আব্বাস ও তারা
ঠিক সন্ধ্যায় যে বৃষ্টি নামে—ঝুপঝুপ ঝুপঝুপ, চারদিক আশ্চর্য কোনো কারণে অন্ধকার হয় না, ডুবে যেতে যেতেও সূর্যটা তার ছায়া সরায় না কালো মেঘের ওপার থেকে, সেসব ভেঙে ঝরে পড়া জলও এমন স্বচ্ছ—মনে হয় রাত্রি নামবার আগে শহরে ভোর নেমেছে ফের। ভোরের সাথে এই বর্ষাক্রান্ত সন্ধ্যার পার্থক্য: সরসর এ জলের ধারায় স্নিগ্ধতা মেলে না, আলো-আঁধার পরিবেশটা হয়ে থাকে অস্থির।
“কী করব ভাই, বিষ্টি নামলি পারে আমার পান-ছিগ্রেট ভিজি যাতো। আপনার দুকান পাইয়ে আল্লার শুকরিয়া কল্লাম আরও। ” কুণ্ঠিত স্বরে সুলেমান চুল থেকে পানি ঝাড়তে চেষ্টা করে, নাকে আসছে সদ্য ভাজা আলুপুরির ঘ্রাণ, মুহূর্তেই ক্ষুধা পেয়ে যায় তার।
ঝুম বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে ওরা ছেলেটাকে হিঁচড়ে নিয়ে যায়, কত বয়স হবে তার? ঊনিশ কিংবা বিশ? না কি আরো একটু বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে? ক্যান্টিনের মালিক নিক্কু মিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে, আব্বাসের দিকে ইঙ্গিত করে—মুক্তি আছে হারামি, সামঝা? সোব মুক্তি হামাদের বন্ধুবাহিনী খোতম কোরে ফেলবে। হামার তো ইচ্ছে কোরে তোদের তামাম বাঙ্গুস লোগো কো চুলা মে জালিয়ে দি, জোবাই দিয়া দি আল্লামিয়ার নামে
“লে রুখ যা ইবারে, সালার বাঙ্গুস আবার আল্লামিয়ার নাম লিচ্ছে, হাসাইলি। ” ক্যান্টিন মালিক বদনে বিরক্তি ধরে রেখেই ময়দার মাঝে আলু পোরে, খানিক বেলে চ্যাপ্টা করে সেটি ছেড়ে দেয় ফুটন্ত তেলে। বড় চুলার আগুনে তার ঘিয়ে ফতুয়া পরা হাড়জিরজিরে গা ঘামে সপসপ করে, বাঁ হাতের তর্জনি দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সে আবার হাত লাগায় ময়দায়।
চাচা মিয়া, দুইটা পুরি দিয়েন আমারে।
হোটেল বয়টি বাঙালি, বয়স দশ-এগার হবে, একটা টিনের পিরিচে দুটো আলু পুরি নিয়ে সে আব্বাসের সামনে রাখে, টেবিলে।
হাসের ঝুল আসে, দিমু?
দেও। কী নাম তুমার?
নাম বলায় ছেলেটি খুব একটা আগ্রহী এমন মনে হয় না। ক্যান্টিন মালিক আবার কর্কশ স্বরে খেঁকিয়ে ওঠে—এত নাম চুদানো লাগবে না তোর, পুরি খেয়ে বিদায় হো আমার দুকান থিকে। বাঙ্গুসদের মুক দেকলে হামার এত গোস্বা হোয়, আর হামার দুকানেই আইবে ফি দিনে।
কাছেপিঠে কোথাও রেডিওতে কাওয়ালি বাজছে, বৃষ্টির শব্দের সাথে ওর সুর মিশে চারদিক কেমন যেন হয়ে ওঠে। সেই কেমন হয়ে ওঠা বাজনার তালে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ক্যান্টিনে প্রবেশ করে লিয়াকত, স্থানীয় শান্তি কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য, কাঁধে একটা চাইনিজ রাইফেল নিয়ে সে বসে পড়ে আব্বাসের পাশেই। টেবিলে তবলা বাজানোর চেষ্টায় আঙুলগুলোর উপর অত্যাচার চালায়, উচ্চকণ্ঠে হঠাৎ হেসে ওঠে, তার নজর ক্যান্টিন মালিকের দিকে—
নিক্কু মিয়াজি, আজ রাত মে জোস মেহফিল হোগা, সামাঝ গায়ে না?
মেহফিল? কাঁহা হোগা ভাইজান?
ইস্কুল মে। আলুব্দি সে চার লাড়কিয়া ক্যাদ কিয়ে হামনে আজ, মেজার সাব কো চারো হি বহত পাসান্দ আয়া। সামঝে না?
পুরি খাওয়া থামিয়ে আব্বাস ওদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বিনিময় দেখে। উর্দু সে একেবারে বোঝে না এমন না। দেশে কী শুরু হলো এইসব? কাওয়ালি সম্ভবত বাজছিল পাশের দোকানে, সেটি হঠাৎ থেমে গিয়ে সংবাদ চালু হয়। খবর পাঠক ঘোষণা করে—দেশের পরিস্থিতি শান্ত হলেও তা বিঘ্নিত করতে সদা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতিকারীরা। আজ দুপুরে বরিশাল জেলা সদরে খাদ্যবোঝাই এক ট্রাকে অতর্কিত হামলা চালায় তারা, ট্রাক লুট করে পালিয়ে যাবার সময় হত্যা করে ত্রাণকর্মে নিয়োজিত চারজন সরকারি সেচ্ছাসেবককে। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এক প্রেসনোটে জানানো হয়েছে দেশের সার্বিক সুরক্ষা ও শান্তি পরিস্থিতি বজায় রাখতে সরবাত্মক চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও..
একটা হইহল্লার শব্দে ওরা সবাই রাস্তায় নেমে আসে। একদল লোক টেনে হিঁচড়ে চশমা পরা একটা ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, বাজারের লালচে আলোয় লোকগুলোর হাতে ঝিকমিকিয়ে ওঠে বৃষ্টিভেজা ধারালো কিরিচগুলো। ঝুম বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে ওরা ছেলেটাকে হিঁচড়ে নিয়ে যায়, কত বয়স হবে তার? ঊনিশ কিংবা বিশ? না কি আরো একটু বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে? ক্যান্টিনের মালিক নিক্কু মিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে, আব্বাসের দিকে ইঙ্গিত করে—মুক্তি আছে হারামি, সামঝা? সোব মুক্তি হামাদের বন্ধুবাহিনী খোতম কোরে ফেলবে। হামার তো ইচ্ছে কোরে তোদের তামাম বাঙ্গুস লোগো কো চুলা মে জালিয়ে দি, জোবাই দিয়া দি আল্লামিয়ার নামে।
আব্বাস কী বলবে ভেবে পায় না, এই বিহারীদের দেখলে তার নিজেরও গা জ্বালা করে। মিরপুরে বসবাস তার জীবনের সবচে বড় ভুল, বিষয়টা সে মেনে নেয় কিন্তু অন্য এলাকাতেও বা সে কিভাবে যাবে এই গোলাগুলিতে? এদিকেই গোলাগুলি তুলনামূলক কম, চারদিকে বিহারী, মিলিটারিদের আপনা লোক। হিতে বিপরীত বিষয় হলো, বিহারীরা মিলিটারিদের চেয়েও বড় যম হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ক’মাসে। এ যুদ্ধ থামবে কবে? গ্রামেও যেতে পারছে না সে, ঢাকা থেকে বেরুতে গেলে নাকি মিলিটারিরা মুক্তি সন্দেহে গ্রেফতার করে। গ্রামে তার মা-বাপ, বউ আছে—বউটা পোয়াতি। ঢাকায় কি সে ইচ্ছে করে এসেছিল? মার্চের মাঝামাঝি এখানে বেড়াতে এসেই না সে এমন ফেঁসে গেল। এখন পান সিগারেট বেচতে পারছে আল্লাহর দয়ায়, কিন্তু কদ্দিন এভাবে যাবে?
জ্বিনে ধরা রমণীর চিকিৎসা
সারা মহল্লায় সাড়া পড়ে যায়, বড় হুজুরের মেয়েকে জ্বিনে ধরেছে। সরকারি কোয়ার্টার এলাকা, এক বাসায় কোনো ঘটনা ঘটলে সকল বাসাতেই খবরটা দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। আর ঘটনা যখন মসজিদের বড় ইমামের (কোয়ার্টার জামে মসজিদের ইমাম দুইজন, ছোট যে ইমাম—সে আকৃতিতেও ছোট, প্রায় বামন) মেয়েকে ধরেছে জ্বিন, সেটা গোটা এলাকাতেই বিশেষ আলোচনার বস্তু হয়ে ওঠে। সবাই বলাবলি করছে বড় হুজুর নিজে জ্বিন পোষেন, সেই পোষা জ্বিন নাকি প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল তার বড় মেয়ে আমিনাকে। আমিনা জ্বিনের সাথে প্রেম করতে রাজি না হওয়াতে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছে সেই গায়েবের জানোয়ার।
কোয়ার্টারের অনেক বাসাই ফাঁকা, লোকজন পালিয়েছে যে যেখানে পেরেছে। এর সাথে জুটে গেছে কিছু উদ্বাস্তু, পাকিস্তানি মিলিটারির পা চাঁটা, বিহারী কিছু পরিবার—এমন লোকজন, একটা বিল্ডিং পুরো দখল করে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। বিকেল বেলা বড় হুজুরের বাড়ির সামনে মিলিটারি জিপটা থামল, খাকি ইউনিফর্ম পরা ছিপছিপে দেহের এক অফিসার নামল দরজা খুলে, তার চোখে কালো চশমা। মৌলানার সাথে এর আগেও তার সাক্ষাৎ হয়েছে, অফিসার প্রায় এসে দোয়া নিয়ে যায় এখান থেকে। স্বদেশকে বিদ্রোহী মুক্ত করবার জেহাদে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সে পূর্বে এসেছে, দোয়া তো তারই দরকার।
বসবার ঘরে একটা গদিমোড়া চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয় পাঠান অফিসার, বিষয়টা তার কানেও এসেছে যে মৌলানার মেয়েকে জ্বিনে ধরেছে। আজ সম্ভবত মৌলানা তাকে সময় দিতে পারবেন না। পাশে দাঁড়ানো স্থানীয় সোর্স সোবহান বিকৃত উর্দুতে বলতে চেষ্টা করে—হুজুরের লেড়কি বহুত হুসনু হোতা হায় সার, আপনার দেখলে আচ্ছা লাগবে, আর বিমার আছে একটু দেখে যাতা হায় না? আর হুজুর তো সার বেত্তমিজ আছে, আপনি আতা হায় আর উয়ো এক বার কে লিয়ে দেখাই নাহি দিয়া! তরুণ পাঠান অফিসারের ইগোতে বিষয়টা যে লাগে না এমন না। আসলেই তো, মৌলানা সাব কি একবার তাকে দেখা দিতে পারতেন না? এমনি ব্যস্ত মেয়েকে নিয়ে? কেশে গলা পরিষ্কার করে সে। ভরাট কণ্ঠে বলে—কল দিস মৌলানা ফর মি, টেল হিম দ্যাট আই ওয়ান্ট টু মিট হিম আর্জেন্টলি।
খানিক বাদে পাঠান অফিসারকে দেখা যায় একটা বদ্ধ কক্ষের চেয়ারে বসে থাকতে। কক্ষের মাঝখানে পেতে রাখা পালঙ্কে হুজুরের বড় মেয়ে আমিনা বসে আছে, তার চুল এলোমেলো, চোখ লাল, এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে অনতিদূরে বসা অচেনা লোকটির দিকে।
আই হিয়ার দ্যাট, ইউ হ্যাভ পজেসড বাই ঘোস্ট, ইজ দ্যাট রাইট?
আমিনা বুঝতে পারে না লোকটি কী বলছে কিন্তু সে জবাব দেয়—তুই কী চাস? তোর গলা টিপে আমি খুন করে ফেলাব।
ইউ থিংক আই ডোন্ট আন্ডার্স্ট্যান্ড বেঙ্গলি? বেসিক্যালি আই অ্যাম, আই ডু নো বেঙ্গলি ইয়াং লেডি।
আমিনারে নিতে আসছোস তুই? আমিনারে চাস? আমিনা তোরে ইন্দুরের মতো চ্যাপ্টা দিয়া মারব। তর চোখ আর বিচি, একসাথে গালায়া ফালামু আমি।
ইউ আর সাচ আ লাভলি লেডি, হুম এভার ডাজেন্ট গিভ আ ফাক? মিলিটারি অফিসারের চেহারায় বিশ্রী হাসি ফুটে ওঠে।
এদের কথোপকথনে ছেদ পড়ে এক বিস্ময়কর ঘটনায়। আমিনার চোখগুলো হঠাৎ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, হাতের আঙুলগুলো হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক লম্বা, এবং আর্মি অফিসারটি ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করে। আমিনার চোখ আর আঙুল যত বিকৃত হয়ে ওঠে, অফিসারের আকৃতি তারচেয়ে পাল্লা দিয়ে ছোট হয়, ছোট হতে হতে সে আকার পায় একটি ইঁদুরের। পর্বতের মতো বিশাল দেহ নিয়ে আমিনা এগিয়ে আসে। অফিসার দেখতে পায়, তার দিকে এগিয়ে আসছে অতিকায় বৃক্ষকাণ্ডের মতো কিছু আঙুল, সে দৌড়ুতে শুরু করলে দেখে চেয়ারের কিনারা থেকে মেঝের দূরত্ব অসীম; যুদ্ধের ময়দানে এককালে অসীম সাহস দেখানো পাঠান লোকটি ভাবে, দেশের জন্য সে অমানুষের মতো ছোট হয়ে যাচ্ছে, এ আত্মোৎসর্গ মহান রাষ্ট্র পাকিস্তান কি মনে রাখবে?
যে ঘটনা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না, তার জায়গা হয় বাতাসে।
আয়সা হি কহিলেন রাবি কেতাবের খবর
বাইরে মূল রাস্তায় ট্যাংকের চাকা গড়ানোর ঘর্ঘর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একটু আগে বৃষ্টি পড়ছিল, এখন তা থামলেও খুব ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে হঠাৎ। খানিক আগে খুব গোলাগুলি হয়েছে এদিকে, গেরিলাদের অদ্ভুত সক্রিয়তায় সালাউদ্দিন পুলকিত হন, মাঝে মাঝে তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে, ভাবেন যুদ্ধে যোগ দিয়ে ফেললে কেমন হয়? পরিবারের কথা ভেবে তাকে অবশ্য চুপসে যেতে হয়। আম্মা-আব্বা, দুই কন্যা আর স্ত্রীকে রেখে যুদ্ধে যাওয়া তারপক্ষে সম্ভব না।
ট্যাংকের চাকার শব্দটা নিকটবর্তী কেন হচ্ছে তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। তবে লোকজনের গলার চড়া স্বরে তার বুকে কাঁপন ধরে। তিনি বাংলা কলেজের শিক্ষক, আলবদরের হাতে এ তথ্য না থেকে পারে না। আর্মি নিয়ে ওরা রেড দিতে আসলো না তো? চারতলার উপর থেকেই তিনি নিচের হল্লা শুনতে পান। স্ত্রী মিনু, দুই কন্যা শিলা আর নদী, তার আম্মা-আব্বা এক সাথে তার রিডিং রুমটায় প্রবেশ করে।
সালু, আর্মিরা কি বাড়ি ঘেরাও দিল আমাদের?
পিতার প্রশ্নে সালাউদ্দিন ঘামতে থাকেন। খানিক আগে যদিও যুদ্ধে না যেতে পারার আফসোস করছিলেন কিন্তু আদতে তিনি অমন সাহসী তো না, তার ভয় লাগে। আবার রাগও হয়, মনে মনে বলে ওঠেন—আসুক শালারা। কী করবে? মেরে ফেলবে?
যদিও মিলিটারি ঘেরাও দেয় না এ বাসা, ওরা ঢোকে পাশের একতলা বাড়িটায়। মেশিন গানের নারকীয় ঠাঁঠাঁ শব্দ কিছুক্ষণের জন্য সবার কানে তালা লাগিয়ে দেয়; শেষ কমাসে এসব অভ্যাস হয়ে গেছে, তবু এদের বুকে কেউ যেন ঢাক বাজায়—গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে ওঠে সবার। নিরেট স্তব্ধতা ও আত্মার গোঙানির ভিতরে সালাউদ্দিনের স্ত্রী মিনুকে সবচে সাহসী মনে হয় সকলের, পঁয়ত্রিশে পড়া এই নারী উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেয়—চা করি। আপনারা চা খাবেন? সবাই কেমন যেন একটু ঘোর লাগা চোখে তাকায় মিনুর দিকে, অতঃপর স্বস্তির একটা শ্বাস ছাড়ে। পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গীন মুহূর্তে কেবলমাত্র একজন পূর্ণাঙ্গ নারীই হয়ে উঠতে পারে সবচে বড় আশ্রয়, সাহস।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সালাউদ্দিন ভুলে যেতে চেষ্টা করেন যে, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, মিলিটারিরা সারা দেশে পতঙ্গের মতো মানুষ মারছে; রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার চালাতেও ভয় হয় তার, ভয় হয় যে দেয়ালেরও কান আছে; আগামীকাল খাদ্যের সন্ধানে তাকেই বাজারে যেতে হবে মিলিটারিদের সামনে দিয়ে—ভুলে যেতে চান এই ভীতিও। তিনি আলবেয়ার কাম্যুর প্লেগ খুলে বসেন। যে ভুবনবিখ্যাত আখ্যানে দেখা যায়: আলজেরিয়ার ওরাও বন্দরে প্লেগ নেমে আসে, তার অন্ধকার আক্রোশে হাজারে বিজারে মানুষ মরলেও যারা বেঁচে থাকে, মৃত্যুর সাথে অভ্যস্ত হবার চেষ্টায়—তাদের বুকে প্রত্যাশা জেগে থাকে, একদিন শহর ছেড়ে প্লেগ বিদায় নেবে; ভুলে যাওয়ার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সালাউদ্দিনের মনে একই আশঙ্কা কিংবা প্রত্যাশা জেগে ওঠে—এইদেশ স্বাধীন হবে তো?
খাতা বের করে তিনি লিখতে শুরু করেন খসখস শব্দে: আজ বিষ্যুদবার, সময় মধ্যরাত্তির; লিখছি। খানিকক্ষণ আগে পড়ছিলাম আলবেয়ার কামুর প্লেগ, বাইরে হচ্ছিল গুলি। আমার দেশেও আদতে প্লেগ তার ত্রাস ছড়াচ্ছে না এখন? আমার বুক একেকসময় ভরে ওঠে এইদেশে ডাক্তার রিওর মতো অজস্র সাহসী মানুষ মাঠে নেমে পড়েছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নামক প্লেগ থেকে দেশটাকে মুক্ত করবার জন্য। এই যুদ্ধের গল্প একদিন লিখব, যদি আমি একটা স্বাধীন দেশে শ্বাস নিতে পারি..
রাতের নিয়ম হচ্ছে সে যত বয়সী হয়, অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করে। দেয়ালের মাকড়সাটির দিকে তাকালে সালাউদ্দিন দেখতে পেতেন পোকাটিও ওর কয়েকজোড়া চোখ নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫