পর্ব ২১ পড়তে ক্লিক করুন
সখি ভালোবাসা কারে কয় |
বেশির ভাগ বিলাতি নারীই ছিলেন স্বপ্নচারী, সেই সাথে বাস্তবমুখী। তারা জানতেন কল্পনায় দেখা রাজপুত্রকে কাছে পাওয়া যাবে না, তবে অর্থবান একজন স্বামী পাওয়া হয়তো সম্ভব।
বিশ্বাস করি দামি পোশাকে
আর বিলাসি সামগ্রীতে
বিশ্বাস করি জ্বলজ্বলে রুপি
পূজা দেই টাকা কড়িতে।
বিয়েতে আমি আস্থা রাখি
তবে পুরুষে করি না বিশ্বাস
পুরুষ মানেই হাত পা বেঁধে
যত পারো শুষে নাও নির্যাস।
বিশ্বাস করি আমি ঠাঁটবাটে আর
খুঁজি আমি সিভিল সার্ভিস
আজীবন যেন সুখে থাকি আমি
ভারতেই যেন মরি, আহা ইশ!
কিন্তু বিয়ে মানেই ভাগ্য। কার ভাগ্যে কী লেখা আছে তা কি আগে থেকে কেউ বলে দিতে পারে? নাকি তা সম্ভব? বিলাতি নারী মিস কিং ভারতে এসে অনেক দিন পর্যন্ত যুঁতসই কোনো স্বামী খুঁজে পাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি হালও ছেড়ে দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন হলো। একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করে ভারতে সুখের সংসার পাতলেন। কিন্তু হায়! সুখ বেশি দিন সইলো না তার কপালে। ১৮৭৮ সালে ইংরেজ সরকার তাকে দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে পাঠিয়ে দিল এবং মিস কিংয়ের স্বামী আর ভারতে ফিরল না।
জুলিয়ার ইদানীং মনটা কেন যেন ভালো থাকে না। কোনো কাজে মন নেই। গলায় আর গানের সুর ওঠে না। এমনকি বালিশের কুশনে সুন্দর ফুল তুলে সেলাইয়ের কাজও তার আর ভালো লাগে না। রবার্টকে তার খুব রহস্যে ঢাকা একজন পুরুষ মনে হয়। তাকে ঠিক চিনতে পারছে না। রবার্টও আর আগের মতো জুলিয়ার কাছে আসে না। ঘটনার জট খুলে গেল শীঘ্রই। জুলিয়া একদিন ঠিক করল ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রবার্টের নতুন বানানো বাংলোটা দেখে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আর সেই কাজ করতে গিয়েই অঘটনটা ঘটল:
আবার উল্টো ঘটনাও আছে। বিলাতি মেম মিস হেলেন মেকেনজি ভারতে এলেন ১৮৬৫ সালে সিপাহী বিপ্লবের কয়েক বছর পর। ভারতে এসেই তিন তিনটি প্রেমে জড়িয়ে পড়লেন তিনি। শেষ পর্যন্ত একজন উপযুক্ত আইসিএস কর্মকর্তার সঙ্গে সুখে জীবন কাটাতে শুরু করলেন। ১৮৮০ সালে মিরাটে অবস্থানরত বিলাতি নারী সোফিয়ার কথাই ধরুন না। বিয়ের সব ঠিকঠাক। দিনক্ষণ ঠিক হলো। বিয়ের দিন বেঁকে বসলেন বর। কারণ সোফিয়াকে নিয়ে তিনি নাকি বিলাতি সমাজে কিছু ‘অন্যরকম’ কানাঘুষা শুনেছেন।
সব বিলাতি নারীই যে বুদ্ধির হিসেব নিকেশে খুব পাকা ছিলেন তা কিন্তু নয়। সহজ সরল মনের অনেক বিলাতি মেমরাও ছিলেন। পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা তাদের কোমল প্রাণকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু এই সহজ সরল মনের জন্য ভারতের বিলাতি সমাজে তাদের খেসারতও কম দিতে হয়নি। বিলাতি মেম জুলিয়া কার্টিসের কথা ধরা যাক। ১৮৯০ সালে তার বয়স মাত্র একুশ বছর। সারাক্ষণ এক চিলতে হাসি তার মুখে যেন ঝুলেই থাকে। অন্যান্য বিলাতি নারীর মতোই তিনি ভারতে এসেছিলেন একমুঠো সুখের আশায়। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাকর্মকর্তা—তার বড় ভাই মার্টিনের বাড়িতে তিনি থাকতে শুরু করলেন। জুলিয়ার গুণগান তখন গোটা বিলাতি মহলেই। সারাক্ষণ হাসিখুশি মেয়েটি। আহা! কী ভালো গান গাইতে পারে। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং তার কণ্ঠ বানিয়েছেন! আর কী চমৎকার করেই না সে কাপড়ে নকশা ফুটিয়ে তোলে! এমন যোগ্য মেয়ের ভারতের মাটিতে যোগ্য পাত্রের অভাব হবে? মোটেই না।
বড় ভাই মার্টিন আপন ভোলা টাইপের মানুষ। বোনের সাথে মাঝে মাঝে তার দেখা হয়, অফিসের কাজের পর বেশিরভাগ সময় সে পার করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার্স ক্লাবে জুয়া খেলে আর মদ খেয়ে। জুলিয়া বাড়িতে একা একাই গুনগুন করে গান গায় আর কাপড়ে নকাশা তোলে। এতেই সে অনেক সুখি। ১৮৯০ সালের জুলাইয়ের গরম মাদ্রাজের বাতাস ভারী করে তোলে। সন্ধ্যার সময় ভারতীয় চাকর বাড়ির চারপাশে লণ্ঠনের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। জুলিয়া বসলেন তার গানের খাতা নিয়ে। ঠিক এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। ভারতীয় আয়া জানালেন, এক বিলাতি পুরুষ মেম সাহেবকে খুঁজছেন। জুলিয়া গানের খাতা রেখে তাকে বাড়ির ভেতর ঢোকার অনুমতি দিলেন। দেখতে শুনতে রীতিমতো বিলাতি সুপুরুষ। কাঁচা গোঁফ, সোনালি চুল আর পিটপিটে একজোড়া নীল চোখ। নিচের দিকে ঝুঁকে কায়দা করে মাথার টুপিটা খুলতে খুলতে তিনি বললেন, “আমার নাম রবার্ট। আমি আপনার ভাই মার্টিনের সহকর্মী এবং বন্ধু। এ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। আপনার অনেক গুণগান শুনেছি বন্ধুদের কাছে। ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। অবশ্য আপনার যদি কোনো অসুবিধা না হয়। ”
“না, না ঠিক আছে। আমার আর কী অসুবিধা! আমার নাম জুলিয়া। জুলিয়া কার্টিস। বুঝতেই পারছেন, ভারতে নতুন এসেছি। সবার সাথে এখনো খুব একটা চেনা জানা হয়নি। আপনি খুব ভালো করেছেন নিজথেকে এভাবে চলে এসে। ”
গল্প জমে যায় রবার্ট আর জুলিয়ার। ধীরে ধীরে দু’জনই বেশ বন্ধু হয়ে ওঠেন। বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই রবার্ট চলে আসেন জুলিয়ার বাড়িতে। আড্ডা দিয়ে বেশ রাত করে রবার্ট তার বাড়িতে ফিরে যান। জুলিয়ার চোখে তখন শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। সময় গড়িয়ে যায়। ততদিনে রবার্ট নিজেই বিশাল একটা বাংলোর মালিক। বিয়ের ব্যাপারে জুলিয়া আগ্রহী হলেও রবার্ট কেন যেন বা কোনো নির্দিষ্ট কারণে—খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না। কিন্তু রবার্টের ব্যাপারে জুলিয়ার মনে কোনো সংশয় নেই। জুলিয়া মানুষকে বিশ্বাস করে আর তার ধারণা পৃথিবীর সব মানুষই খুব ভালো।
জুলিয়ার ইদানীং মনটা কেন যেন ভালো থাকে না। কোনো কাজে মন নেই। গলায় আর গানের সুর ওঠে না। এমনকি বালিশের কুশনে সুন্দর ফুল তুলে সেলাইয়ের কাজও তার আর ভালো লাগে না। রবার্টকে তার খুব রহস্যে ঢাকা একজন পুরুষ মনে হয়। তাকে ঠিক চিনতে পারছে না। রবার্টও আর আগের মতো জুলিয়ার কাছে আসে না। ঘটনার জট খুলে গেল শীঘ্রই। জুলিয়া একদিন ঠিক করল ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রবার্টের নতুন বানানো বাংলোটা দেখে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আর সেই কাজ করতে গিয়েই অঘটনটা ঘটল:
বিলেত থেকে আনা সাদা রঙের গাউনটা গায়ে চেপে ঘোড়ার গাড়িতে উঠল জুলিয়া। বাংলোর সামনে এসে গাড়িটা থামল। বাহ! বেশ সুন্দর তো। রবার্টের সৌন্দর্যবোধ আছে বৈকি! বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলল জুলিয়া। দরজার পাশেই ভারতীয় পাহারাদার তাকে দেখে সেলাম ঠুকে কুশল জিজ্ঞেস করল। নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইল জুলিয়া। কিন্তু দারোয়ান ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল না। অপমানিত বোধ করল জুলিয়া। দারোয়ানকে বিলাতি কায়দায় একটা ধমক দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল বাংলোর বসার ঘরে। আর সেখানে ঢুকেই আবিষ্কার করল রবার্ট আরেকজন বিলাতি মেমের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছে। জুলিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। বাইরে অপেক্ষমাণ ঘোড়ার গাড়িতে করে যখন তিনি তার নিজের বাড়িতে ফিরলেন ততক্ষণে তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ধারায় সাদা গাল লাল টকটকে হয়ে গেছে। জানা যায়, জুলিয়া কার্টিস বেশিদিন ভারতে থাকতে পারেন নি। মাস ছয়েক পরেই তিনি ভারতে ছেড়ে বিলেতে ফিরে গিয়েছিলেন।
জেনারেল স্যার আয়ান হেমিল্টনের গল্পটা অবশ্য অন্যরকম। ১৮৭০ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তার কর্মজীবন শুরু। মনের মতো কাউকে পাননি বলে আজীবন চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কথায় বলে ‘সবুরে মেওয়া ফলে’। হেমিল্টনের হলো সেই দশা। এক সন্ধ্যায় মার্জুকা নাচের সাথী হিসেবে জুটল এক বিলাতি নারী। আহা! কী সুন্দর আর ভদ্র। পার্টিতেই হেমিল্টন সেই নারীর প্রেমে পড়ে গেলেন। তারপর মহা ধুমধামে বিয়ে।
এদিকে হেনরি আর অনিতি বেভারিডজ আরো এক কাঠি এগিয়ে। ১৮৭০ সালে তারা তখন কলকাতায়। দু’জন দু’জনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, সময় চলে যাচ্ছে এবং বিয়ে করা এখনই প্রয়োজন। কোনো রকম চার্চের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তারা বিয়ে করে ফেললেন। এক্ষেত্রে হেনরি একটি সাফাই দিলেন, “মনে রাখতে হবে আমরা বাঙালিদের সাথে বসবাস করতে করতে অর্ধেক বাঙালি হয়ে গেছি। তাহলে আবার চার্চ কিসের? চার্চ তো আনুষ্ঠানিকতা, এর বাইরে কিছুই না। ” অবশ্য হেনরি দম্পতির মতো অন্য অনেক বিলাতিরাও চার্চের বাইরে নিজেদের মতো হুটহাট বিয়ে করে ফেলতেন। বিলাতি নারী মিনি ব্ল্যান তার মাকে লেখা এক চিঠিতে বন্ধু মিস চারলোটের বিয়ে নিয়ে লিখেছেন, “আমি তার বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম এবং বিয়ে উপলক্ষে সবরকম সহযোগিতা করেছি। বিশেষ করে বিয়ের কেকটির ডেকোরেশন এবং টেবিল সাজানো সব কাজ আমিই করেছি। সত্যি কথা বলতে আমি এ কথা প্রশংসার সাথেই বলতে পারি যে আমাকে ছাড়া কোনো কাজই সেদিন ঠিকমতো হতে পারত না। ”
বিলাতি নারীরা ভারতে সুখের ঠিকানাটি খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা জানি না তবে সুখের জন্যে তারা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটি কি তাহলে তাদের নিয়েই লেখা?
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায় এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়...
পর্ব ২৩ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫