পর্ব ২৩ পড়তে ক্লিক করুন
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে |
১৮৬৫ সালের জানুয়ারি মাস। পুনের কেন্দ্রীয় একটি চার্চে লোকে লোকারণ্য।
“পনের বছরে তের সন্তান! সাবাশ বিলাতি নারী, এগিয়ে যাও। গোটা ভারতবর্ষের সর্বত্র ইংরেজ বীজ রোপণ করে ছেয়ে ফেল। তোমরাই তো বিলাতের গর্ব!”—বলতে লাগল সবাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিলাতি মেম এভিলিনকেই সম্মানিত করা হলো না। তার স্বামী এবং তের সন্তানকে দেওয়া হলো বিশেষ ক্রেস্ট। সেই সাথে ভারতে অবস্থানরত বিলাতি মেমদের উদ্দেশ্যে স্থানীয় উচ্চপদস্থ আইসিএস কর্মকর্তা অনুরোধ করলেন, এভিলিনকে অনুসরন করতে। “সংখ্যা আমাদের বাড়াতে হবে। কারণ এই দেশ আমাদের। ভারতে যত বেশি সম্ভব বিলাতি চাষ অব্যাহত রাখা চাই। ” সবশেষ, বিজয়ের হাসি নিয়ে মঞ্চে উঠলেন এভিলিন। করতালির শব্দে চার্চের দরজা জানালাগুলো ভেঙে পড়বার মতো অবস্থা। কেউ কেউ শিসও বাজাল। এভিলিন কথা শুরু করলেন, “আমাকে আপানারা যেভাবে সম্মান জানালেন এবং আরো সন্তান উৎপাদনে উৎসাহ দিলেন সেজন্য আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন প্রতি বছরই ব্রিটিশ রাজ্যের একটি করে ছাপ ভূ-ভারতের মাটিতে রেখে যেতে পারি। ”
খেয়াল রাখতে হবে, সেই সময় যেসব ভাগ্যবতী বিলাতি নারীরা শহরে বসবাস করতেন তাদের জন্য ডাক্তার বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু যেসব হতভাগ্য বিলাতি মেমরা মফস্বল শহরে বসবাস করতেন, তাদের জীবন ছিল কঠিন। সেখানকার বিলাতি ডাক্তার বা নার্সরাও ছিলেন বদ মেজাজি। মনিকা লাং-এর স্মৃতিকথায় সেরকমই প্রমাণ মেলে। তিনি বলছেন, “অসম্ভব ব্যথায় আমি চিৎকার করছি এবং একজন নার্সকে ব্যথা কমানোর ওষুধ দিতে অনুরোধ করতেই সে আমাকে প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে বলল, তোমার ব্যথার জন্যে তুমি নিজেই দায়ী। অতএব এর থেকে মুক্তির পথ তোমাকেই আবিষ্কার করে নিতে হবে
আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতে ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে বিলাতিদের মৃত্যুর ঘটনা গোটা বিলাতি সমাজে ত্রাস আর ভীতির সঞ্চার করেছিল। ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য রোগের ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার পরও অনেক বিলাতি অল্প বয়সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। জন-এলিজাবেথ দম্পতির কথা বলি। ১৮৩৪ থেকে ১৮৪২, মাত্র ৮ বছরে তারা তাদের ছয় সন্তান হারিয়েছিলেন। শিশুমৃত্যু রোধ এবং সন্তান সম্ভবা মায়েদের শুশ্রূষায় বিলাতিরা বেশ সচেতন হতে শুরু করে। বিশেষত ইংরেজ বংশধর বিস্তারে তৎকালীন বিলাতি সমাজ যথেষ্টরকম চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ১৮৬৫ সালে ‘Birchs Management and Medical Treatment of Children in India’ পুস্তিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের দিকে চোখ রাখা যাক। সন্তান সম্ভবা বিলাতি নারীদের প্রতি তাদের উপদেশ ছিল এরকম, “যারা সন্তান সম্ভবা তারা যেন অবশ্যই অতিরিক্ত গরম, মশলা জাতীয় খাবার এবং শক্ত পোশাক পরিহার করেন। তাদের অবশ্যই হালকা ব্যায়াম করা উচিত আর সেই সাথে ঘোড়ায় চড়া, বেডমিন্টন, টেনিস খেলা এবং দৌড়ানো থেকে নিজেদের দূরে রাখা অবশ্য কর্তব্য। ” মনকে সবসময় ফুরফুরে এবং আনন্দে রাখাও বিলাতি নারীদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল রাখতে হবে, সেই সময় যেসব ভাগ্যবতী বিলাতি নারীরা শহরে বসবাস করতেন তাদের জন্য ডাক্তার বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু যেসব হতভাগ্য বিলাতি মেমরা মফস্বল শহরে বসবাস করতেন, তাদের জীবন ছিল কঠিন। সেখানকার বিলাতি ডাক্তার বা নার্সরাও ছিলেন বদ মেজাজি। মনিকা লাং-এর স্মৃতিকথায় সেরকমই প্রমাণ মেলে। তিনি বলছেন, “অসম্ভব ব্যথায় আমি চিৎকার করছি এবং একজন নার্সকে ব্যথা কমানোর ওষুধ দিতে অনুরোধ করতেই সে আমাকে প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে বলল, তোমার ব্যথার জন্যে তুমি নিজেই দায়ী। অতএব এর থেকে মুক্তির পথ তোমাকেই আবিষ্কার করে নিতে হবে। ”
বিলাতি মেম মিনি ব্লান যখন অন্তঃসত্ত্বা আর অনাগত সন্তানকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন, তখন বিলেতে থাকা মাকে এক চিঠিতে জানাচ্ছেন, তিনি একজন খুব ভালো ভারতীয় দায়মার সন্ধান পেয়েছেন যিনি বিয়ার পান করেন না এবং সর্বক্ষণ তার দেখভাল করেন। ১৮৫৭ সালের ১ মার্চ মিনি ব্লান সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পাঞ্জাবের ঝিলাম শহরে এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কিন্তু ডাক্তারের ব্যবহারে মিনিও সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। মাকে লেখা চিঠিতে মিনি সে প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করলেন: “তিনি (ডাক্তার) আমার প্রতি মোটেও সদয় ছিলেন না। খুব কাঠখোট্টা আর মেজাজি টাইপের। আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। ”
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের কঠিন সময়ে মিনি ব্লান ঝিলাম শহরকে নিরাপদ মনে করলেন না। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য জুন মাসে তিনি ৭৫ মাইল দূরে, রাওয়াল পিন্ডিতে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু রাওয়াল পিন্ডিতে ১২০ ডিগ্রি ফারেন হাইট তাপমাত্রা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। মাত্র তিনদিন পর তিনি আবারও ঝিলাম চলে এলেন এবং কিছুদিন পরই পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। কিন্তু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মিনি ব্লান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পুরোপুরি চালিকা শক্তি হারান। ১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা এক চিঠিতে সে কথা তার মাকে জানান: “প্রতিদিনই যেন দুঃখ নামক শব্দটি আমার জীবনের সাথে যুক্ত হচ্ছে। ” সেই সময়ে বিলাতি নারীদের সন্তান ধারণ, প্রসব করা এবং সন্তানকে জীবিত টিকিয়ে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ‘দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক’ পুস্তিকায় এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “আপনারা অবশ্যই আপনাদের নার্স বা আয়াদের দক্ষতাকে যাচাই বাছাই করে নেবেন। তাদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ছেড়ে দিবেন না। সবসময় চোখ কান খোলা রাখা চাই। ” পুস্তিকাটিতে ভারতে বিলাতি শিশুমৃত্যুর সম্ভাব্য দায়ী বিষয়গুলোর একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। তালিকায় কলেরা, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, বসন্ত, আমাশয়, এলার্জি, অতিরিক্ত গরম, সাপের, কুকুরের এবং মশার কামড়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ ছিল।
১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস। ভারতের মেজর জেনারেল টি ডব্লিউ মার্সারের চোখে ঘুম নেই। একমাত্র সন্তান ফ্রেনকিকে নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত। মাঝে মাঝেই শরীর কেঁপে জ্বর আসে তার। আর সেই সাথে প্রচণ্ড গলাব্যথা। মেজর জেনারেল মার্সার কাছ থেকেই তার পুত্রের অসুস্থতার বর্ণনা শুনব: “৩০ নভেম্বর রাত থেকেই ফ্রানকির শরীরের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। আমি ডাক্তার তলব করলাম। কিন্তু ঠিক সময়মতো ডাক্তার না আসায় ফ্রানকির শরীরের অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। হায় ঈশ্বর! ৩৬ ঘণ্টা পর যখন ডাক্তার এলেন তখন আমার পুত্রের গলার ব্যথাটা গোটা শরীরে ইনফেকশন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তারপর সব শেষ। ”
অনেকটা একইরকম ঘটনা ঘটেছিল বিলাতি নারী হেরিয়েট টেইলরের জীবনেও। তিনি তখন দিল্লিতে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। একমাত্র পুত্র জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ডাক্তার ডাকা হলো। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তার দেরিতে এসে নাড়ি টিপে গম্ভীর কণ্ঠে শিশুটির মৃত্যুঘোষণা করলেন। ঘর থেকে বের হবার সময় ডাক্তার মৃত শিশুর মা হেরিয়েটকে বললেন, “ভাগ্যিস, আমার স্ত্রী বা সন্তান নেই। থাকলে হয়ত এমন মৃত্যুশোক আমাকেও সইতে হতো। শুভরাত্রি। ” তৎকালে ভালো একজন ডাক্তার বা নার্সের সেবা পাওয়া ছিল রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। ডাক্তারদের বিলাতি নারীরা অনেকটা ভয়ের চোখেই দেখতেন।
প্রকারান্তরে বিলাতি নারীদের চোখে ভারতীয় আয়াদের অবস্থান ছিল অনেক উঁচুতে। শিশু সন্তানের দেখাশোনায় ভারতীয় আয়াদের ওপর ভরসা করতেন বিলাতি নারীরা। লাখনৌতে বেড়ে ওঠা বিলাতি সন্তান ন্যান্সি ভারনেদের কথাই ধরা যাক। তিনি বড় হয়েছেন ভারতীয় আয়ার কোলেপিঠে চড়ে। ভারতীয় আয়া তাকে রাতে ঘুম পাড়ানোর গান শোনাতেন, হাত দিয়ে খাইয়ে দিতেন। অনেক বড় হওয়ার পরও ভারতীয় ওই আয়ার ঘুম পাড়ানোর গান না শুনলে ন্যান্সি ঘুমাতে পারতেন না।
১৮৮০ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিটন সিমলার বিশপ কোটন স্কুলের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতায় বলেন, “প্রিয় ছাত্ররা, সবসময় মনে রাখবে, এখানে (ভারতে) জীবন যাপনে এমন কোনো বিপদ আপদ নেই। ” বলার অপেক্ষা রাখে না, তারপরও বিলাতি নারীরা তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের নিয়ে শঙ্কামুক্ত ছিলেন না। ভারতের মাটিতে বেঁচে থেকে যেন ব্রিটিশ রাজ্যের সত্যিকারের উত্তরাধিকার হতে পারে, সন্তানদের ব্যাপারে এমনই ছিল ভারতে অবস্থানরত বিলাতি নারীদের স্বপ্ন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৫