শামসুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪০ সালে, মানিকগঞ্জে। তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
বাংলা একাডেমিতে মহাপরিচালক হিসেবে আপনার সাফল্য কী?
বাংলা একাডেমিতে যোগদান করি ২০০৯ সালে। আমি যখন যোগ দেই তখন এই একাডেমিতে শুধুমাত্র একটি বর্ধমান হাউজ আর একটি প্রেসভবন ছিল। দুটি ভবনই তুলনামূলকভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। এখন যে কেউ বাংলা একাডেমিতে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন যে, এর আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নতুন করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নামে আট তলা একটি প্রসাশনিক ভবন হয়েছে। সেখানে আব্দুল করীম সাহিত্য বিশারদের নামে আমরা একটা মিলনায়তন করেছি। যেখানে এখন প্রায় ৬০০ লোক একসাথে বসতে পারে। এছাড়া কবি শামসুর রাহমানের নামে আমরা একটা ছোট হল করেছি, যেখানে ১৭০ জন লোক বসতে পারে। এছাড়া অতিসম্প্রতি বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক ড. এনামুল হকের নামে আমরা নতুন আরো একটি ভবন করেছি। আমাদের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল, প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ রচনা করা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ করতে চেয়েছিলেন। তখন কিছু কিছু হিন্দু ব্রাহ্মণদের বিরোধিতার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এতদিন পরে আমরা সেই কাজটি বেশ সফলভাবেই সম্পন্ন করেছি। ব্যাকরণ গ্রন্থটি রচনার করার জন্য পশ্চিমবাংলার বাংলা আকাদেমির অধ্যাপক পবিত্র সরকার এবং এখানকার প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে সাথে নিয়ে কাজটি করা হয়েছে। ব্যাকরণটি প্রকাশ হওয়ার পরে এটি এতটাই প্রশংসিত হয়েছিল যে, এটি নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া “শেষ পর্যন্ত চলতি বাংলা একটি নিজস্ব গ্রামার পেয়েছে” এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছিল।
প্রতিবছর একুশের বই মেলার আয়োজন এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারকে আমরা বাংলা একাডেমির অন্যতম সাফল্য বলে মনে করি। বাংলা একাডেমির বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন...
বাংলা একাডেমির কাজ কিন্তু বইমেলার অয়োজন করা নয়। বরং বইমেলার কাজ করতে গিয়ে একাডেমির সামগ্রিক কাজে বিঘ্ন ঘটে। তবে একাডেমি প্রতিবছর বাংলাদেশের এই বড় উৎসবটির আয়োজন বেশ সফলভাবেই করে থাকে। এবছরই আমরা বাংলা একাডেমির ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে হীরক জয়ন্তী করতে যাচ্ছি। আগামী ৩রা ডিসেম্বর আমরা এ নিয়ে একটি সাহিত্য সম্মেলন করার পরিকল্পনা নিয়েছি। বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমি সাম্প্রতিক কয়েক বছরে যে বিপুল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও গবেষণাকর্ম বাস্তবায়ন করেছে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি বাংলা একাডেমির ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়েছে। আমরা আশাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। এই সম্মেলনে আরো যোগদানের কথা রয়েছে কলকাতার বাংলা আকাদেমি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রধান। এছাড়া বিহার এবং নেপাল থেকেও অতিথিরা আসবেন বলে আমরা আশাবাদী। আমরা আশাবাদী এবছর একুশে বইমেলা আরো বিশাল পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে।
এবার আমরা সাম্প্রতিক বিষয়ে আসব। আমরা দেখেছি সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে একটি টিভি অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। যাতে আপনি অন্যতম প্রধান গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহেনা-ই মূলত এই পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন ১৯৭১ সালে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বরে রাখা হলো, তখন একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই পাণ্ডুলিপির প্রথম খণ্ড উদ্ধার হয়। প্রথমদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনাই এটির সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে অবশ্য বেবী মওদুদ এই কাজের সাথে যুক্ত হন। ২০০৩ সালের দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে বলেন এই কাজে সম্পৃক্ত হবার জন্য। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অধ্যাপক ফকরুল আলমকেও যুক্ত করা হয় এটির অনুবাদ করার জন্য। আমরা দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রম করে এই বইটির সম্পাদনার কাজ শেষ করি। ২০১২ সালে ইউপিএল এটির প্রকাশনার কাজ করে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান এবং ভারতে এটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অতিসম্প্রতি জাপানি এবং চীনা ভাষায়ও এটি প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটি নিয়ে চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমে বিটিভি এবং চ্যানেল আই “বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন” নামক একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে। যেখানে দেশের বিশিষ্টসব ব্যক্তিরা এটি পাঠে অংশ নেন। এরপূর্বে কোনো আত্মজীবনী নিয়ে এত বিশিষ্টজদের একসাথে অংশ নিতে আমি দেখিনি।
বাংলা একাডেমির ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কে বলুন...
বাংলা একাডেমিকে নিয়ে বেশকিছু পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো গোটা বর্ধমান হাউজকে জাদুঘরে পরিণত করা। এর মধ্যে রয়েছে একটি ভাষা জাদুঘর, জাতীয় সাহিত্য-লেখক জাদুঘর, বাংলা একাডেমি আর্কাইভ এবং লোকসংস্কৃতি জাদুঘর। এ পরিকল্পনাগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে বাংলা একাডেমি সংস্কৃতির একটি তীর্থভূমিতে পরিণত হবে।
আপনি যে পরিকল্পনাগুলোর কথা বললেন, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে জায়গা অর্থাৎ আয়তন প্রয়োজন, তা কি একাডেমির যথার্থ পরিমাণে আছে?
এই কাজগুলোর জন্য খুব বেশি আয়তনের জায়গার প্রয়োজন হবে না। আমাদের পেছনের দিকে যে জায়গা আছে, যা আগে বইমেলার জন্য ব্যবহার হতো, সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে। ভবনের কাজ সম্পন্ন হলে বর্ধমান হাউজের পুরোটি খালি করা হবে। ফলে পুরো বর্ধমান হাউজকে জাদুঘরে পরিণত করতে তখন তেমন কোনো সমস্যা হবে না। যেসব প্রকল্পের কথা বললাম, তার সবই সরকারের কাছে পেশ করেছি এবং সরকার নীতিগতভাবে এসব প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমরা জানি যে, বাংলা একাডেমি অভিধান প্রকাশ করে থাকে। বইমেলার সময় দেখা যায় অভিধান কেনার প্রতি মানুষের বেশ আগ্রহ। এ বিষয়ে বলুন...
বর্তমানে একাডেমি ব্যবহারিক অভিধানসহ অনেকগুলো অভিধান প্রকাশ করেছে। বর্তমানে আমাদের ২৫টির মতো অভিধান রয়েছে এবং বাংলা একাডেমির লাভজনক বই হলো বাংলা একাডেমির অভিধান। এটি সত্যি যে, বইমেলার সময় অভিধান বিক্রি বেড়ে যায়। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, বিক্রির দিক থেকে অভিধান বিক্রি সবচেয়ে এগিয়ে আছে।
একাডেমি নিয়ে দীর্ঘ কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা?
আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, বিশেষত লক্ষ্যহীনভাবে কাজ করলে এর তো কোনো ফল আসবে না। তাই বাংলা একাডেমি আগামী ৫০ বছর কী কী কাজ সম্পন্ন করবে বা করতে পারে সে ব্যাপারে একটি কর্মপরিকল্পনার কথা ভাবা হচ্ছে। এটি যদি করা যায়, তবে অনেক কাজ সহজ হবে। আমরা এখন সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সাক্ষাৎকার
৬০ বছর পূর্তিতে বাংলা একাডেমির আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন
সাক্ষাৎকার ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।