পর্ব ২৪ পড়তে ক্লিক করুন
ভারতীয় চাকর-বাকরদের সাথে বিলাতি নারীদের সম্পর্ক |
বিলাতি নারীদের সাথে ভারতীয় চাকর-বাকরদের সম্পর্ক কেমন ছিল? ১৮৭০ সালে লেডি লিটন যখন কলকাতায় এলেন তখন তিনি বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলেন তার বাড়িতে ভারতীয় চাকর-বাকরের সংখ্যা তিনশ’রও বেশি। তার ভাষায়, “অধিকাংশই নিম্নশ্রেণীর ভারতীয়, তবে দুয়েকজন সাধারণ সেনাও সেই দলে অর্ন্তভুক্ত ছিল।
“যদি কোনো কারণে বিলাতি মেম সাহেবরা চাকর-বাকরদের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এটি বিলাতি সমাজেরই ব্যর্থতা। আপনাদের বুঝতে হবে, বিলাতিরা ভারত শাষণ করছে অতএব প্রতিটি বিলাতিরই উচিত তাদের ওপর শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। অনেক বিলাতি মেমদের দেখা যায় তারা ভারতীয় চাকরদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এটি একটি মারাত্মক রকমের ভুল। আমাদের উপদেশ হলো, আপনারা তাদের সাথে প্রভুর মতোই আচরণ করুন
ঔপনিবেশিক সময়ে কার বাড়িতে কতজন ভারতীয় চাকর—এই সংখ্যা দিয়ে বিলাতিদের সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হতো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে বেশি চাকর-বাকর রাখা সম্ভব ছিল না। তারপরও তারাও চেষ্টা করতেন সংখ্যাটি যেন নিতান্তই কম না হয়। বিলাতি মেম ফেনি পার্কের কথাই ধরুন। ১৮৪৭ সালে তিনি যখন ভারতের এলাহাবাদে এলেন তখন তার বাড়িতে ভারতীয় চাকরের সংখ্যা ৫৭। ১৮৯০ সালে আসা এনেট বেভারিজের বাড়িতে ছিল ৩৯ জন চাকর। ৩৯ জন চাকরের জন্যে তাকে মাসে গুনতে হতো তৎকালীন দুইশ’ ৫০ রুপি। অবশ্য এ নিয়ে এনেট বেভারিজের কোনো রকম উদ্বেগ বা চিন্তা ছিল না। কারণ সেই সময়ে তার মাসিক আয় ছিল ১৮শ’ রুপি। বুঝুন! ১৮৯০ সালে একজন মধ্যম পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তার মাসিক আয় ১৮শ’ রুপি, যেখানে একজন ভারতীয় শিক্ষক প্রতিমাসে মাত্র ১৫ রুপি বেতন পেতেন! ভারতের কী পরিমাণ সম্পদ চুরি করলে এমন জৌলুস জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়া যায়!
আরো অনেক সুযোগ সুবিধা ছিল তাদের। এসব বিলাতি কর্মকর্তারা যে বাড়িতে থাকতেন, বাড়িটির যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, চাকর-বাকরদের খরচ সরকারই বহন করত। মাসিক বেতনের পুরো টাকাটাই তারা আয়েশী জীবন যাপন এবং ভবিষ্যত সঞ্চয়ের জন্য তুলে রাখতেন।
কথা হলো ভারতীয় চাকর-বাকরদের সাথে বিলাতি মেমদের সম্পর্ক কেমন ছিল? ‘দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক’ পুস্তিকায় চোখ রাখা যাক। পুস্তিকাটিতে বিলাতিদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, “যদি কোনো কারণে বিলাতি মেম সাহেবরা চাকর-বাকরদের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এটি বিলাতি সমাজেরই ব্যর্থতা। আপনাদের বুঝতে হবে, বিলাতিরা ভারত শাষণ করছে অতএব প্রতিটি বিলাতিরই উচিত তাদের ওপর শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। অনেক বিলাতি মেমদের দেখা যায় তারা ভারতীয় চাকরদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এটি একটি মারাত্মক রকমের ভুল। আমাদের উপদেশ হলো, আপনারা তাদের সাথে প্রভুর মতোই আচরণ করুন। ”
তবে ‘দি ইংলিশ ব্রাইড’ পুস্তিকায় বিলাতি নারীদের প্রতি উপদেশটি ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। তাদের মতে, “খুব ঠাণ্ডা মাথায় ধৈর্যের সাথে তাদের সাথে আচরণ করুন। আপনারা শিশুদের সাথে যেমন আচরণ করেন, একইরকমভাবে তাদের সাথেও আচরণ করুন। ভুলে যাবেন না, ভারতীয়রা প্রশংসা ভলোবাসে। তাদের প্রশংসা করুন এবং কাজ আদায় করে নিন। ”
সবমিলে, ভারতীয় চাকরদের সাথে বিলাতি মেম সাহেবদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা মনিব ও দাসের মতো। বিলাতিরা জানত ভারতীয়দের সাথে কতটা ভালো আচরণ করা যেতে পারে। সেই অনুযায়ী তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন লাটাইয়ের সুতা ছাড়তে ভালোবাসত। এ বিষয়ে বিলাতি মেম মিনি ব্লানের একটি স্মৃতিচারণ বেশ মজার। তিনি বলছেন, “আমার টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা পরিস্কার করাতে একজন ভারতীয় চাকরের শরণাপন্ন হই। তার কথা শুনে আমি তো অবাক! আমার টেবিলের বাতি ছুঁলে নাকি তার জাত যাবে! এমন কথা একজন চাকর বলতে পারল! সেদিন তার এই কথায় আমি সত্যি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলাম। ”
কিন্তু বিলাতি নারী মনিকা ক্যাম্বেলের অভিযোগ ছিল অন্য জায়গায়। তিনি বিলেত থেকে ভারতে এসেই বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চাকর ছেঁটে ফেলেছিলেন। এই অজুহাতে যে, তাদের কারো সাথেই ভাষাগত যোগাযোগ রক্ষা করা যাচ্ছিল না। তার ভাষায়, “আমি বলি একটা, আর তারা বোঝে আরেকটা। কী মুশকিল!”
সন্দেহ নেই বিলাতি সমাজের সাথে ভারতীয় চাকর-বকরদের যোগাযোগ স্থাপনে ভাষা ছিল বড় রকমের একটি অন্তরায়। সে কারণে আঠার শতকের প্রথম দিকে বিলাতি সমাজে ইংরেজি জানা ভারতীয় চাকরদের চাহিদা ছিল খুব বেশি। ভারতীয়দেরও সে তথ্য জানা ছিল। বিলাতিদের সাথে কাজকর্ম এবং চাকরি বাকরির আশায় ভারতীয়রা ইংরেজি শেখার দিকে জোর দিতে শুরু করে। তবে ১৮৫৭ সালের পর এই চিত্রপটের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে ইংরেজি জানা চাকর-বাকরদের চাহিদা ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করে। ‘দি ইংলিশ ব্রাইড’ পুস্তিকার ভাষায়, “ইংরেজি জানা চাকর-বাকরদের সামনে খুব সাবধানে কথা বার্তা বলবেন। তারা আপনার ঘরের খবর বাইরে পৌঁছে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, তাদের বিশ্বাস করাও কঠিন। ”
ঘটনা কিছুটা সত্যও। সিপাহী বিপ্লবের পরপরই ভারতে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন যখন তুঙ্গে, অনেক বিপ্লবী চাকর বেশে বিলাতি বাড়িতে থেকে তাদের হাড়ির খবর ফাঁস করে দিত। বিশেষ করে সামরিক কর্মকর্তার বাড়িতে কোনো ইংরেজি জানা ভারতীয় চাকর থাকা মানেই ছিল একটি শঙ্কার বিষয়। এ নিয়ে বিলাতি মেমসাহেবরাও কম চিন্তিত ছিলেন না। অতএব সহজ সমাধান হলো চাকর হিসেবে ইংরেজি জানে না এমন চাকরই কাম্য। উটকো কোনো ঝামেলার চেয়ে ইংরেজি না জানা এসব চাকরদের দিয়ে ইশারা ইঙ্গিতে কাজ করিয়ে নেওয়া অনেক ভালো। এ নিয়ে ইংরেজ সমাজেও নানা রকম ফন্দি ফিকির শুরু হয়ে যায়। কিভাবে ইংরেজি না জানা চাকরদের ঠকানো যায় সে ব্যাপারেও তাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। যেমন, তাদের বেতন ছিল খুবই অল্প। কোনো রকম সুযোগ সুবিধা তারা পেতেন না।
চলুন এলাহাবাদে অবস্থানরত বিলাত নারী এনেট বেভারিজের বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি। ১৮৯০ সাল। বাড়িতে মিত্তু রাম নামে এক ভারতীয় চাকরকে নিয়োগ দেওয়া হলো। মিত্তু রাম ইংরেজি জানেন না। তার কাজ হলো বিলাতি মেম এনেট বেভারিজের দেখভাল, ফুটফরমাস খাটা, ফুল গাছে পানি দেওয়া, আর বাজার সদাইয়ে সাহায্য সহযোগিতা করা। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে এক পর্যায়ে মিত্তু রামকে তার কাজ থেকে ছেঁটে দেওয়া হলো। এই নিয়ে মিত্তু রামের মন খারাপ। সে বিলাতি মেমকে অনুরোধ জানাল, তাকে যেন তার কাজের একটি ‘প্রশংসাপত্র’ লিখে দেওয়া হয়। সেই সময় বিলাতি সমাজের পক্ষ থেকে ভারতীয় চাকরদের তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘প্রশংসাপত্র’ দেওয়া হতো। মূল বিষয় হলো, প্রশংসাপত্রটি দেখিয়ে অন্যত্র কাজ পেতে সুবিধা হতো। তো, এনেট বেভারিজ মিত্তু রামকে একটি একটি প্রহসনমূলক প্রশংসাপত্র লিখে দিলেন। এনেট বেভারিজ ভালো করেই জানতেন, মিত্তু রাম যেহেতু ইংরেজি জানেন না তাই তিনি এই প্রশংসাপত্রের বিন্দু বিসর্গ ধরতে পারবেন না। পাঠকদের কৌতূহলের কথা ভেবে প্রশংসাপত্রটি হুবহু এনিট বেভারিজের ভাষাতেই দেওয়া হলো:
“To whom It may concern: Mitto Ram the bearer of this letter has worked for me for three months. His bazaar bills are double those of any servant I have ever employed. He is the biggest liar I have ever met and he has lost most of my shirts.”
১৮৮০ সালে প্রকাশিত ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় ভারতীয় চাকরের একটি বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে। “দেখতে মনে হয় দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা কালো একটি পাথরের মতো। গায়ে কালো কুচকানো একটি কোট, একটি শার্ট আর ট্রাউজার চেপে বসে আছে। ”
তবে সব বিলাতি মেমরাই যে তাদের চাকরদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন, তা নয়। ‘দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক’ পুস্তিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, “আপনি যা চান তা আপনার চাকরকে খুলে বলুন। দেখবেন ভারতীয় চাকরেরা তাদের কাজে বেশ পটু। ” ইথেল সেবির এ বিষয়ে একটি স্মৃতিচারণ করেছেন। “হঠাৎ যদি অপ্রত্যাশিত কোনো অতিথি ঘরে চলে আসে, তখন তাদের আপ্যায়ন নিয়ে চিন্তা হয় বৈকি! তবে ঘরে যদি ভারতীয় চাকর থাকে তাহলে আপনার কোনো চিন্তা নেই। ঝটপট খুব তাড়াতাড়ি রান্না বান্না করতে তাদের তুলনা নেই। ”
বিলাতি মেম এনি উইলসন যখন পাঞ্জাবে তার স্বামীর সাথে বসবাস করছিলেন তখন তিনি তার বাংলোর রসুই ঘর দেখে বিরক্ত হয়ে বলেন, “ছোট একটি অন্ধকার ঘর, মাটির মেঝে। মূল বাংলো থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, ইটের তৈরি একটি মাত্র চুলা যার ওপর বিশাল একটা গর্ত আর তার পাশেই রয়েছে একটি টিনের তৈরি ওভেন। ” তবে এনি উইলসেন ভারতীয় চাকরদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। “যাক, তারা কাজকর্মে খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন আর দক্ষ। ”
বস্তুত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পর্কটা ছিল মনিব ভৃত্যের। বিলাতি হিসেবে তাদের নাক এমনিতেই অনেক উঁচু ছিল। তার ওপর বিভিন্ন রকম সস্তা পুস্তিকায় ভারতীয়দের সম্পর্কে অনেক ভুলভাল তথ্য দিয়ে বিলাতি মেমদের মনে ভারতীয়দের সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করা হতো। তারপরও অনেক বিলাতি মেমদের সাথে ভারতীয় চাকরদের সখ্য হয়েছিল। অনেক ভারতীয় আয়ারা বিলাতি মেমদের সাথে বিলেত পর্যন্ত ঘুরে এসেছিলেন। বিলাতি মেম ভেরোনিকা বেমফিল্ডের সাথে তার চাকরের এতই বন্ধুত্ব হয়েছিল যে, একটা সময় সে তাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল। বিলাতি মেম বারবারা ডোনাল্ডসন ছিলেন একজন বিচারকের কন্যা, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পাকাপাকিভাবে বিলেতে ফেরত যান। কিন্তু বিলেতে গিয়ে তার মনে শান্তি নেই। ভারতীয় আয়ার জন্য তার প্রাণ কাঁদে। এদিকে ভারতীয় আয়াটিও স্বাধীন ভারত থেকে বিভিন্ন রকম ভারতীয় রান্না বিলেতে পার্সেল করে পাঠাতে শুরু করেন। তাদের সেই সম্পর্ক অনেকদিন পর্যন্ত অটুট ছিল।
পর্ব ২৬ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫
টিকে/