আশ্চর্য নদী
আমার বালিশের নিচে চাপা পড়ে আছে একটা নদী
বিভোর ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলে সে নদীর আর্তনাদ
শোনা যায়, শোনা যায় পরম্পরার আকুতি। তবে কখনো বালিশে
হাত ঢুকিয়ে নদীকে বের করে নিয়ে আসতে চাইলে
সে আর দৃশ্যে থাকে না—হয় অদৃশ্যে লোপাট।
আমি বারবার বলি, দৃশ্যতে আসো; হোক মেলবন্ধনের
নিপাট যোজন। অ্যাভিন্যুতে বৃষ্টি শেষে গাছের পাতাগুলো
যেমন চকচক করে, তেমনি তোমার উজ্জ্বল মুখ রচিত হোক,
বাদাম ভাঙার মতো আমাদের যোজন মুহূর্তগুলো ভেঙে ভেঙে
বের করে আনি সারাৎসার। অথচ নদী কোন দিক থেকে
কোন দিকে চলে গেল, শশাঙ্ক আর তাকে শাসন করতে পারল
না, বিপাশা নামে যে নদী, সেও মুখ থুবড়ে পড়ল এর সামনে।
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে মাঠ ফেটে কৃষকের কপালে ছোট ছোট
অগণিত দেয়াল। অথচ তখনও বহমান ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ
তুলে বালিশের নিচে খেলছে আমার আশ্চর্য নদী। অন্যদিকে
দেখো, তোমার বালিশের নিচে আত্মার দীর্ঘ আকুতি। তার চেয়ে
বরং চলো আকুতি নদীতে ছেড়ে দিই, গোসল করুক, ভিজুক।
বর্ষা তো ঘড়ির কাঁটার মতো কৃতদাস হয়ে আসছে না।
কথা বিষয়ক
আমার কথা আমার প্যান্টের বাম পকেটে আছে
বুক পকেট গড়ের মাঠ, প্যান্টের ডান পকেট নিঃস্ব গলি,
পেছনের পকেটে তাবৎ আহাজারি উগড়ে উঠছে।
আমি জানি প্রত্যেকটা সকাল নিরাময় কেন্দ্র, সকালকেন্দ্রে
এসে আমরা তাপ দিতে দিতে বেদনাকে গলিয়ে দিই,
বেদনা থেকে নিঃসঙ্গতা গলে পড়ে সব স্থিতিশীল হয়।
তারপর সম্ভাবনার দিকে যায়, যায় প্রত্যাশার দিকে।
আবার লোডশেডিং হলে কেউ কেউ প্রত্যাশা জ্বালিয়ে
পরীক্ষার পড়া পড়ে, কেউ অন্ধকারকে তাড়ায়।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় পোকা খাওয়া আমকে পেড়ে আনি।
এনে পোকাধরা জায়গাটা কেটে ফেলি। অথচ ১৯৭১ আনতে
চাইলে চলে আসে ১৭৫৭। ভাবি, সকাল পেড়ে আনব।
কিন্তু কিভাবে জানি গভীর অন্ধকার চলে আসে। দূর পাহাড়ে
লুকিয়ে থাকা গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরে। মনে হয় গলিতে গলিতে
উড়ছে একাকীত্ব, পৎ পৎ করে উড়ছে দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু
বাম পকেটে আমার কথা। অন্যান্য স্থান গড়ের মাঠ,
নিঃস্ব গলি, তাবৎ আহাজারি—সেখানে বাম পকেটে লাবণ্যময়
কথা খুব নিঃস্ব, খুব একাকীত্ব, বহু প্রহসনে চুপ মেরে আছে।
তবু ওর অভিজ্ঞতা রাজপথের মতো বিশাল ও সম্ভাবনায় উজ্জ্বল।
দেখা হওয়া
অনেক করতালির ভেতর ফিতা কেটে একটা দেখা হওয়া উদ্বোধন হলো। উদ্বোধন করলেন রোদ্র ও ছায়া যুগল। অগণিত দেখা হওয়ার সম্ভারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বহু ক্রেতা। সূর্যের সঙ্গে সকালের, অন্ধকারের সঙ্গে সন্ধ্যার সহজলভ্য দেখা হওয়া চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও চাহিদা বিপুল। একটা ট্রাকের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি হৃদয়বিদারক দেখা হওয়ার দিকে মুখ কুচকে দেখছে অনেকে। আর কিছু রোমান্টিকের দল, অনেক সাধারণের দল মমতাজ-শাজাহান, লাইলি-মজনু প্রমুখদের দেখা হওয়ার কিংবদন্তী নিয়ে তুমুল আপ্লুত।
নীল নদের সঙ্গে ভূ-মধ্যসাগরের পানির দেখা হয়; তা আমরা জানি। পানিপথে সম্রাট বাবরের সঙ্গে এদেশের হিন্দু রাজাদের রোমহর্ষক দেখা হয়েছিল—এরকম রোমহর্ষক দেখা হওয়া পৃথিবীতে অনেক ঘটে। প্রতিনিয়ত ঘাসের সঙ্গে পায়ের, রাজপথের সঙ্গে গতির, ঢেউয়ের সঙ্গে নৌকার, বাঘের চোখের সঙ্গে হরিণের চোখের দেখা হয়। ফড়িংয়ের সঙ্গে শিশিরে সিক্ত ধানগাছের দেখা হওয়ার স্মৃতি কারো কারো কৈশোরকে এনে দেয়। এই যে তার চোখের সঙ্গে আমার চোখ গিয়ে দেখা করতে চায়, তাও তো সবুজ, ভেজা প্রফুল্ল অভিজ্ঞতা জাগিয়ে দিতেই, নাকি?
অনেক দেখা হওয়ার ভেতর আমাদের দেখা হওয়া কোথায় হলো, বলো? মাসুপিসুর মতো এ এক বিস্ময়। অথবা একটা চাহনির মতো গভীর রহস্য উদ্রেককারী এ দেখা হওয়া। তবু সিংহাসনের সঙ্গে রাজার, জেলের সঙ্গে মাছের, রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীনতার দেখা হোক তাই আমরা চাই। নদী, সবুজ বনানী, সমুদ্রের মাতাল হাওয়া, পৌষের রোদ—এসবের মতো সবাই চায় আমাদের দেখা হোক, নিশ্চয় চায়। করতালি দিয়ে দেখা হওয়ার সঙ্গে শান্তি মিলিয়ে দিতে চায়।
অন্ধ রাজকন্যা ও দৃশ্যসকল
আমি অনেক দৃশ্যের স্তূপ সাজিয়ে তোমাকে বললাম চোখ মেলো। তুমি পাখির ঠোঁটের মতো তোমার চোখের পাতা মেলে ধরলে। যেন ক্ষুধার্ত দুটা ঠোঁট দৃশ্য পান করতে চায়।
অনেক মানুষের মুখ স্তূপ হয়ে আছে, অনেক সামুদ্রিক হাওয়া ডানা ঝাপটিয়ে ক্ষণ গুনছে তোমার চোখ মেলার অপেক্ষায়। তুমি চোখ খোলামাত্র প্রতিটা মানুষের মুখ, প্রতিটা সামুদ্রিক হাওয়ার ডানা, অরণ্যের দুর্লভ দুপুর, ভোঁদরের নিঃশব্দ হাঁটা সব ভাবছে তুমি তাকেই দেখছো। অথচ তুমি একটা অস্পষ্ট রেখা পার হয়ে কোনো মতেই এইসব দৃশ্যে প্রবেশ করতে পারছো না।
কেন? চোখ মেলেই একটা রক্তাভ সামিয়ানার দীর্ঘ আলোড়ন তোমাকে এইসব দৃশ্য থেকে বিভক্ত করে রাখছে। অনেক লালের মিছিল অস্পষ্ট হয়ে তোমার দৃষ্টিতে ঝুলে আছে। অনেক ভয়ের সাঁকোতে তোমার চোখ আটকে আছে—অস্পষ্ট, আতঙ্কময়। তাহলে তোমার ইদানীং এরকম হয়! অনেকেরই কি হয়?
অনেক দৃশ্য স্তূপ হয়ে আছে—সামুদ্রিক হাওয়ার ডানার স্তূপ, মানুষের মুখের স্তূপ। প্রত্যেকটা মুখ ভাবছে তুমি তাকেই দেখছো; দেখে সে ঝুল বারান্দা বানাচ্ছে, ঘর বানিয়ে পাখির মতো শূন্যে উড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ তোমার চোখের অস্পষ্টতার কথা জেনে ওরা নিশ্চিত হতাশা এবং স্বপ্নভঙ্গের ব্যথায় কুঁকড়ে যাবে; দৃশ্যের স্তূপ একে একে অনেক ব্যথা নিয়ে একে একে চলে যাবে। তুমি তাও দেখতে পাবে না, অনুভব করতে পারবে না। দৃশ্যরা ফিরে গিয়ে গল্প করবে—এক দেশে এক রাজকন্যা ছিল, কিন্তু তার চোখে কোনো দৃশ্য ছিল না।
সকলসকাল গায়কসকাল
ঘুম থেকে জেগেই মনে হলো এ সকালটা গায়কসকাল। গতকাল
যে সকালের মুখোমুখি হয়েছিলাম তাও ছিল গায়কসকাল। আগামীকাল
যে সকালের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটবে তার নামও গায়কসকাল। অথবা
জেগে উঠে দেখলাম এ সকাল অগায়ক—তাড়নাশূন্য, চাঞ্চল্যহীন;
তাতে কী হবে? তাতে কি একটি অভাবনীয় আনন্দের মুকুল
ফুটে উঠবে আমার কপালে। আমি হাততালিতে সকালকে নাচিয়ে
দিলেও সে চাঞ্চল্য হাওয়াইমিঠাইয়ের মতো ফুৎকারে উড়ে যাবে?
মাঝে মাঝে কোনো একটা সকালের সঙ্গে দেখা হয়—যা অগায়ক।
মাঝে মাঝে একটা সকালের সঙ্গে দেখা হয় যা ঘটনারহিত
যা আমাকে ঘিরে বিহ্বল হয়ে থাকে। যার কোনো রা নেই, কোনো
চোখ রাঙানি নেই। কিন্তু মাথাভর্তি গায়কসকাল, মাথাভর্তি
গায়কসকালের নানা গলিঘুপচি। ফলে অনেক দূরে সমুদ্রের
ঢেউয়ে ঢেউয়ে চলে আসা সকাল, শুকনো পাতা মাড়িয়ে
গহীন বন থেকে আসা সকাল, যা অগায়ক, তার ভেতরও একটা
গায়কসকালের দৌরাত্ম্য টের পাওয়া যায়।
তার মানে আমার মাথাভর্তি গায়কসকাল।
তার মানে আমার মাথাভর্তি—জীবন ঘিরে একটি
সত্যের আলাপন জুড়ে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৫