বৃহত্তর অর্থে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এ ভূখণ্ডের মানুষের টিকে থাকার লড়াইড়ের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের আগে হাজার বছরের বাঙালি জীবনে বাঙালির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
প্রণয়োপাখ্যানের সীমিত মানবিকতা ছাড়া মধ্যযুগের পুরো সাহিত্য ছিল দেবতার জয়গান। কিন্তু চর্যাপদের কবিতাগুলোর মধ্যে মানুষের সরব উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সমসাময়িক খুব সাধারণ মানুষ—যে তুলা ধোনে, নৌকা চালায়, মাছ ধরে, দই বেচে, মদ বানায়, সাঁকো তৈয়ার করে, দুধ দোহন করে, পশুপাখি শিকার করে, এদের কথাই উঠে এসেছে এসব রচনায়। তাদের মধ্যে যেমন গরীব ব্রাহ্মণ তেমন নিঃস্ব ডোমও আছে। সাধারণ মানুষের চঞ্চুর মধ্যে বেড়ে ওঠা এ ভাষা তাদের অতিক্রম করে যায়নি। চর্যাপদের ডোম এবং ডোম্বী শব্দটি মূলত নারী পুরুষের সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হতো; বলা চলে দেবতাহীন বৌদ্ধদের নর-নারী ছাড়া সাধন-ভজনের আর কোনো উপাদান ছিল না।
উপরোক্ত বিস্তৃত পটভূমিকায় বাংলা কবিতার সংগ্রামশীলতার যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কবিতাকে তার সঙ্গে নিঃসন্দেহে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। কবি সর্বদা অন্যায় অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের যে সশস্ত্র সংগ্রাম তার সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। হাজার বছর ধরে বাংলাভাষী জনগণ তাদের ভাষার দ্বারা তাদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এখন প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলতে আমরা কোন কবিতাকে বোঝাব?
আমরা জানি ইতিহাসের কালে লিপির অধিকার অবাধ ছিল না। এখনো নেই। লিপির আবিষ্কার এবং এর প্যাটেন্ট শাসক ও অভিজাত শ্রেণীর করায়ত্ত। লিপির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জ্ঞানার্জন সহজ ছিল না। এমনকি অষ্টাদশ পুরাণ, রামের চরিত মানব রচিত ভাষায় শ্রবণ করলেও অনন্তকাল রৌরব নরকের বিধান দেয়া হয়েছিল। স্বর্গীয় ভাষা ও গোষ্ঠীর কঠোর অনুশাসনের মধ্যে থেকে এ ভাষার বিকাশ রীতিমতো বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ড হিসেবে পরিগণিত। বিদ্রোহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি সাধারণ প্রবণতা। যদিও চর্যাগীতির পরে বাংলা কবিতা দেবতাদের সঙ্গে একটি আপোষ ফর্মুলায় বিকশিত হচ্ছিল তবু প্রচলিত বিশ্বাস এবং দেবতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সেখানে বিরল নয়। বিশেষ করে মুসলমান রাজার সঙ্গে জমিদারের সংঘর্ষ, দেবীর সহায়তায় হিন্দুর প্রতি অত্যাচারী রাজা নাস্তানাবুদ, পরিণামে দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করা। তবে সব দেবীকে পূজা দিতে এ জনপদের মানুষ রাজি হয়নি। চ্যাঙমুড়ি কানা মনসার সঙ্গে চাঁদসদাগরের বিরোধ বাংলার সর্বাঞ্চলে বিশ শতকেও পরিচিত ছিল। এর মধ্যে আমরা শ্রেণী সংগ্রামের আভাস পাই। শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর ইউসুফ জুলেখা কাব্যে ইয়াকুব নবীর পুত্র বাৎসল্য যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার জুড়ি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে বিরল। ইউসুফকে হারিয়ে পুত্র শোকে মুহ্যমান কবি বলছেন—আমি জনে জনে যেয়ে পুত্র ভিক্ষা চাইব, যে ধর্ম পুত্র ভিক্ষা দেবে আমি সেই ধর্ম গ্রহণ করব।
কবি আব্দুল হাকিমের (১৬০০-১৬৭০) সেই বিখ্যাত উক্তি—বাংলা ভাষা-বিদ্বেষীদের উদ্দেশে তিনি যা উচ্চারণ করেছিলেন। যারা বাংলাদেশে বাস করে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে তিনি তাদের জন্মের বৈধতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। অবশ্য, এ ধরনের চরণ মধ্যযুগে কেবল আব্দুল হাকিম রচনা করেননি, সে-কালের প্রায় সব কবিই তার কাব্যের সূচনাতে এই দেশি ভাষার উল্লেখ করেছেন; কারণ রাজারা দেশি ভাষা বলতেন না, ফলে উচ্চবৃত্তের সঙ্গে ভাষা নিয়ে সর্বদা একটি বিরোধ তাদের মধ্যে জারি ছিল। এমনকি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরও যখন বলেন, ‘না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল/ অতএব কহি ভাষা জাবানি মিশাল। ’ তখনও আমরা বুঝতে পারি জাবানি মিশাল ভাষা প্রয়োগের জন্য তাকেও কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। ঊনিশ শতকের আগে এ ভূখণ্ডের মানুষের কাছে দেশের ধারণাটি আজকের মতো না হলেও ভাষা কেন্দ্রিক একটি স্বাধীন জনপদের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। রাজাকে খাজনা দান আর ধর্ম ও সংস্কারের বন্ধন ব্যতিরেকে তারা ছিল স্বাধীন। এমনকি শাসকরাও এই ভাষাগোষ্ঠীকে সমীহ করে চলেছেন।
দুই.
ইংরাজ শাসনের অবসান ও ভারত বিভাগের আগে এই বিশাল কালপর্বে বাংলা কবিতা নতুন করে মোড় নিয়েছিল। বেরিয়ে এসেছিল মধ্যযুগের সীমাবদ্ধ চিন্তনের পথ থেকে। এই সময়পর্বে কবিতা যেমন পেয়েছিল তার কর্মীষ্ঠ সন্তানদের তেমনি বিদেশি শাসকদের শোষণ ও নির্যাতন কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন। তবে দৈশিক স্বাধীনতার চিন্তা কবিতায় আসতে লেগেছিল সুদীর্ঘ সময়। ইংরাজের শিক্ষা নিয়েই ইংরাজ বিরোধিতার পথে অগ্রসর হয়েছিল নব্য শিক্ষিত আধুনিক বাঙালি কবিকুল। ইংরাজের শাসন যে ন্যয্য নয়, ইংরাজ এদেশে এসছে কেবল মুনাফার লোভে—এ সত্যোপলব্ধি সচেতন জনতার সঙ্গে কবিদেরকেও আকুল করে তুলেছিল।
বাঙালির ছেলে মধুসূদন ইংরাজের কবি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবিতাও যে একটি জাতীয়তাবাদী সত্তা তা বুঝে নিতে এই ইয়ং বেঙ্গলের লেগেছিল কিছুটা সময়। বাঙালির রসাল ও বটবৃক্ষ, নদী ও মন্দিরই যে তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে—ফরাসি দেশে প্রবাস কালে তিনি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। বিদেশ পাড়ি না দিয়েও তার আগে ঈশ্বরগুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) যেমন করে বলেছিলেন—‘কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। ’
এইভাবে কাছের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে যে মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা স্বদেশ চেতনার অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে। মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩) কেবল স্বাধীন চিন্তনের পথেই অগ্রসর হননি কবিতার চলার পথকেও কয়েকশত বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। পয়ারের বাঁধাধরা নিয়ম থেকে তিনি কবিতার ছন্দকে প্রবাহমানতার পথে চালিত করেছিলেন। বিষয় হিসাবে নিয়েছিলেন ভগবান রাম অর রাক্ষস রাবণের কাহিনী। কিন্তু হিন্দুর কয়েক হাজার বছরের কালচালিত বিশ্বাসের বন্ধনকে তিনি মুক্তি দানের চেষ্টা করেছিলেন তার কাব্যে। রামকে তস্কর আর রাবণকে দেশ মাতৃকার বীরযোদ্ধা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন—‘জন্মভূমি রক্ষাহেতু যে ডরে মরিতে; ভীরু সে মূঢ় শত ধিক্ তারে। ’ তস্কররূপী রামকে সিংহাসনে বসানোর জন্য জ্ঞাতি বিভীষণকে গঞ্জনা সইতে হয়েছে। প্রতীকার্থে দেশীয় ইংরাজ কোলেবরেটর মধুসূদনের কাব্যে বিভিষণরূপে চিহ্নিত হয়েছে।
মধুসূদনের সমসাময়িক রঙ্গলাল (১৮২৭-১৮৮৭) ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্যের মাধ্যমে বিদেশি বণিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। যদিও বিষয় হিসাবে তিনি টডের রাজস্থান থেকে চিতোরের পতন কাহিনীকে বেছে নিয়েছেন। তবু নিসর্গ বর্ণনা ও দেশপ্রেমের কালীক বিবেচনায় ইংরেজ বিরোধিতাই ছিল এর লক্ষ্য। বঙ্কিমের মতো পরাজিত মুসলমানরা তার আক্রমণস্থল হলেও বিদেশি বণিকদের প্রতি অবিশ্বাসই তার কাব্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই তিনি বলেছেন, আর পরদেশি বণিক নয়—‘স্বদেশে স্বদেশি ধনী হোক এই চাই। ’ যদিও তার কাব্যে চিহ্নিত বণিক আরব। তবু বিদেশি বণিককে যে এদেশের লোক বিশ্বাস করে না সে বার্তা তিনি তার কাব্যে রেখেছেন। কিংবা তার সেই বিখ্যাত উক্তি ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে। ’ মধুসূদন ও রঙ্গলালের পথ ধরে জাতীয়তাবাদী কবিতা রচনার ধারা অল্পদিনেই বেগবান হয়ে ওঠে।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮০৩), নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৮-১৯০৯) এ ধারার প্রধান কাব্য নির্মাতা। ভারতবর্ষের নিজস্ব পুরাণ কাহিনী ও ইতিহাস নিয়ে কবিতার পথে তারা এগিয়ে আসেন। নবীনচন্দ্রের দৃষ্টিতে সিরাজউদ্দৌলার নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পলাশীতে বাঙালি জাতির পরাজয়কে তিনি অস্বীকার করেননি। তবে যিনি বাঙালি না হয়েও এই জাতীয়তাবাদী কবিদের পরিপুষ্ট করেছিলেন তিনি হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১)। এই পর্তুগিজ সন্তান নিজেকে, এদেশকে তার মার্তৃভূমি মনে করতেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক হিসেবে ইয়ং বেঙ্গলদের মনে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের অনেক আগেই তার ছাত্ররা বুঝতে শিখেছিল—পরদেশি ইংরাজ বণিক কর্তৃক ভারতমাতা বন্দি হয়েছে। তার বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য ফকির অফ জংঘীরা’র দুটি পঙক্তি এখানে উদ্ধার করা যায়—
My country! in the day of glory past
A beauteous halo circled round thy bow
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) জেষ্ঠ্যভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) ডিরোজিওর কবিতা অনুবাদ করে তাকে বাঙালি কবিদের পাশে তুলে এনেছিলেন। দেশ মার্তৃকার পরাধীনতার প্রতি কবির মমত্বের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তীকালে পল্লব সেনগুপ্ত, রমাপ্রসাদ দে-সহ অনেকেই এই স্বর্গচ্যুত অস্থির দেবশিশুর রচনা তর্জমা করেছিলেন। ভারতবর্ষে ডিরোজিওই প্রথম দেশাত্মবোধক কবিতা লিখেছিলেন। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন—তার To India my native land এদেশে প্রথম দেশাত্মবোধক কবিতা।
প্রকৃতপক্ষে ইংরাজ শাসনের সময়কালটি ছিল বিশাল—প্রায় দুইশত বছর ব্যাপ্ত। এই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী অন্দোলন যেমন দানা বেঁধে উঠেছিল তেমনি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কবিদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক ও অভয় মন্ত্রের গান-কবিতা স্বাধীনতার বোধকে তীব্রতর করেছিল। প্রথম পর্যায়ে বিপ্লবীরা রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা থেকে ইংরাজবিরোধী মনোবল চাঙ্গা করতেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের দেশ মার্তৃকার সঙ্গে অপার ঈশ্বরবোধের ধারণা বিপ্লবীদের মনে বল দিয়েছিল। তৎকালীন এক বিপ্লবীর লেখা থেকে জানা যায়, ফাঁসির আগে এক বিপ্লবী রাত জেগে রবীন্দ্রনাথের দান কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন। ‘আজকে হতে জগৎ মাঝে ছাড়ব আমি ভয়/ আজ হতে মোর সকল কাজে তোমার হবে জয়/ তোমার তরবারী আমায় করবে বাধন ক্ষয়/ আমি ছাড়ব সকল ভয়/ আজ হতে মোর সকল কাজে তোমার হবে জয়। ’
তবে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী কবিতা চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করে। স্বাধীনতার দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল তেমনি নজরুলের কবিতা সেখানে ভাষাদানে সক্ষম হয়েছিল। ঘুমন্ত জাতি প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠেছিল। অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে এদেশের মানুষের মনে প্রাণে স্বাধীনতার বাণী যুগিয়েছিল বিদ্রোহী কবিতা। ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লেখার জন্য কবির বইয়ের পর বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জেল জুলুম প্রাণ সংশয় হয়েছে। নজরুলের আগেও ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লেখার দায়ে ইসমাঈল হোসেন শিরাজীকে (১৮৮০-১৯৩১) জেল খাটতে হয়। নজরুল ছাড়াও এ সময়ের প্রধান অপ্রধান সব কবিই দেশ মার্তৃকার স্বাধীনতার পক্ষে কবিতা রচনা করেন।
তিন.
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ ও স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ব্রিটিশ বিতাড়নের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়নি। কেবল মাত্র ধর্মের ভিত্তিতে হাজার মাইল দূরের দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা ও সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীকে এক দেশভুক্ত করা ছিল অবাস্তব এবং একটি রাজনৈতিক ভুল। এ দেশের মানুষ এবং নেতৃবৃন্দের চোখে শিগগির সে ভুল ধরা পড়ে। ইংরাজের সাক্ষাত বিরোধিতা, উচ্চবিত্ত হিন্দুদের হাতে ক্রমাগত লাঞ্ছনা এবং নেতাদের বাগাড়ম্বরতার মধ্যে উপনিবেশোত্তর শাসনতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি খুব একটা ধরা পড়েনি। সবাই স্বপ্ন দেখছিল দু’শত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পরে একটি ইউটোপিয়া রাষ্ট্র গঠনের। ইংরাজের মতো পশ্চিম পাকিস্তানিরাও যে এ ভূখণ্ডের প্রভু হয়ে বসবে মুসলমান হিসেবে একসঙ্গে দীর্ঘদন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে নেতৃবর্গের মাথায় আসেনি।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রথম বড় ধরনের যে আঘাতটি আসে তা হলো সংখ্যা গরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে ৬ শতাংশের মুখের বুলি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা। ভাষার সঙ্গে জড়িত আধুনিক মানুষের পরিচয়ের অহঙ্কার। অপর দেশের ভাষার শ্রেষ্ঠতার মাধ্যমে প্রায় একই ভাষী এ অঞ্চলের মানুষকে দাবিয়ে রাখার বিষয়বস্তুতে পরিণত করা হয়। ব্রিটিশবিরোধী একটি সফল আন্দোলনের পর এ দেশের কবিরা শোষণমুক্ত সমাজের ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা তাদের কবিতাতে তুলে ধরার পাশাপাশি নান্দনিক নির্মাণের দিকে নজর দিচ্ছিলেন। তাই চল্লিশদশকের কবিদের একটি বড় অংশ মার্কসবাদী সাম্য এবং ফররুখ আহমদ-সহ (১৯১৮-১৯৭৪) বেশকিছু মুসলিম কবি ইসলামের ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে কবিতা লিখছিলেন। কিন্তু পকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে চায় এমন কিছু কবি ছাড়া সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে খুব শিগগির গণ-আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সৌন্দর্য সৃষ্টির পাশাপাশি কবির অন্যতম প্রধান কাজ তার সময়কে নির্মাণ। প্রাত্যহিক ঘটমান সত্য কালের সঙ্গে অপসৃমাণ হতে থাকে কিন্তু কবিতার সত্য অনন্তকাল ধরে তার কালকে ভাবিকলের কাছে উপস্থাপন করে থাকে।
এ কথা সত্য ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এদেশের সাহিত্য একটি নতুন মোড় নেয়। যদিও ১৯৫২ সালের একুশের মর্মান্তিক ঘটনার আগে এ ধারার কবিতা আমরা খুব একটা দেখতে পাই না। ওই দিনের বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে মাহবুবুল আলম চৌধুরী ‘আমরা মরতে আসিনি’ নামে প্রথম কবিতাটি রচনা করেন। এর পরবর্তীকালে হাসান হাফিজুর রহমান ‘অমর একুশে’ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ‘কোনো এক মাকে’ আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’ শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ প্রভৃত কবিতাগুলো বাঙালির শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেছে।
এক অর্থে চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা রচনার প্রথম পর্বের সূচনা ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে। ১৯৭১ সালের চূড়ান্ত স্বাধীনতার আগে যা থামেনি। ভাষার পক্ষে স্বাধীনতার পক্ষে পুরো সময় সোচ্চার ছিলেন শামসুর রাহমান (১৯২৯-১৯০৬)। নান্দনিক কবিতা কর্মের পাশাপাশি সমসাময়িক ঘটনাকে কবিতা করে তোলার যাঁর ছিল অসম্ভব ক্ষমতা। স্বাধীনতাপরবর্তী তাঁর টেলেমেকাস, আসাদের শার্ট প্রভৃতি কবিতা মুক্তিকামী মধ্যবিত্তের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া এ সময়ে সিকান্দার আবু জাফরের সংগ্রাম চলবেই, বাংলা ছাড়, যে কোনো মূল্যে, সৈয়দ আলী আহসানের আমার পূর্ববাংলা, আল মাহমুদের সোনালী কাবিনসহ লোকজ জীবন আবৃত তার স্মৃতিবিধুর দেশাত্মবোধের কবিতা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা বেগবান করে তোলে। আবদুল গফফার চৌধুরী রচিত শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গাওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির শোকময় সুর ও বাণী দেশের মাটি মানুষের প্রতি ভালোবাসার আবেগকে আরো ঘনীভূত করে।
তাছাড়া পাকিস্তান শাসকদের বাঙলা ও বাঙালিকে হিন্দুর সমার্থক বিবেচনা করা, হিন্দু বলে সরকারি প্রচার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধকরণ, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব কবি সাহিত্যিকদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরো সরব করে তোলে। বাঙালি মুসলমানদের রক্ষাকল্পে পাকিস্তানি শাসকদের এই সব প্রকল্প উদার ও সংস্কৃতিমনা নাগরিকদের পহেলা বৈশাখ পালন, মেয়েদের কপালে টিপ, পোশাক-আশাকে বাঙালিয়ানার ছাপ এবং রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে আরো উৎসাহী করে তোলে।
চার.
উপরোক্ত বিস্তৃত পটভূমিকায় বাংলা কবিতার সংগ্রামশীলতার যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কবিতাকে তার সঙ্গে নিঃসন্দেহে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। কবি সর্বদা অন্যায় অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের যে সশস্ত্র সংগ্রাম তার সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। হাজার বছর ধরে বাংলাভাষী জনগণ তাদের ভাষার দ্বারা তাদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এখন প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলতে আমরা কোন কবিতাকে বোঝাব? নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত সব কবিতাই মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখা কবিতা যেমন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা তেমন যেকোন ন্যায় আন্দোলনকে সমর্থন করে লেখা কবিতাও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। শাসক যেই হোক—তাদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় শাসনতান্ত্রিক আবদারের বিরুদ্ধে রচিত কবিতাও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। হয়ত এমনও অস্বাভাবিক নয় যে, মুক্তিযুদ্ধের শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাগুলো রচনার জন্য ভবিষ্যতের কবি অপেক্ষা করছে। কিন্তু একটি কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে সব কবি মুক্তিযুদ্ধের কবিতা রচনা করেছে তাদের পঙক্তিতে কি আর কেউ বসার সুযোগ পাবেন? কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কবিতার রচয়িতা কেবল কবিই নন একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে। মুক্তিযোদ্ধা কবির মুক্তিযুদ্ধের কবিতার মূল্য ইতিহাসের সততার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টিকারী ওই নয় মাস কি নান্দনিক কবিতা লেখার পক্ষে ছিল? কবি আর মুক্তিযোদ্ধা তো সমার্থক নন। একজন শক্তিমান কবি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিয়েও মুক্তযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লিখতে পারেন। তার উদাহরণ অবশ্য আমাদের সাহিত্যেও বিরল নয়। তবে আমাদের সৌভাগ্য অধিকাংশ সমর্থবান কবিই সেদিন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তারা ছিলেন আগে মুক্তিযোদ্ধা পরে কবি। এ কথা সত্য যারা শিকারে যায় আর যারা শিকারীর জন্য অপেক্ষা করে তাদের অভিজ্ঞতা এক নয়। অপেক্ষমাণদের কল্পনার সুযোগ বেশি। কিন্তু জীবন ও মৃত্যুর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত সতর্ক থাকতে হয় শিকারীকে। সাক্ষাত মৃত্যুপুরী, বাঘে মহিষে টানাটানি, চারিদিকে বিস্রস্ত লাশ, ধর্ষিতার ক্রন্দন, মুহুর্মুহু গুলির শব্দ—তাতে কী, জীবন তো সবার উপরে। কবি তো জীবনের গান গাইবেনই। সে সময়ে লেখা জসীমউদ্দীনের (১৯০২-১৯৭৬) ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি—
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে,
ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে।
কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা,
কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা।
তাছাড়া ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে কবির লিখিত বেশ কিছু কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-পরিবেশ ফুটে উঠেছে। তার প্রতিবেশিনী গীতাদের পরিবারের পক্ষে আর পাকিস্তানের রুদ্ধ পরিবেশে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এ সময়ের তার কয়েকটি কবিতা, যেমন—গীতারা চলিয়া যাবে, গীতারা কোথায় যাবে, গীতারা কোথায় গেল, দগ্ধগ্রাম প্রভৃতি কবিতায় মুক্তযুদ্ধের ভয়াল পরিবেশ ফুটে উঠেছে। আবুল হোসেন ‘পুত্রদের প্রতি’ আহসান হাবীব ‘আমার সন্তান’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের অনির্বাণ আহ্বান ও মৃত্যুর গৌরব প্রকীর্ণ করেছেন শব্দে। শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিয়ে অনেক কবিতা রয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, গেরিলা, তুমি বলেছিলে, এখানে দরোজা ছিল প্রভৃতি। তবে এ কথা সত্য, শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বাধীনতার তীব্রতর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হলেও যুদ্ধকালীন বারুদের গন্ধ টের পাওয়া যায় না। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চেয়ে তার কবিতায় স্বাধীনতার গৌরব ও আকাঙ্ক্ষার তীব্রতর রূপ প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা গভীরভাবে প্রকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর কবিতায়। এ সময়ে লিখিত আল মাহমুদের ক্যামোফ্লাজ কবিতাটি এখানে স্মরণযোগ্য—
জেনো, শত্রুরাও পরে আছে সবুজ কামিজ
শিরস্ত্রাণে লতাপাতা, কামানের ওপরে পল্লব
ঢেকে রাখে
নখ
দাঁত
লিঙ্গ
হিংসা
বন্দুকের নল
হয়ে গেছে নিরাসক্ত বিষকাঁটালির ছোট ঝোপ
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকও রণাঙ্গণের তীব্র উত্তেজনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতা রচনা করেছেন। লিখেছেন বেশ কিছু প্যাটর্ন কবিতা। গেরিলা শিরোনামসহ এ সময়ে বেশ কিছু কবিতা আমাদের চোখে পড়েছে। সৈয়দ হকের কবিতাটির আঙ্গিক একটি সশস্ত্র গেরিলার আকার ধারণ করেছে। সৈয়দ হকের অভয়মন্ত্রের কবিতা হিসেবে ‘বেজান শহরের জন্য কোরাস’ কবিতা থেকে কয়েকটিপঙক্তি এখানে উল্লেখ করা হলো—
এসো, আমরা পাঠ করি আমাদের স্বপ্নসমূহের লিপি;
এসো, আমরা পাঠ করি আমাদের বাক্যসমূহের সার;
এসো, আমরা পাখির দলের মতো উড়িয়ে দিই আমাদের কোরাস,
অনলের মতো ধরিয়ে দিই আজ আমাদের কোরাস,
মাছের ঝাকের মতো ছেড়ে দিই আমাদের কোরাস,
দীর্ঘ এক ট্রেনের মতো বইয়ে দিই আজ আমাদের কোরাস;
এসো,
আমরা শব্দিত কুঠারের মতো দ্বিখণ্ডিত করি
আমাদের অন্তর্গত পাথর ও ত্রাস।
এছাড়া পঞ্চাশ দশকের কবিদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমানের স্মৃতি, তোমার আপন পতাকা, এখন সকল শব্দই, আবু জাফর ওবায়দুল্লার আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, মানুষের স্বাধীনতা, কমলের চোখ, আর কত রক্ত দিতে হবে, সাইয়িদ আতিকুল্লাহর আরো একবার ভালোবেসে, তাও যদি কেউ দেখে, আতাউর রহমানের মা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের জার্নাল ১৯৭১, সহজে নয়, ঘৃণা-ক্রোধের বারুদ, সন্তোষগুপ্তের ফেরারি স্বদেশ, আহমদ রফিকের এ দেশ আমার স্বর্গ, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছবি, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মঞ্চে দেখা দাও, অপরাজেয়, আলাউদ্দিন আল-আজাদের স্বাধীনতা ওগো স্বাধীনতা, জুলফিকার মতিনের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, ফজল শাহবুদ্দিনের এপ্রিলের একটি দিন ১৯৭১, বাংলাদেশ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাকে, নবান্ন ১৩৭৬, আবুবকর সিদ্দিকের শপথের স্বর, শহীদ কাদরীর নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়, ওমর আলীর স্বদেশে ফিরছি, বেলাল চৌধুরীর স্বদেশভূমি, মর্মে মর্মে স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য।
ষাটের কবিদের অনেকেই সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাদের কবিতায় প্রত্যক্ষ বারুদের গন্ধ ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণ শোনা যায়। ষাটের অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদের ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’ কবিতাটি ঠিক এমন—
হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা কররাম
বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে
ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে
টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালি স্বপ্নকে।
নির্মলেন্দু গুণের আগ্নেয়াস্ত্র কবিতা থেকে—
আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি
কোমল বিদ্রোহী—প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে ঘরে
অথচ আমার সঙ্গে
হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র
আমি জমা দিই নি।
মাহবুব সাদিকের যুদ্ধভাসান কবিতার মধ্যে রয়েছে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। কবি যেখানেই যান সখীপুর তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। হাটফেরা অছিরুদ্দিনের ছিন্নভিন্ন লাশ, গারো রমণীর ভালোবাসা, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস কবির কাছে সখীপুরের সমর্থাক হয়ে দাঁড়ায়—
খুব বেশি দূরে নয় সখীপুর
শহর ছাড়লে গ্রাম, তারপর গ্রাম, তারপর
পাহাড়ের জানু ছুঁয়ে লাঙলের মতো বাঁকা নদী
তারপর সবুজ যুদ্ধভূমি সখীপুর...
কী করে ভুলব তাকে
যেখানেই যাই সখীপুর সঙ্গে সঙ্গে থাকে
আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, আল মুজাহিদী, বুলবুল খান মাহবুব, সিকদার আমিনুল হক, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব আহসান চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, আবু কায়সার, ফরহাদ মজহার, খালেদা এদিব চৌধুরী, সমুদ্র গুপ্ত, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হেলাল হাফিজ, অসীম সাহা, মাকিদ হায়দার, অরুণাভ সরকার, শামসুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, জাহিদুল হক, আলতাফ হোসেন-সহ অনেক কবিই তখন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন।
ষাটের পরে মূলত সত্তর দশকের কবিরাই প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। সাদা কাগজ আর শত্রুর বিরুদ্ধে তারা একই সঙ্গে কলম আর বন্দুক ধারণ করেছিলেন। বুকের রক্ত আর কলমের কালি তাদের কাছে সমার্থক ছিল। তারা ছিলেন ন্যায় সঙ্গত সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের সন্তান। দেশ মার্তৃকার প্রতি ভালোবাসা আর তারুণ্যের তরতাজা আগুন তাদের কবিতাকে দিয়েছিল একই সঙ্গে দ্রোহ ও টিকে থাকার ক্ষমতা। নান্দনিক বিচারে যা ছিল তাদের কবিতার দুর্বল দিক তা-ই কালের বিচারে কালোত্তীর্ণ বিষয় সৌন্দর্য নিয়ে টিকে থাকবে বহুকাল। এ সময়ে যারা কবিতা লিখেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, ত্রিদিব দস্তিদারর, আতাহার খান, মাহমুদ শফিক, ফারুক মাহমুদ, কামাল চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, হাসান হাফিজ, মাহবুব হাসান, নাসিমা সুলতানা, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আসাদ মান্নান, নাসির আহমেদ, মাশুক চৌধুরী, ইকবাল আজিজ, জাহিদ হায়দার, মোহন রায়হান, সোহরাব হাসান, বিমল গুহ, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, সৈয়দ হায়দার, রবীন্দ্র গোপ, আবিদ আনোয়ার, মিনার মনসুর প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বাংলা কবিতায় নিঃসন্দেহে একটি বাক ও বিপ্লব। যেকোন সময়ের কবিতা থেকে তা আলাদা করে চেনা যায়। যুদ্ধের ভয়াবহতা, জীবন-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা, রণাঙ্গণের চিত্র, তৎকালীন ব্যবহার্য মারণাস্ত্র এই সময়ের কবিতার অঙ্গ গঠনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এ সময়ের শব্দ ও বাকপ্রতিমা, উপমা ও উৎপেক্ষা, ছন্দ ও ছন্দপতন বাংলা কবিতাকে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫