আমার প্রকৃতি ভালো লাগে। তার স্পর্শ পেতে ইচ্ছে হয়।
আজ থেকে কয়েক বছর আগে এমনই এক স্বপ্নের বুলি ফুটেছিল পরীর মুখে। স্বপ্নীল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল তার। পরীর কথা বলার ভঙ্গিমার সঙ্গে যেন হাজার ময়ূর পেখম তুলে নাচছিল সেদিন।
এককাপ চায়ে ১/২ চা চামচ কফি। সমুর রেসিপি এটা। সমু নেই। তবে তার গন্ধ ছড়িয়ে আছে পুরো বাড়িটাতে। কাঠের মেঝের সেই ছোট্ট বাড়ি। বারান্দায় ছোট্ট ডাইনিং টেবিল। সমুর সব অদ্ভুত অভ্যেস ছিল। ও চায়ের সঙ্গে কফি মিশিয়ে খেতে পছন্দ করত। বলত, “আমরা একটা টি-শপ দিব পরী। সেখানে চা আর কফির কম্বিনেশনে একটা পানীয় বানাব। নাম হবে চাফি
পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় চোখে নিয়ে তাকে দেখছিল সমু। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা জানান দিচ্ছিল, সামনে দাঁড়ানো উচ্ছল এই ডানাকাটা পরীটা যেন তার অদৃশ্য ডানার নিচে এক নতুন পৃথিবী সাজিয়ে তুলছে সমুর জন্য।
ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সমু।
অবাক হয়ে পরী বলল, “কী হলো?”
“আগে তো ছুটে চলে আসতে। ”
পরী ছুটে গিয়ে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিল।
“আমি তো এখনো ছুটে চলে আসি তোমার কাছে। ”
“একটা কথা বলব?”
“হুম। ”
“আকাশে ঘোড়া ওড়ে দেখেছো?”
“পঙ্খীরাজ ঘোড়া?”
“হ্যাঁ। তোমার স্বপ্নের যে কত শক্তি তা আমি জানি পরী। তোমার জন্য এমন এক রাজকুমার দরকার যে কিনা তোমাকে ওই পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে তোমার স্বপ্নের রাজ্যে। ”
“ওসব রাজকুমারের দরকার নেই। তুমি হলেই চলবে!”
তারপর চারটা বছর পার হয়ে গেছে। পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সেই রাজকুমার এসেছিল পরীকে নিতে। তবে রাজকুমার পরীকে স্বপ্নের রাজ্যে পৌঁছে দিয়েই হারিয়ে গেছে। ধবধবে সাদা পঙ্খীরাজ রাজকুমারকে নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে।
বিয়ের দিনটাতে পরী এত খুশি ছিল। এত রঙ থাকতে সমু যে কেন সবুজ রঙের বিয়ের শাড়ি পছন্দ করল পরীর জন্য, কে জানে! বিয়ের সময় সারাক্ষণ পরী হাসছিল। মজা করে পরীকে সমুর বন্ধুরা বলছিল—তুমি যে কী করে সমুকে বাগে আনলে.. ও তো কারো কথাই শোনে না...
পরীও সমুর সঙ্গে পরিচয়ের শুরু থেকে বুঝেছিল, সমু কারো কথাই শোনে না। কিন্তু একবারও মনে হয়নি যে সে পরীর কোনো কথা অগ্রাহ্য করেছে। সমুর কাছে পরীই ছিল সব। বাবা-মা আর পরিবারকে হারানোর পর পরীই ছিল সমুর একমাত্র অভিভাবক। পরীর প্রতি সমুর এই নির্ভরশীলতা আর অযথা আবদার পরীর খুব ভালো লাগত।
পুরোপুরি সকাল হয়নি এখনো। বারান্দায় বসে পুরনো কথা ভাবছিল পরী। পাশেই রাখা চায়ের কাপ। এককাপ চায়ে ১/২ চা চামচ কফি। সমুর রেসিপি এটা। সমু নেই। তবে তার গন্ধ ছড়িয়ে আছে পুরো বাড়িটাতে। কাঠের মেঝের সেই ছোট্ট বাড়ি। বারান্দায় ছোট্ট ডাইনিং টেবিল। সমুর সব অদ্ভুত অভ্যেস ছিল। ও চায়ের সঙ্গে কফি মিশিয়ে খেতে পছন্দ করত। বলত, “আমরা একটা টি-শপ দিব পরী। সেখানে চা আর কফির কম্বিনেশনে একটা পানীয় বানাব। নাম হবে চাফি। ভালো হবে না পরীরানী?”
দিনগুলো সত্যিই স্বপ্নের মতো ছিল। পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা, সুখ আর শান্তি যেন জড়িয়ে ছিল পরীকে। ঘরময় তাজা ফুলের গন্ধ, বিকেলে মেঝেতে বিছানো কার্পেটে গড়াগড়ি আর দেয়ালে বাঁধাই করা স্প্যানিশ কবিতা সুচারুভাবে আবৃত্তির ব্যর্থ চেষ্টা...
উফ, সমু তুমি কোথায়? আমি হাঁপিয়ে গেছি। আর পারছি না তোমাকে ছাড়া। আমি আজও ইকেবানা বানাই, কিন্তু কেউ আর সেটাকে অযথা কষ্ট বলে খেপায় না। সমু, আজও আমি প্রদীপ জ্বালাই, কিন্তু কাউকে বলতে পারি না যে ‘তুমি আগুন আর আমি প্রদীপ। তোমার কাজই আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করা’।
এখন আমার ঘরময় উড়ে বেড়ায় এক ছোট্ট প্রজাপতি। তোমার দেয়া নাম রেখেছি তার। সমু জুনিয়র। তুমি ভুল বলেছিলে। বলেছিলে, “আমাদের রাজকুমার হয়ত আমার কথা জানবেই না। ”
কিন্তু ছোট্ট সমুর মধ্যে কেবলই তুমি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৫