বসে আমার কাজ শুধুই হাসিমুখে হাততালি দেয়া। তোমার জীবনে কোথাও আমার সরব ভূমিকা নেই। সবসময়ই, তোমার খুশিমতো জায়গায় আমাকে বেড়াতে যেতে হয়েছে। এই যে, এবার আমরা রাঙামাটি থেকে ফিরছি। পাহাড় আমার অসহ্য লাগে। তবু তোমাকে খুশি করতেই আমি গেছি। আমি ভালোবাসি সমুদ্র, কিন্তু সেটা তোমার অপছন্দ বলে তুমি কক্সবাজারে একদিনের বেশি দু’দিন থাকো না। আমি একটা কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করতে চেয়েছিলাম, সেটাও তুমি দাওনি। অথচ তুমি পথিক হলে আমাকে এই পুতুলের জীবন বয়ে বেড়াতে হতো না!”
“তোমার সাথে বিয়ের পর থেকেই আমাকে পুতুলের মতো থাকতে হয়েছে। যখন যা চেয়েছো তা-ই করে গেছি। তোমার বই প্রকাশিত হয়েছে তো হাসিমুখ করে সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তুমি বইমেলায় ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছো, সেখানেও মেকি হাসি ধরে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা আমার। তুমি পুরস্কার নিতে যাও, সেখানে দর্শক সারিতে বসে আমার কাজ শুধুই হাসিমুখে হাততালি দেয়া। তোমার জীবনে কোথাও আমার সরব ভূমিকা নেই। সবসময়ই, তোমার খুশিমতো জায়গায় আমাকে বেড়াতে যেতে হয়েছে। ”
আহত গলায় বললাম, “এসব কখনোই বলোনি। আমি ভেবেছি আমার পছন্দই তোমার পছন্দ। ”
“বলে কী লাভ হতো? তোমার আমিত্ববোধের কাছে আমি বা আমার মতামত দুটোই তুচ্ছ। তাই আমি মুক্তি চাই। ”
আমি ওর হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিয়ে নরম গলায় বললাম, “তোমার সব অভিযোগ অযৌক্তিক বলব না। কিন্তু আমি আমার স্বভাবের বাইরে যেতে পারি না, এটা তো মানো? কিছু অভ্যাস না হয় বদলেই নিলাম। শুধু প্লিজ, আমাকে পথিকের সাথে তুলনা করো না। আমার খারাপ লাগে। আর মুক্তির কথা বলছো কেন? তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”
শারমিন নিরাসক্তভাবে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আমি পথিককে ছাড়া থেকেছি, তোমাকে ছাড়াও থাকতে পারব!”
আহ! আবারও পথিক। আমার নিজের সৃষ্টি এভাবে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে কখনো ভাবিনি। বিয়ের পর শারমিনের—আমার ভেতর পথিককে খুঁজে পাওয়ার তীব্র হাহাকার দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকবারই ভেবেছি পথিককে নিয়ে আর এক লাইনও লিখব না। একবার তো ভেবেছি মেরেই ফেলব। পারিনি। অনেক মায়া জন্মে গেছে ওর জন্যে। পথিককে আমিও ভালোবাসি। আমার যত না পারা কাজ, না বলা কথা, না দেখা বিচিত্রতা; সবই পথিকের মধ্যে ফুটিয়ে তুলি।
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম, “তুমি কি চাও?”
“ডিভোর্স। ” দৃঢ় কণ্ঠে বলল ও।
ভয়ানক চমকালাম। ওকে দেখে মনে হলো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। একটু কষ্ট হলো আমার। এই অপরূপা নারীটিকে আমি ভালোবাসি। অথচ সে আমাকে চাইছে না, চাইছে আমারই সৃষ্ট এক ভ্যাগাবন্ড চরিত্রকে, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। পরমুহূর্তেই ভীষণ রাগ হলো। সে ভেবেছে কী? আমার ওকে না হলে চলবে না? অসংখ্য মেয়ে ভক্ত ফেসবুকে আমাকে প্রতিদিন টেক্সট করে, কথা বলতে চায়। মোবাইল নাম্বার খোঁজে। কেউ কেউ আবার ঠিকানা যোগাড় করে দেখা করতেও চলে আসে। তাদের মধ্যে ওর চেয়েও ঢের সুন্দরী মেয়ে আছে। কাউকেই আমি পাত্তা দিইনি কখনো। শারমিনের জায়গায় অন্য কোনো মেয়েকে কখনো ভাবিনি। অথচ সে আছে ভাবের জগতে, পথিককে নিয়ে।
কাঠখোট্টা গলায় বললাম, “যা বলছো ভেবে বলছো তো? পরে হয়ত আফসোস করবে। সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার আগে ভালো করে ভেবে নেয়া উচিত। বরং এক কাজ করা যাক, চলো আমরা মাসখানেক আলাদা থাকি। তারপর হয়ত তুমি তোমার ভুল বুঝতে পারবে। ”
“এই মাসখানেকে কি তুমি পথিক হয়ে যাবে? হবে না। আমি হুট করে সিদ্ধান্ত নিইনি...” ব্যাগ হাতড়ে একটা কাগজ বের করে আমার সামনে মেলে ধরল। “ডিভোর্স পেপার। আমি রেডি করে রেখেছি। তারিখটা দেখো, ছ’মাস আগের। ছয়মাস ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার সাইন করা আছে। এখন তুমি সাইন করে দিলেই হয়। আর আমি কোনো দাবি রাখিনি তোমার কাছে। ওসব স্পষ্ট লেখা আছে। পড়ে নিতে পারো। ”
ভীষণ নাড়া খেলাম। নিষ্ফল ক্রোধ আর কষ্টের মিশেলে বিচিত্র এক অনুভূতি দাপড়ে বেড়াতে লাগল বুকের ভেতর। মৃদু গলায় বললাম, “সাইন করে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ। এরপর তুমি তোমার পথে আমি আমার পথে। আর আমি কিন্তু তোমার সাথে ফিরছি না। সামনেই জিনারদী স্টেশনে নেমে যাব। ”
“ওটা কোথায়? কখনো নাম শুনিনি। এখন বাসায় না ফিরলে তোমার কাপড়-চোপড় গয়না ওসব কখন নেবে?”
“বললাম না আমার কোনো দাবি নেই। গয়না-কাপড় আমার প্রয়োজন নেই। আর স্টেশনটা নরসিংদীর পরে। ছোট একটা স্টেশন। ”
“এই ট্রেন তো ছোটখাট স্টেশনে থামে না। ”
“থামবে। তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে তখন টিটির সাথে কথা বলেছি আমি। তিনি বলেছেন ব্যবস্থা করবেন। ”
“ওখানে কে আছে? আচ্ছা সত্যি করে বলো, আমি পথিক নই বলেই ছেড়ে যাচ্ছো আমাকে, নাকি কারো সাথে সম্পর্ক আছে তোমার? যার জন্যে পথিকের গল্প ফাঁদছো। সেরকম কিছু হলে বলতে পারো। ভয় নেই, আমি আটকাব না। ”
“জিনারদীতে আমার এক খালা থাকেন। নিরিবিলিতে তাঁর কাছে থাকব কিছুদিন। আর সত্যিই, তুমি পথিক নও বলেই যাচ্ছি। এটা তুমি বিশ্বাস করতে পারো। ”
“ওঃ। ”
এরপর দুজনেই চুপ করে গেলাম। শারমিন একদৃষ্টে বাইরেই তাকিয়ে রইল। আমি কখনো বাইরে কখনো ওর মুখে চোখ রাখছিলাম। আধঘণ্টা পর উঠল সে। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বলল, “এখনো সাইন করোনি তুমি। ”
“ওহ সরি। ” দ্রুত সাইন করে কাগজটা ওকে ফিরিয়ে দিলাম।
কাগজটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, “সময় করে তোমাকে একটা কপি পাঠিয়ে দেব। ”
“হুম। ”
“যাওয়ার আগে একটা অনুরোধ ছিল। ”
“বলো?”
“এরপর বিয়ে করলে, ভক্তদের কাউকে বিয়ে করো না। হয়ত বেচারী আমারই মতো হতাশ হবে। এমন কাউকে বিয়ে করো যে তোমার ভক্ত নয়। তাহলেই তুমি সুখী হবে। ”
“সবাই কি তোমার মতো হবে?” বলতে বলতেই টের পেলাম ট্রেন থামছে।
“তাও ঠিক। সবাই আমার মতো হবে না...” একটু থেমে বলল, “আমি কিন্তু জানি, আমি নেমে যাবার পর তুমি কী করবে। ”
“কী করব, তোমাকে ফেরানোর জন্য তোমার পেছনে দৌঁড়াব? কখনোই না। আই অ্যাম নট দ্যাট টাইপ। ফিরলে তুমি নিজেই ফিরবে। ”
মলিন হাসল শারমিন। “এখানেই তোমার সাথে পথিকের তফাৎ! যাইহোক, আমি নেমে যাবার পর তুমি নিজেই বুঝবে তুমি কী করবে। গেলাম। ”
ট্রেন পুরোপুরি থামতেই দ্রুত নেমে গেল শারমিন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শারমিন একাই নেমেছে এই স্টেশনে। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। শারমিন একবারও পেছনে না তাকিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। ওর ছিপছিপে শরীরে সকালের আলো পড়ায় ওকে মুহূর্তের জন্য অপার্থিব মনে হলো। ওর আকাশী রঙা শাড়ির লম্বা আঁচল উড়ছে হাওয়ায়। খোলা দীর্ঘ চুলগুলোও। ওর হেঁটে যাওয়ায় আড়ষ্টতা নেই, দ্বিধা নেই। যেন সে জানেই, অচেনা অদৃশ্য ভবিষ্যত কখনোই ওকে পুতুল জীবন উপহার দেবে না। শারমিনের হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটা দেখেই মনে হলো চমৎকার একটা মনস্তাত্ত্বিক গল্প হতে পারে এ নিয়ে।
পরমুহূর্তেই চমকে উঠলাম, আমি ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়েও একটা গল্প লেখার কথা ভাবছি! শারমিন হয়ত এটাই বোঝাতে চেয়েছিল—আমি ওকে হারানোর পর হাহাকার না করে নতুন কোনো গল্প নিয়ে ভাবব। তারমানে কি আমার ভেতরে কোনো মানবীয় গুণ নেই? হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। ওকে ফেরাতে হবে। ওকে আমি ভালোবাসি। দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে ছুটলাম। দরজার কাছে গিয়ে বুঝলাম নামা সম্ভব নয়। গতি বেড়ে গেছে। একবার ভাবলাম চেইন টেনে থামাই ট্রেনটা। পরক্ষণেই বাতিল করে দিলাম ভাবনাটা। সিনেমাটিক কিছু করা আমার চরিত্রে নেই। নির্বিকার হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। একসময়, বিন্দু হতে হতে শারমিন একদম মিলিয়ে গেল। মনে হতে লাগল, ছুটন্ত ট্রেনে পড়ে রইলাম কেবল আমি, নিজের সৃষ্টির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাওয়া একা একজন লেখক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫