পর্ব ১২ পড়তে ক্লিক করুন
টিকে থাকার লড়াই |
বিলাতি নারীরা ভারত ভ্রমণের প্রাক্কালে সর্বোচ্চ গুরুত্বে যে বিষয়টি নজরে আনতেন তা হলো ভারতের অনাগত জীবন যাপন কেমন হবে তা নিয়ে বাস্তবসম্মত চিন্তা-ভাবনা। যথেষ্ট পরিমাণ নিত্য প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, তৈজষপত্র সঙ্গে নিয়ে তারা ভারতে আসতেন।
ফলে শহরে যে সমস্যাগুলো ছিল না, মফস্বলবাসের সময় সে সমস্যাগুলোই তাদের দাঁতে কামড় দিয়ে সহ্য করে নিতে হতো। চাকরির প্রয়োজনে নিজেদের সঙ্গে আনা ট্রাংক বা সুটকেসে রাখা কাপড় চোপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিত্যই ঘুরতে হতো তাদের। বিশেষ করে যারা মিশনারি বা ডাকঘরে কাজ করতেন, তাদের প্রচুর গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে কাজটি করতে হতো। হনরিয়া লরেন্স তার এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে সঙ্গে বয়ে নেওয়া জিনিসপত্রের একটি বিবরণ দিয়েছেন—“এক বাক্স চা এবং চিনি, সাগু, চায়ের কেটলি, প্লেট, কাপ, ছুড়ি, জামা, বিয়ার, মদের ছিপি খোলার যন্ত্র, মরিচ, লবণ এবং মোম বাতি। ” সঙ্গে খাবার দাবারের পাশাপাশি ছিল কিছু ‘মেডিকেল ফাস্ট এইড’
মনিকা গান গাইতে ভালোবাসতেন। তার সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল একটি সাধের পিয়ানো। তাই ভারতে আসার পথে সঙ্গে করে পিয়ানোটি আনতে ভুললেন না। কিন্তু ভালোবাসার ধনকে কতদিন আর আগলে রাখা যায় বলুন? ১৮৮২ সালের জুনের এক ফুরফুরে সন্ধ্যা। আসামের চা বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি মঞ্চকে ঘিরে আলো ঝলমল করছে আর সেই আলোর নাচনে সেখানকার স্থানীয় মানুষজন, চা বাগানের কুলি থেকে শুরু করে কর্তা ব্যক্তিরা সবাই আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। সবার চোখে মুখে আনন্দ। স্থানীয় চা বাগানের কুলিদের নিয়ে বিলাতি বড় সাহেব গান বাজনা এবং নাচের আসর বসিয়েছেন। আরো মজার খবর হলো সেই অনুষ্ঠানে গান গাইবেন স্বয়ং বড় সাহেবের সদ্য বিলেত থেকে আসা স্ত্রী মনিকা লাং। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিলাতি সমাজ তো বটেই, ভারতীয় রাজা মহারাজারা পর্যন্ত বিষয়টা নিয়ে পরস্পর ফিসফাঁস করতে লাগলেন। “না জানি কেমন গায়! আবার নাকি নিজেই সে পিয়ানো নামের বিশাল আকারের সেই কাঠের বাক্সটাকে বাজাবে!”
সামনের সারিতে জোড়ায় জোড়ায় সব বিলাতি সাহেব-মেম আর স্থানীয় রাজা-মহারাজারা তাদের স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বসে আছেন। মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া চাদরে স্থানীয় আমজনতা। পেছনের চেয়ারে বসে আছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী আর উঠতি ধনী সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন। চারপাশে কড়া সতর্কতা। হাতির পাল দিয়ে মঞ্চের চারপাশ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কাঠের মঞ্চের ঠিক পাশেই মনিকার বিশাল আকারের পিয়ানোটা লণ্ঠনের আলোয় চিকচিক করছে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্থানীয় শিল্পীরা তাদের গান গাইল, কেউ বাঁশি বাজাল এবং নাচল। মনিকা লাং-এর গানের অনুষ্ঠান ছিল সবার শেষের দিকে। তিনি ততক্ষণে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল ঠিক তখনই। বলা নেই কওয়া নেই একটা বেয়াদব হাতি তার বিশাল কানটা দোলাতে দোলাতে সোজা মঞ্চের পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর খুব ধীরস্থিরভাবে একটা পা আয়েশের সাথে পিয়ানোটার ওপর রাখল। আর কী! যা হবার তা ততক্ষণে হয়ে গেছে। চোখের সামনেই পিয়ানোটির এমন অপমৃত্যু দেখে মনিকার প্রাণ যায় আর কি! কিসের আর অনুষ্ঠান! মনিকা শুধু ‘মাই গড’ বলে সাদা মোজায় ঢাকা হাত দিয়ে তার লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ঢাকলেন। অনুষ্ঠান পণ্ড হলো। মনিকার পিয়ানোটি ভেঙ্গে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। জানা যায়, মনিকা লাং সেই শোকে গান ছেড়ে দিয়েছিলেন। চোখের সামনে পিয়ানোটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে ভারতে মনিকাকে বছর দুই অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এবং শেষ পর্যন্ত সেই শোক সইতে না পেরে তিনি ভারত ছেড়ে আবার তার প্রিয় ‘হোম’ বিলেতে ফিরে গিয়েছিলেন।
আগেই বলেছি, বিলেত থেকে ভারতে যেতে সঙ্গে কী কী জিনিসপত্র নেওয়া যাবে বা নিয়ে যাওয়া উচিত তার একটা ছোটখাট ফিরিস্তি সেই সময়ের ভ্রমণ সহায়ক পুস্তিকাগুলোতে পরিস্কারভাবেই বর্ণনা করা থাকত। যেসব বিষয় ভঙ্গুর, যেমন কাচের জিনিসপত্র, চিনামাটির তৈরি তৈজষপত্র—ভারত যাত্রায় এসবকে সঙ্গী না করার পরামর্শ দেওয়া হতো। তবে কথায় বলে ‘শখের মূল্য লাখ টাকা’। সে কারণে অনেক বিলাতি নারীই সেসব পরামর্শ খুব একটা আমলে নিতেন না। ‘ইন্ডিয়ান আউটফিট’ পুস্তিকায় ভারত ভ্রমণে সঙ্গে করে হালকা লিনেন জাতীয় কাপড় না নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ছিল। কারণ হিসেবে তাদের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, ভারতের আবহাওয়ার আর্দ্রতার সাথে লিলেন কাপড় খুব একটা মিশে যেতে পারে না। লিলেন যেহেতু গায়ের ঘাম শুষে নিতে পারবে না, তা শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এ ধরনের কাপড় না নিয়ে যাওয়াই সঙ্গত। তবে জুতা বা স্যান্ডেল সঙ্গে রাখা জরুরি বলে ‘ভিক্টোরিয়ান গাইড’-এর দাবি। তাদের যুক্তি হলো, স্যান্ডেল বা জুতা বিলাতি নারীদের সুন্দর মায়াবী পদযুগলকে ভারতের ধূলামাটি থেকে শুধু রক্ষাই করবে না, সেইসাথে মাটিতে বসবাস করা বিভিন্ন ধরনের কীট পতঙ্গের হাত থেকেও পদযুগলকে রক্ষা করবে।
ভারত ভ্রমণকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের পুস্তিকা বলুন আর সরকারি বিধিনিষেধের কথাই বলুন, বিলাতি নারীরা ভারতে কিভাবে তাদের জীবন যাপন করবেন, কিভাবে ভারতের পথে হাঁটবেন, তাদের জীবনের নোঙর ফেলবেন—সে রাস্তা তারা নিজেরাই আবিষ্কার করতে ভালোবাসতেন। বুঝতে হবে যে, বেশিরভাগ বিলাতি নারীই ভারতে যেতেন তাদের নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে। সন্দেহ নেই, ভারত অনেক দূরের পথ, আর সেইসাথে তাদের জন্যে অনেকটাই কুহেলিকায় ঘেরা এক কল্পরাজ্যও বটে! তারপরও এ কথাটি তারা ভালো করেই জানতেন যে, একবার ভারতে যেতে পারলে তাদের ভাগ্য খুলে যাবে। ভারতের প্রতিটা জেলায় এবং রেলওয়ে স্টেশনে ইউরোপিয়ানদের জন্যে ডাক বাংলোর ব্যবস্থা ছিল। বিলাতি মেমসাহেবরা ভারত ভ্রমণ করবেন আর ডাক বাংলাতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেবেন না তা কী করে হয়? ইউরোপিয়ানদের জন্যে রেলওয়ের প্রথম শ্রেণীর কামরার সুবিধা নেওয়া ছিল অতি অবশ্য একটি কাজ। নাকউঁচু ইউরোপিয়ানরা কখনোই ভারতীয়দের সাথে রেলের একই কক্ষে যেতেন না।
১৯২০ সালে ভারতে আগ্রা প্রদেশে হাইকোর্ট একজন ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে একটি রুল জারি করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি ছিল—সে ইউরোপিয়ানদের জন্যে বরাদ্দকৃত প্রথম শ্রেণীর কামরায় চড়ে রেল ভ্রমণের স্বপ্ন দেখেছিল। ভারতীয় নাগরিকটির দাবি ছিল, যেহেতু তিনি প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনেছেন তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রথম শ্রেণীর কামরায় রেল ভ্রমণ করতে পারেন। বলা প্রয়োজন যে, সেই সময় ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিলেতের মতো এত সুগম ছিল না। রেলপথ ছাড়া জলপথে ছিল কিছু বাষ্পচালিত জাহাজ। সেইসাথে ব্যবহৃত হতো নৌকা, যা বিলাতি নারীদের জন্য মোটেই প্রীতিকর ছিল না। যেসব বিলাতি নারীরা তাদের স্বামীদের সাথে কিংবা চাকরির সূত্রে শহরের বাইরে থাকতেন, তাদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, ডাক গাড়ি ছিল মফস্বল শহরের অন্যতম যাতায়াত মাধ্যম। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে বিলাতি নারীদের যাতায়াত খুব যে সুখকর ছিল, না তা। এ বিষয়ে একজন বিলাতি নারীর কাছ থেকেই শোনা যাক। হনোরিয়া লরেন্স নামের এই বিলাতি নারী আঠার শতকের দিকে ভারত এসেছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন, “পালকির বেয়ারাগুলো খুব ভালোভাবেই বহন করার দক্ষতা রাখে, তারা ছন্দে ছন্দে পা ফেলে এবং দৌড়ে দৌড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর এদিকে পালকির ঝাঁকুনির চোটে মনে হতো এই বুঝি আমি মাটিতে পড়ে যাব। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দ্য মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৭৬)।
লেডি লগিন নামের এক বিলাতি নারী লাখনৌতে অবস্থানকালে গভীর রাতে কিভাবে নৌকায় চড়ে একটি নদী পাড়ি দিয়েছিলেন তার চমৎকার একটি স্মৃতিচারণ করেছেন। তার বর্ণনায় নদীতে ভাসমান নৌকার দুলে দুলে চলা এবং সেইসাথে থেকে থেকে নদীর পানির ছাটে গা ভিজে যাওয়ার এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে—“নৌকাটা হেলেদুলে চলছে, আর সেইসাথে আমিও দুলছি। নদীর ঠাণ্ডা পানি এসে লাগছে আমার গায়। গাটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ”
প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি আরেকটি চিন্তার বিষয় ছিল যথেষ্ট লোকবলের অভাব। মফস্বল শহরের জরুরি কোনো কাজে—বিলাতি নারীদের জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গারোয়ান, বেয়ারা বা কুলি (বিলাতিরা কুলি বলেই ডাকত) যোগাড় করা খুব সুলভ ছিল না। প্রথম কারণ, বিলাতিরা ভারতীয় ‘নেটিভদের’ ওপর আস্থা বা বিশ্বাস রাখতে পারত না। আর দ্বিতীয়ত, কাজের জন্যে তারা খুব একটা সহজলভ্যও ছিল না। ফলে শহরে যে সমস্যাগুলো ছিল না, মফস্বলবাসের সময় সে সমস্যাগুলোই তাদের দাঁতে কামড় দিয়ে সহ্য করে নিতে হতো। চাকরির প্রয়োজনে নিজেদের সঙ্গে আনা ট্রাংক বা সুটকেসে রাখা কাপড় চোপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিত্যই ঘুরতে হতো তাদের। বিশেষ করে যারা মিশনারি বা ডাকঘরে কাজ করতেন, তাদের প্রচুর গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে কাজটি করতে হতো। হনরিয়া লরেন্স তার এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে সঙ্গে বয়ে নেওয়া জিনিসপত্রের একটি বিবরণ দিয়েছেন—“এক বাক্স চা এবং চিনি, সাগু, চায়ের কেটলি, প্লেট, কাপ, ছুড়ি, জামা, বিয়ার, মদের ছিপি খোলার যন্ত্র, মরিচ, লবণ এবং মোম বাতি। ” সঙ্গে খাবার দাবারের পাশাপাশি ছিল কিছু ‘মেডিকেল ফাস্ট এইড’।
তারপরও, যতই কষ্ট হোক না কেন, ভারতে টিকে থাকার জন্যে বিলাতি নারীদের চেষ্টার কোনো অন্ত ছিল না। যেকোনভাবেই হোক ভারতের মাটি আঁকড়ে ধরে ভারতে বসবাস করাটা সেই সময়ে একজন বিলাতি নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
পর্ব ১৪ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৫