স্মৃতিলেখা দেবী কেন মধ্যরাতে একা মন্দিরে এসেছিলেন, দূর্গা বুঝতে পারেন নি। ক্লান্তিতে ঘুম চলে এসেছিল চোখে।
সামনের যে তৈজষপত্র দেখা যাচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেখানকার নৈবেদ্যগুলোও বাসি হয়ে গেছে। দূর্গার ঘরের ব্যস্ততা কমে গেছে হঠাৎ। শোরগোল শোনা যায় উঠোন বাড়ি থেকে। কী হচ্ছে, কী নিয়ে ব্যস্ত সবাই বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। দশ রাত্রি হলো প্রদীপ জ্বালানোর দিকেও মনোযোগ কমে গেছে ঠাকুরের।
স্মৃতিলেখা দেবী চলে যাবার পর কখন যে নিদ্রাদেবী তাকে বশ করেছিলেন মনে পড়ছে না। ঘুম ভেঙেছিল বেশ আগে। তারপরও কেমন একটা ঘুম ঘুম ঘোর লেগে ছিল চোখে। তাই চোখ মেলে তাকানো হয় নি। কিন্তু ঘরের ভেতর শোরগোল অন্যদিনের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল যেন। ঠাকুরের জপও কানে এলো। বেশ কিছুদিন সেই জপ কানে ওঠেনি দূর্গার। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। একি!—আগের আসনে নেই তিনি। তাকে ঠাকুর ঘরের মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনা হলো কখন?
শাঁখের আওয়াজ আসে বাইরে থেকে। অন্য সময় ঐ আওয়াজ কানে এলেই, নতুন আলোর জন্য তৈরি হতেন তিনি। দশ সন্ধ্যে গেল, অন্ধকারে নেমে যাওয়ার অনেক পরে আলো পড়ে ঘরটায়। তুলসীতলাতে পুঁজো দিতে এসে পাশের বাড়ির অনিমা দূর্গার সঙ্গে আলাপ জমাতে আসত। ওর আনন্দের কথা, দুঃখের কথা বলে যেত কলকল করে। দূর্গা সেই আলাপ শুনতে শুনতে কখনো বিষণ্ণ হতেন, আবার কখনো দুলে উঠতেন খুশিতে। সন্তানের সুখে-দুঃখে মায়ের ভেতর এই স্রোতই তো বয়ে যাবার কথা। বাড়িতে অনিমা খুব সুখে থাকে বলা যাবে না। স্বামী ঢাকায় থাকে। এখানে শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় ওকে। তাই কোনো কোনো দিন এসে আবদার করে—“মা তোমার দশ হাত ধার দেবে আমাকে? দাও না, তাতেও যদি তাকে তুষ্ট করতে পারি। ” দূর্গা অনিমার এই কথায় বিষণ্ণ হন। শাশুড়ি নিজেও তো মা। উনিও তো সংসারে দূর্গারূপে অবস্থান নিতে পারেন? তা না করে কেন সন্তানকে পীড়িত করেন, সন্তান পীড়নে কী সুখ মায়ের? ঐ অনিমাও আসছে না ক’দিন।
অভ্যাসে যিনি ভুল করেন নি, তিনি স্মৃতিলেখা দেবী। যেন নিজের অতীত স্মৃতিকে সজীব রাখতেই প্রতিদিন দূর্গার মুখোমুখি হয়েছেন। স্মৃতিলেখার উচ্চারণে ইদানীং চমকে ওঠেন দূর্গা। স্মৃতিলেখা হাতজোড় করে বলেন—“তুমিই ফিরে এসো আবার শিউলী রঙা শাড়ি পরে। কাশফুলের রথে চড়ে মুঠো রোদ নিয়ে এসো মা আমার জন্যে। তোমাকে ফিরতে হবে মা আমার জন্যই। আমি বাষ্পিত হবার আগে তোমার বিসর্জন নয় মা। তবে আমাকে দেখার যে কেউ রইবে না। ” দূর্গা ভেবে পান না কেন স্মৃতিলেখার মনে বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করেছে। শিউলীর সুবাস নাকে এসে লাগছে। ধূপের গন্ধকে ছাপিয়ে শিউলী ওকে মোহিত করে রাখে। কাশফুল দিয়ে তার শরীর ছুঁয়ে দেয়। বাইরে এবার কাশফুলের ঝড় উঠেছে। নীল আকাশ আর শুভ্র কাশের এমন যুগলবন্দি নাকি বহুদিন হয় নি। এই ঘর থেকে উঁকি দিয়ে সেই যুগলবন্দির খুনসুঁটি দেখবার খুব ইচ্ছে দূর্গার।
স্মৃতিলেখা দেবী চলে যাবার পর কখন যে নিদ্রাদেবী তাকে বশ করেছিলেন মনে পড়ছে না। ঘুম ভেঙেছিল বেশ আগে। তারপরও কেমন একটা ঘুম ঘুম ঘোর লেগে ছিল চোখে। তাই চোখ মেলে তাকানো হয় নি। কিন্তু ঘরের ভেতর শোরগোল অন্যদিনের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল যেন। ঠাকুরের জপও কানে এলো। বেশ কিছুদিন সেই জপ কানে ওঠেনি দূর্গার। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। একি!—আগের আসনে নেই তিনি। তাকে ঠাকুর ঘরের মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনা হলো কখন? ঘরের দরজার দিকে একটু আড়ালে এনে রাখা হয়েছে। তার আসনে নতুন একজন এসে দাঁড়িয়েছেন। লালপাড় সাদা শাড়ি, কপালে জরির তিলক। চোখে মাসকারা দেয়া এই সুন্দরী কে, তিনি কখন এলেন? মুখে তার প্রসারিত হাসি। সেই হাসির মধ্যে অহংয়ের ফোড়ন দেয়া। এই ফোড়ন কি কেবল দূর্গার শরীরে এসেই বিঁধছে? ঘরে পরিচিত মুখগুলোকে দেখা যাচ্ছে আবার। নৈবেদ্য নিয়ে এসে ভীড় করছে সবাই। নতুনকে নমস্কার জানাচ্ছে। জ্বালানো ঘিয়ের প্রদীপ। শিউলী ফুলে ফুলে নতুনের চরণ ঢেকে যাচ্ছে। শরীর ছুঁয়ে দেয়া হচ্ছে শিউলীতে।
গঙ্গাধরপট্টির নিরুপমার হাতে একগোছা কাশফুল। নতুনকে নমস্কার করে সেই কাশফুল দিয়ে ঠিক যেমন স্পর্শ চেয়েছিলেন দূর্গা, তেমন করেই নতুনকে স্পর্শ দিয়ে গেল নিরুপমা। আজ একবারের জন্যও নিরুপমা দূর্গার দিকে তাকাল না। অথচ কত একলা দুপুর নিরুপমা কাটিয়ে গেছে দূর্গার সঙ্গে। ত্রিবেদী যেন শুধু ওরই হয়—এজন্য কত বায়না করে গেছে। এক দুপুরে চুপিচুপি ত্রিবেদীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। দূর্গার সামনে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল ওরা। যাবার সময় দূর্গাকে টগর উপহার দিয়ে গেছিল ত্রিবেদী। আজ একবারের জন্যও নিরুপমা ফিরে তাকাল না।
দরজার আড়ালে দূর্গার দিকে কেউ চোখ রাখছে হয়ত। কিন্তু একজন ঠিকই চোখে চোখ রেখে আছেন সেই প্রথম থেকেই। দূর্গাই বরং তার দিকে চোখ তুলে চাইছেন না। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা ভয়ে। সন্তানরা তাকে এভাবে ছুঁড়ে দেবেন তা ভাবতে পারেন নি তিনি। মাকে এভাবে একরাত্রিতে দূরে সরিয়ে দেয়া যায়? সন্তান কী করে পারে এই অসুর হতে? সন্তানের এ কাজে মায়ের লজ্জার শেষ নেই। ভয়ও এসে ভর করেছে মনে। তার চলে যাবার সময় এসেছে। সন্তান তাকে বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। এই বিসর্জনে সব সময় জলের স্পর্শ পাওয়া হয় না। কারো ভাগ্যে নদী জুটলে তো স্বর্গবাস। সেই বরাত পান খুব কম জনই। মজা ডোবাতেই ঠাঁই পান বেশিরভাগ। দূর্গা জানেন না তার ললাটে কী লেখা আছে। ঘরের পেছনের মজা পুকুরেই তার বিসর্জন হবে হয়ত।
আজ মনে পড়ছে তিনি যেদিন এই ঘরে এসেছিলেন, সেদিন তিনিও ছিলেন নতুন। সাদা জবা রঙের জমিনে শিউলীর জাফরান রঙের পাড় ছিল শাড়িতে। তাকে সম্ভাষণ জানাতেও ভীড় করেছিলেন পূজারীরা। নৈবেদ্যের ঢল নেমেছিল ঘরে। দূর্গার চোখ তুলে তাকালেন নতুনের দিকে। চঞ্চল চোখ নতুনের। তাই তো হবে নবীনের। দুর্গমকে জয় করে পরমেশ্বরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নতুন। দূর্গামাসুরের দুই রূপ স্বার্থন্ধতা ও অবিদ্যাকে জয় করে তিনি মাতৃরূপ বিরাজিতা হয়ে আর্বিভূত হয়েছেন।
দূর্গা ভাবেন এই ব্রহ্মাণীরূপে তো তিনিও এসেছিলেন। তাহলে সন্তানরা কেন মুখ ফিরিয়ে নিল। নতুন যেন দুই হাত বুকের মাঝখানে এনে তাকে নমস্কার জানালেন। এ যেন বিদায় সম্ভাষণ। দূর্গাও দুই হাত তুলে সেই নমস্কারের জবাব দিলেন। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল। দু’বার বলতে গিয়ে থেমে যান। তারপর শেষমেষ বলেই ফেললেন—“সন্তানেরা নতুনকে দেখো। নতুনের কাছ থেকে শিক্ষা নাও কী করে পুরাতনকে বিদায় জানাতে হয়। বিদায় নিচ্ছি আমি। বিশ্বেশ্বরীর আগমন ঘটেছে তোমরা তাকে বরণ করেছো। দেখো সেই নতুন কী করে পুরাতনকে বিদায় জানাচ্ছেন। তোমরা সন্তান হয়ে তার কাছ থেকে দীক্ষা নাও বিদায় বলার। সন্তানেরা তোমাদের ওপর করুণাধারা বর্ষিত হোক। ”
দূর্গা ঘুরে দাঁড়ান। তিনি নিজেই যেন চৌকাঠ পেরোবেন। পেছন থেকে ডাক, ফিরে দেখেন নতুনের হাতে স্মৃতিলেখা দেবীর সেই পদ্ম।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৫