ভারতের অনগ্রসর সমাজের মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক, মাঝি, গাড়োয়ান, মজুরদের সামনে যখন বিনোদনের কোনো প্রশস্ত পরিসর ধরা দেয়নি, সেই প্রত্যূষে গানের পাখি হয়ে আনন্দ ও বিনোদনের ডালি হাতে নিয়ে হাজির হয়েছেন বাঙালির প্রাণের শিল্পী আব্বাসউদ্দীন (জন্ম: ২৭ অক্টোবর ১৯০১; মৃত্যু: ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯)। আর কেবল শ্রমিক-মাঝি প্রভৃতি পিছিয়ে পড়া সামাজিক সম্প্রদায়ের কথাই বা বলি কেন—বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন গান-বাজনাকে সংস্কৃতির উপাদান বা বাহন হিসেবে ভাবতে ও গ্রহণ করতে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি, তখন এক প্রতিকূল পরিবেশে সঙ্গীতের সুন্দর সাধনা ও প্রয়োজনীয় প্রচারণার প্রাথমিক ধাপটি ব্যক্তিগত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন।
আজ এতদিন পরেও অনুমান করা যায়, অনুসন্ধিৎসা ও সমাজ-রূপান্তরের অভিজ্ঞান ও আন্তরিকতাই ছিল তাঁর সমূহ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। মুসলমান নাগরিকের চিন্তায় সাঙ্গীতিক আবহ প্রবেশের কৌশল হিসেবে তিনি নজরুলের কয়েকটি গান প্রচারের অভিযানে নেমেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মনে করা যায়—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ/এলো রে দুনিয়ায়/ আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি দারুণ শ্রোতাপ্রিয় নজরুল সঙ্গীতের কথা। এইসব ইসলামি গান শুনে সঙ্গীতের প্রতি তখনকার অনগ্রসর মুসলমান সমাজের আগ্রহ জেগেছিল—যা ছিল সমকালীন সমাজে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই যে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সঙ্গীতের আনন্দভুবনের দিকে ডেকে আনা—এর প্রায় সিংহভাগের দায় সেদিন নিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন
বাংলা গানের অভিভাবকসম ব্যক্তিত্ব তিনি; বাংলার লোকসঙ্গীত-সংসারের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। পুরো নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ। আব্বাসউদ্দীন নামেই সমধিক পরিচিত। বিশেষত পল্লীগীতির শিল্পী হিসেবে সারা বাংলায় খ্যাত ও সমাদৃত। আদি নিবাস ভারতের কুচবিহারের তুফানগঞ্জ এলাকায়। পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন জোতদার এবং পেশায় অ্যাডভোকেট। পারিবারিক আবহে, স্বাভাবিকভাবেই, তিনি সামাজিক সংকট ও বিভ্রান্তি অবলোকনের সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর মানস গড়ে উঠেছিল সমাজ-রূপান্তরের সমাগত পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে। এই স্বভাবশিল্পী তাঁর চারপাশের জীবনাচার, মানুষের প্রাণের তাগিদ, সমাজের গতি ও প্রগতির দিকে প্রসারিত রেখেছিলেন নিজের সাবধানী ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি। শৈশব থেকেই আব্বাসউদ্দীন গান-বাজনার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন সরল ও স্বাভাবিক প্রাণময়তায়। অদ্ভুত সুন্দর ছিল তাঁর কণ্ঠ; দারুণ আকর্ষণীয় ছিল গানের গলা। গান আয়ত্ত করার বা মনে রাখার ক্ষমতাও ছিল অবিশ্বাস্য রকম; যেকোন গান দু-একবার শুনেই অবিকল সুরে গাইতে পারতেন তিনি।
অবিভক্ত ভারতে ও পরবর্তীকালের পাকিস্তানে সঙ্গীতসাধক ও প্রচার-প্রসারক হিসেবে তিনি সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই তিনি সমকালে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। এবং উত্তরকালেও নিজের প্রভাব ও অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন কেবল শৈল্পিক সাফল্যের ওপর ভর করে। এই সাধক সঙ্গীতশিল্পী কখনো কোনো শিক্ষকের বা গুরুর কাছে শিক্ষা বা তালিম নেন নি। নিজের প্রচেষ্টায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিখুঁতভাবে গান গাওয়ার রীতি ও কৌশলাদি আয়ত্ত করেছেন মেধা আর কণ্ঠের কারুকাজকে কাজে লাগিয়ে। সঙ্গীতে পারফর্ম ও পাবলিসিটিতে অনন্যসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং বাংলাদেশ সরকার ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। তবে পুরস্কার দুটি ছিল মরণোত্তর।
স্নাতক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে চাকরিতে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। দেশবিভাগের আগে কলকাতার বাংলা সরকারের রেকর্ডিং এক্সপার্ট এবং পরে অতিরিক্ত সঙ পাবলিসিটি অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মপরিসরের পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং ব্যক্তিগত ঝোঁকের কারণেই হয়ত বাংলা সঙ্গীত প্রচার ও প্রসারের দিকে তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী ও মনোযোগী হয়ে ওঠেন। অবশ্য অন্তরে ছিল প্রকাশের ভার আর সৃজনকর্মের তাগিদ। চাকরিতে প্রবেশের অল্পকাল পরেই কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে প্রফেশনালি সঙ্গীতভুবনে প্রবেশ করেন। কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে নজরুলের ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে’, ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’; শৈলেন রায়ের ‘আজি শরতের রূপ দীপালি’; এবং জীতেন মৈত্রের ‘ওগো, প্রিয়া নিতি আসি’—এ চারখানি গান রেকর্ড করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি তখনকার কলকাতায় গানের ভুবনে জনপ্রিয়তা সৃষ্টিকারী একজন অনবদ্য ও অনুকরণীয় কণ্ঠকারিগর। সঙ্গীতের ভুবনে মোহময়তা ও মায়াজাল বানানোর কৌশলী জাদুকর।
আব্বাসউদ্দীনের তারুণ্যভরা ভরাট গলা তখনকার বাঙালি শ্রোতার কাছে ছিল আনন্দঘন অধীর অপেক্ষার বিষয়। নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশে তাঁর সাফল্য আজও আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাসে উজ্জ্বল ইশারা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর—/সে আমারি গান প্রিয় সে আমারি সুর’, ‘অনেক ছিল বলার’, ‘গাঙে জোয়ার এলো’, ‘বন্ধু আজো মনে রে পড়ে’—নজরুলের এইসব গানের রেকর্ড প্রচারে চারিদিকে প্রবল সাড়া পড়ে যায়। অতঃপর এই সঙ্গীতসাধক নজরুলকে দিয়ে ইসলামি গান লিখিয়ে তাতে কণ্ঠ প্রদান করেন। আর এভাবে, সরলভাবনাকে সম্বল করে, বৃহৎ ও অনগ্রসর মুসলমান সমাজে সঙ্গীতের প্রবাহ প্রচলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সেদিন তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন—বাঙালি মুসলমানের মনে কী ধরনের জীবন-জিজ্ঞাসার বীজ ও বাতাস প্রবাহিত এবং তাতে কোন কায়দায় আনন্দ ও বার্তা প্রবেশ করানো যেতে পারে।
বিজ্ঞান এবং যুক্তির যুগে কেবল ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি দিয়ে যে সমাজকে, মানুষের চিন্তাকে আর সভ্যতার অগ্রগমনকে বিবেচনা করা বোকামি, সেকথা বুঝতে সমাজলগ্ন শিল্পী ও সংগঠক আব্বাসউদ্দীনের অতটা অসুবিধা হয়নি। আর তাঁর সেই অনুধাবনের জায়গাটি নিজের কাছে গোপন না রেখে, আটকে না ফেলে, আপামর জনতার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এবং সে অনুযায়ী তিনি সমকালীন সঙ্গীতের ধারা ও সুর সংযোজনে আন্তরিক ও সচেষ্ট ছিলেন সর্বদা। তৎকালীন মুসলমান সমাজের অধিকাংশ প্রতিনিধি ও সদস্য সঙ্গীতের প্রতি ছিল ভীষণ বীতশ্রদ্ধ। বিশেষত জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা এবং যুগের বাণীকে আত্মস্থ করতে না পারার বিষয়াদিই ছিল এর মূল কারণ। গান গাওয়া ও গান শোনা—উভয়ই ছিল তাদের কাছে অধর্মের কাজ। গান বাজনাকে তারা বিধর্মী বা ইহুদি-নাছাড়াদের কার্যকলাপ বলে ভাবত। এমন একটি ভীষণ প্রতিকূল প্রতিবেশে সাধারণভাবে মুসলিম সমাজের এবং বিশেষভাবে সকল ধর্ম-শ্রেণির সাধারণ মানুষের প্রাণের চাহিদা অনুযায়ী সঙ্গীত-সরবরাহ করার প্রতি তাঁর অভিনিবেশ সত্যিই আজ নিবিড় গবেষণার বিষয়।
আজ এতদিন পরেও অনুমান করা যায়, অনুসন্ধিৎসা ও সমাজ-রূপান্তরের অভিজ্ঞান ও আন্তরিকতাই ছিল তাঁর সমূহ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। মুসলমান নাগরিকের চিন্তায় সাঙ্গীতিক আবহ প্রবেশের কৌশল হিসেবে তিনি নজরুলের কয়েকটি গান প্রচারের অভিযানে নেমেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মনে করা যায়—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ/এলো রে দুনিয়ায়/ আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি দারুণ শ্রোতাপ্রিয় নজরুল সঙ্গীতের কথা। এইসব ইসলামি গান শুনে সঙ্গীতের প্রতি তখনকার অনগ্রসর মুসলমান সমাজের আগ্রহ জেগেছিল—যা ছিল সমকালীন সমাজে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই যে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সঙ্গীতের আনন্দভুবনের দিকে ডেকে আনা—এর প্রায় সিংহভাগের দায় সেদিন নিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন। আর কেবল একটি সম্প্রদায়ের কথাই বা বলি কেন—নানান জাতের ও বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি আমজনতাকে গানের বারান্দায়, আড্ডায় ও আসরে হাজির করতে পেরেছিলেন। কাজেই তিনি কেবল একজন কণ্ঠশিল্পী নন; প্রবল নিষ্ঠাবান সঙ্গীত সংগঠক এবং সমাজ-রূপান্তরেরও অনন্য কারিগর।
১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাজনের ফলে দুটি স্বতন্ত্র ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কণ্ঠকারিগর আব্বাসউদ্দীন ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। তখন পূর্ববঙ্গ (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) সরকারের প্রচার বিভাগে এডিশনাল সঙ অর্গানাইজার হিসেবে কাজে যোগ দেন। একজন সহজাত সঙ্গীত শিল্পীর জন্য তাঁর এই কাজের পরিবেশ ও বাস্তবতা ছিল অত্যন্ত অনুকূল। জাতিগত বিদ্বেষ ও চিন্তার ফলে যে ভারত বিভাগ, সাম্প্রদায়িক সংকটের যে ভয়াবহ চিত্র তখনকার সময়ে ছিল বর্তমান, তার যাবতীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সতর্কভাবে সময় পার করেছেন বলেই তিনি সত্যটাকে ধরতে পেরেছিলেন। নিজের অবস্থান ও অবস্থা পরিমাপ করতে ভুল করেননি একটুও। প্রাতিস্বিক চিন্তা ও কর্মে প্রবাহিত চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দ্বিখণ্ডিত (নাকি ত্রিখণ্ডিত) ভারতের কোন ভূখণ্ডে (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) বসতি স্থাপন করতে হবে, তা অনুধাবন করতে কোনো অসুবিধা হয়নি শিল্পী অব্বাসউদ্দীনের। তিনি ঠিকই টের পেয়েছিলেন অদূর ভবিষ্যতে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ব-পাকিস্তানের এই অঞ্চলটিই হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাণ। তাই তিনি বসবাসের স্থায়ী ঠিকানারূপে পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পেশা হিসেবে সঙ্গীত-সংগঠকের দায়িত্ব বেছে নিয়েছেলেন। তাঁর এই বিবেচনা একজন প্রাগ্রসর দার্শনিকের সিদ্ধান্ত বলেই প্রতীয়মান। এবং পরবর্তীকালে তা প্রমাণিতও বটে।
কালক্রমে শিল্পী ও সংগঠক আব্বাসউদ্দীন পলল্লীগীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। সম্ভবত তিনি ধারণা করেছিলেন, গানের স্বাদ ও বাণীর ডালি নিয়ে অধিকাংশ গ্রামবাসী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে গেলে তাদের ভাষা ও পরিচিত প্রসঙ্গ নিয়ে প্রবেশ করতে পারাটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সে চিন্তা ও অভিনিবেশের ধারা ধরে তিনি ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, জারি-সারি, মুর্শিদা, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার গায়ক ও অনন্য প্রচারক হয়ে ওঠেন। তখন কলকাতার মানুষ আধুনিক গান, কীর্তন আর রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-সজনীকান্তের গানের সুরে মোহিত। দেশপ্রেম ও মানবীয় প্রেমের এই অভিজাত গানের প্রবাহ ও সুর থেকে প্রাণ নাচানো পল্লীগীতির সুরের দিকে শ্রোতাদের মনোযোগ টেনে আনাটা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। সেই চ্যালেঞ্জে আব্বাসউদ্দীন সফল যোদ্ধা। পল্লীগীতিকে তিনি অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’ প্রভৃতি ভাওয়াইয়া গান; ‘আমার গহীন গাঙের নাইয়া’, ‘নদীর কূল নাই কিনারা নাই’ ইত্যাদি ভাটিয়ালি গান তাঁর গলায় রেকর্ডিং হয়ে প্রচার হবার পর নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা লাভ করে।
শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কী এক জাদুর কাঠির বলে সঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের মনের ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। আপামর বাংলার শিক্ষিত-আধাশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের কণ্ঠে ভর করেছিল তাঁর গাওয়া প্রচুর গান। ‘আল্লাহ্ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই/ আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা/আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই আল্লাহ/ মেঘ দে’ গানটি জনমানুষ, প্রকৃতি আর খোদাভাবনার এক অনবদ্য ইতিহাস যেন। আকুতি আর আনন্দভরা এমন কণ্ঠ তখনকার সময়ে বিরল। ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে/এই কলসি পাঠায়ে জলে কান্তে কান্তে’, ‘ও কি একবার আসিয়া সোনার চাঁদ মোর যাও দেখিয়া রে/ উড়িয়া উড়িয়া যানরে বন্ধু দাঁড়ান অহন পাড়’, ‘ওরে ও পরাণের মাঝি/আমার কথা লইও রে মাঝি আমার কথা লইও’, ‘আরে ও ভাটির গাঙের নাইয়া/আকু ভাইরে কইও আমায় নাইওর নিতে আইয়া’ প্রভৃতি গানে অব্বাসউদ্দীনের গলায় বাঁধা হয়ে পড়েছিল প্রেমপাগল ও আবেগনিমগ্ন মানুষের জীবনের সহজ কথামালা।
প্রেমের পাশাপাশি বিরহ আর যাতনার ভাষাও আব্বাসউদ্দীন তাঁর কণ্ঠে ঝুলিয়েছেন; বিরহীর বুকে বুলিয়েছেন কোমল হাতের পরশ। যেমন: ‘থাকতে পাড় ঘাটাতে তুমি পাড়ের নাইয়া/দিনবন্ধুরে আমার দিন কি এমনি যাবে বইয়া’, ‘সোনা বন্ধুরে কোন দোষেতে যাইবা ছাড়িয়া/আমি কাইন্দা কাইন্দা হইলাম সারা কেবল তোমারও লাগিয়া রে’, ‘প্রাণ বন্ধু রে ঐ শোন কদম্ব তলে বংশী বাঁশায় কে/বংশী বাজায় কে রে সখী বংশী বাজায় কে/আমার মাথার বেণী বদল দেব তারে আইনা দে’, ‘আমি ভাবি যারে পাইনা গো তারে/সে যেন কতই দূরে/আমি দেশ-বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াই/কেবল তার কথাটি মনে রে করে’। নদীতে জীবিকানির্বাহের কাজে নিয়োজিত মাঝিদেরকে ক্লান্তি ও অবসাদের বিপরীতে স্বস্তি প্রদান করেছে এইসব গান: ‘মাঝি বাইয়া যাওরে/অকূল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাও রে, মাঝি বাইয়া যাওরে’, ‘হেইওরে হেইও/সামাল সামাল সামাল ওরে সামলে তরী বাইও’, ‘নাও ছাড়িয়া দে/পাল উড়াইয়া দে/ছলছলাইয়া চলুক নাও মাঝ দইরা দিয়া’, ‘ময়ূরপঙ্খী নৌকা আমার মেঘনার তরে বাড়ি/ওরে বাও বাতাসের লগে মোর লাগাই আড়িআড়ি’, ‘ও সুখের ময়নারে ঘাটে তারে দেখলাম...পরাণ আমার কেমনে বাইন্ধা রাখি’. ‘বৈঠা জোরে বাওরে বন্ধু/বৈঠা জোরে বাও/উজান গাঙে ...টলমল’...
কেবল বিনোদন নয়, কর্ম-উদ্দীপনা সৃষ্টিতেও কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আবার, শুধু মানব মন, কাজের ক্লান্তি ও সুখ কিংবা ভালোবাসা-বিচ্ছেদের সীমায় সীমাবদ্ধ থাকেনি আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠের কারুকাজ। আস্তিকতার প্রতিও তিনি ছিলেন প্রবল আন্তরিক—সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের অসীম বিশ্বাসের সমর্থনে আব্বাসউদ্দীনের ভক্তিমূলক গানের গলা আজও আমাদেরকে শান্তির উদার বারান্দায় নিয়ে দাঁড় করায়: ‘ও মন গুরু ভজ রে/ওরে সোনা চাঁদ/দিন দরিয়া../গুরু বিনা এই দরিয়ায় বন্ধু নাইরে আর’, ‘গুরুর পদে প্রেম ভক্তি/গুরু’—নানান ভঙ্গি ও ঢঙে সমাজকে, মানুষকে একটি স্থির জায়গা থেকে উদ্বোধনের পথে আহ্বানের ভাষা নির্মাণ করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। কাজেই তাঁকে কেবল কণ্ঠশিল্পী বললে ভুল হবে, তাঁকে ভাবতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে সমাজ-রূপান্তরের শিল্পী হিসেবে।
শিল্পী আব্বাসউদ্দীন গানকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন লাইভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে। বিভিন্ন মঞ্চে তিনি গান পরিবেশন করেছেন সরাসরি। অনেক সভায়, সমিতির আয়োজনে অনুষ্ঠিত প্রোগ্রামে সামাজিক সমস্যামূলক, জাতিগঠনমূলক ও দেশাত্মবোধক গান গেয়েছেন মানুষকে সচেতন করে তুলবার জন্য; দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবার তাগিদ থেকে। আজকে যোগাযোগ ও প্রযুক্তির এই উন্নয়নের কালে আমরা জনমুখী সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের যে বিকাশ দেখি, তা তৎকালে কেবল ব্যক্তিগত ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে গ্রামে গ্রামে, শহরে ও গঞ্জে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন গণমানুষের শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। তাঁর বিশুদ্ধ উচ্চারণভঙ্গি, অনুপম সুরেলা কণ্ঠ, তাল-লয় ও মাত্রাজ্ঞান সমন্বিত সঙ্গীত সমকালে এবং উত্তরকালে হাজার হাজার শ্রোতার মন মাতিয়েছে।
এই অসীম শক্তিময়, প্রাণময় ও সাহসী মানুষটি নিজের সঙ্গীত জীবনের কথা লিখে গেছেন। সরস আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি তাঁর মৃত্যুর একবছর পর (১৯৬০) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে একজন শিল্পীর হয়ে ওঠার গল্প যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গণমানুষের কাছে সঙ্গীতের সুর ও সুধা পৌঁছে দেবার পিছনে নিরলস-প্রচেষ্টার জীবন্ত সব কাহিনী। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এটি শিল্পীর উত্তরাধিকার হিসেবে রয়ে যাবে আরো বহুকাল।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৫