একাধিক কারণে মনোহরপুর পোস্ট অফিসের স্থান পরিবর্তন করতে হতো। কয়েকমাস পরপর অফিসটার স্থান পরিবর্তন করা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
যদিও স্কুল ও মাদ্রাসার ডকুমেন্ট আর হলুদ রঙের ছোট খামে প্রচুর চিঠি আসত। আর, মাঝে মাঝে দুয়েকটা বিদেশি চিঠি। রেজিস্ট্রি করা চিঠির ওপর থাকত অনেকগুলো ডাকটিকিট। সাধারণ চিঠিতে থাকত একটি। এ পোস্ট অফিসের আওতাধীন মানুষজনের প্রায় নব্বই ভাগই কৃষক। তাই এখানে পোস্টমাস্টার আর দু’জন পিয়ন কাজ করে। দুপুর একটার দিকে যখন উপজেলা থেকে সাইকেলে করে সালাম সাহেব চিঠির বস্তা নিয়ে আসতেন, যুবক আর মাঝবয়সী মানুষের ভিড় পড়ে যেত। কেউ কেউ খুব খুশিমুখে হাসতে হাসতে বাড়ি যেত, কেউ যেত গোমরা মুখে।
বাবা দেশের বাইরে থাকতেন, তাই টিফিনের ফাঁকের সময়টা পোস্ট অফিসের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ছোট মানুষ, বড় মানুষগুলোর ভিড়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলতাম। অনেক ঠাঁসাঠাঁসির মাঝেও মানুষের ফাঁক দিয়ে খামের ওপর বাবার নামটা দেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একটা ঠিকানা পড়ার আগেই আরেকটা চিঠি উপরে চলে আসত। শেষ পর্যন্ত সালাম জেঠার কাছে জানতে চাইতাম, আব্বার চিঠি আছে?
আমি পরদিন সকালের অপেক্ষায় থাকতাম। বাবা দেশের বাইরে থাকতেন, তাই টিফিনের ফাঁকের সময়টা পোস্ট অফিসের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ছোট মানুষ, বড় মানুষগুলোর ভিড়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলতাম। অনেক ঠাঁসাঠাঁসির মাঝেও মানুষের ফাঁক দিয়ে খামের ওপর বাবার নামটা দেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একটা ঠিকানা পড়ার আগেই আরেকটা চিঠি উপরে চলে আসত। শেষ পর্যন্ত সালাম জেঠার কাছে জানতে চাইতাম, আব্বার চিঠি আছে?
তিনি শুনেও না শোনার ভান ধরতেন। আরেকবার প্রশ্ন করব কিনা এ নিয়ে কিছুক্ষণ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চলত। তারপরও সাহস সঞ্চয় করে ফের জানতে চাইতাম, আব্বার চিঠি আছে? সালাম সাহেব খুব গম্ভীরভাব নিয়ে বলতেন, থাকলে কাল সকালে নিয়ে আসব।
চিঠি আছে, নাকি নাই, উত্তর কোনটা দিলেন—বুঝতে পারতাম না। তৃতীয়বার প্রশ্ন করার প্রশ্নই আসে না। যদিও তিনি পোস্ট অফিসের ‘সামান্য পিয়ন’—কিন্তু গ্রামের সবাই উনাকে খুব সম্মান করতেন। পিয়ন হিসেবে নয়, সবাই তাকে পোস্ট অফিসের অনেক বড় হর্তাকর্তা বলেই জানেন। যদিও উনাকে সম্মান করার পেছনের প্রধান কারণ হচ্ছে—উনার হাত দিয়েই স্বজনদের খবর আসে। অর্থ আসে, আসে সুখ-দুঃখের খবর। তাই সবাই সালাম পিয়নকে সালাম সাহেব বলেই ডাকে।
ছুটির ঘণ্টা বাজতেই বাড়ি রওনা হই। স্কুল থেকে বের হওয়ার পথে সালাম সাহেবের সাথে আবার দেখা হয়ে যায়, স্লামুআলাইকুম জেঠা ভালো আছেন? সালাম সাহেব ‘হুঁ’ শব্দে আমাকে অতিক্রম করে যেতেন। এমন ভাব করে, যেন আমাকে চেনেন না। অথচ বাস্তবতা হলো গত অন্তত আট বছর ধরে তিনি আমাকে চেনেন। আমাদের ঘর চেনেন, বাড়ি চেনেন। তিনি আমাদের ঘরে এসে আপ্যায়িত হননি—এমন একটা দিনও নেই। সপ্তাহ খানেক আগেও একটা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। ওই চিঠির ওপর একটা ডাকটিকিট ছিল। তাই পরেরবার অবশ্যই অনেকগুলো ডাকটিকিটওয়ালা চিঠির অপেক্ষায় আমরা মা বোনসহ পাঁচজন। কারণ পরের চিঠিতে টাকার ড্রাফ থাকবে বলে আব্বা জানিয়েছেন। আব্বার পাঠানো টাকা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। প্রতিমাসে সময়মতো টাকা না পেলে মা সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। এমন হতো যে, আমাদের কলম কেনার টাকাও থাকত না। অথচ মায়ের কাছে টাকা থাকলে আমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিদিন পকেট খরচ দুই টাকা পেতাম।
মা রান্না ঘরে কাজ করছেন। স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ না ধুয়েই মাকে বললাম, মা..ও মা, সালাম সাহেবের কাছে আব্বার চিঠির কথা জানতে চেয়েছি। উনি বললেন, থাকলে নিয়ে আসবেন। বলো তো চিঠি আছে, নাকি নাই? মা বললেন, থাকলে অবশ্যই নিয়ে আসবেন। এখন তুই হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নে।
মাও এমন ভাব দেখালেন যেন চিঠি আসুক আর না আসুক এতে তার কোনো কিছু যায় আসে না। অথচ বাবার চিঠি আসলে তিনিই বেশি খুশি হন। চোখের মধ্যে আনন্দ টলমল করে। যাইহোক, মায়ের উত্তরটাও আমার বোধগম্য হয় না। পরদিন সালাম সাহেব সকাল আটটার দিকে বাড়ি এসে হাজির। নাস্তা করলেন, সবশেষ পানি খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে বললেন, রেজিস্ট্রি করা চিঠি এসেছে, আজ বখশিস বাড়িয়ে দিতে হবে। একটা চিঠির জন্য প্রায় চার কিলোমিটার দূরে এসেছি। নয়ত পোষাবে না।
মা সাধারণ চিঠি আসলে পাঁচ টাকা দেন, আর রেজিস্ট্রি চিঠির ক্ষেত্রে দশ টাকা। আজ কত দেবেন—এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত পাশের ঘরের চাচীর কাছ থেকে দশ টাকা ধার নিয়ে মোট বিশ টাকা হাতে গুঁজে দিলেন। যাবার সময় আমার মাথায় হাত দিয়ে সালাম সাহেব বললেন, চিঠি থাকলে আমি নিয়ে আসব। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়ালেখা করো।
১৯৯৫ সালের পর থেকে বিদেশে বাংলাদেশীদের জন্য বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। ওই সুযোগে আমাদের বাড়ির প্রায় বারো-তেরজন বিভিন্ন দেশে চলে যায়। আমাদের গ্রামসহ আশপাশের আরো কয়েক গ্রামের অনেক মানুষও বিদেশ পাড়ি জমায়। সালাম সাহেবের ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেল। এখন প্রতিদিনই তাকে এই এলাকায় আসতে হয়। সরকারি বেতন অনেক কম, কিন্তু বখশিসের টাকায় আয় রোজগার ভালোই হয়। অবশ্য চিঠির এমন জোয়ার ছিল অল্পকয়েক বছরই। ২০০০ সালের প্রথম থেকেই শুরু হলো মোবাইল ফোনে যোগাযোগ। কয়েক গ্রামের মধ্যে একটা, তারপর একগ্রামে একটা, শেষ পর্যন্ত হাতে হাতে একটা করে মুঠোফোন চলে এলে দেশের প্রায় সর্বস্তরে শুরু হলো ইন্টারনেটের ব্যবহার। মুহূর্তেই টাকা চলে আসে মুঠোফোনে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের মানুষের কাছে সালাম সাহেবের কদর কমতে শুরু করল। প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে সবকিছুই মূল্যহীন মনে হয়, এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এখন মাঝে মাঝে দুয়েকটা সরকারি চিঠি নিয়ে গ্রামে ঢুকতে হয় তাকে। বিশেষ করে চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড। তাও কার্ড নিয়ে এখন আবার বাড়ি আসতে হয় না। যার প্রয়োজন সে নিজেই পোস্ট অফিসে হাজির হয়ে কার্ড নিয়ে আসে। পোস্টমাস্টারসহ তিনজন প্রায় অলস সময় কাটায়। কখনো কখনো খোশগল্প করে সময় কাটে তাদের। সামান্য বেতন দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে সালাম সাহেবের। আগে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ সালাম দিত। শ্রদ্ধা আর সম্মানে কুশল বিনিয়ময় করত। খুব প্রয়োজন ছাড়া এখন কেউ আর কথাই বলতে চায় না। আর, উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের কথা বলে তো লাভ নেই। ওরা শুধু মোবাইলের বাটন টিপতে টিপতে হাঁটে।
গত ছয় মাস ধরে ইন্টারভিউ কার্ড আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল মাদ্রাসার চিঠি আসা বন্ধ। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রায় সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। কোনো ডকুমেন্ট নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠান থেকেই কেউ না কেউ হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে। পোস্ট অফিসের কোনো কার্যক্রম নেই। এখন আর দুপুরবেলা মানুষের ভিড় হয় না। চিঠির বাক্সটায় মরিচা পড়ে গেছে। সপ্তায় একবারও তালা খোলা হয় না। পোস্টমাস্টারের সাথে সালাম সাহেবসহ দু’জন পিয়ন অফিসে শুধু আসা-যাওয়া করেন। অর্থাৎ সকালে আসেন বিকেলে চলে যান। এছাড়া আর কোনো কাজ নেই। একদিন হঠাৎ উপজেলা প্রধান অফিস থেকে একজন পিয়ন একটা মাত্র চিঠি নিয়ে আসেন। সরকারি খামের ওপর লেখা প্রাপক আবদুস সালাম। সালাম সাহেব চিঠিটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫