একাত্তরে কত ছিল তার বয়স? এই ধরো ১৪ বছরের মতো। পিচ্চিটা অষ্টম শ্রেণী পাস করে মাত্র নবম শ্রেণীতে উঠল।
যেই কালরাতে পাকিস্তানিরা ঘটিয়েছিল ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা। সেই রাতে মানে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের কিছুক্ষণ আগে দুঃসাহসী জালাল তার ভাই ফরিদউদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ও ইসরাত উদ্দিন আহমেদ বাবুলসহ তিন থেকে চারশ’ সঙ্গী নিয়ে কাঠের গুঁড়ি, ভ্যানগাড়ি, বাঁশ, পরিত্যক্ত গাড়ি, ড্রাম দিয়ে বাংলামোটরের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দেয়। জালালের সাহস দেখে তার বাবা পুলিশ সুপারও ভয় পেয়ে যান। শুধু ডর-ভয় নেই এইটুকুন একটা ছেলের
এই খেপাটে জালাল যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক আগেও যুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু ভাবত না। ভাববেই বা কেমন করে? তার কি ভাবাভাবির সেই বয়স হয়েছিল? দিনমান দস্যিপনায় থাকত সে। একাত্তরের ১ মার্চ সে স্কুল বন্ধুদের নিয়ে খেলতে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলের মাঠে। ওটা ছিল তাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। মাইকে গান বাজছে। দুপুর একটার দিকে বড়দের কেউ একজন একটা রেডিও নিয়ে এলেন মাঠে। জালাল দেখে, রেডিও হাতে বড়রা অপেক্ষা করছে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শোনার জন্য। অপেক্ষার এক পর্যায়ে দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে ঘোষণা এলো—৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। এই সংবাদ রেডিওতে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া জালালও যোগ দেয়। সবাই মিছিল করে। বড়দের মতো হাত উঠিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে স্লোগান দেয় জালাল। তার চোখের সামনেই খেপে উঠে আশপাশ। খেপে ওঠে ঢাকা। বিক্ষুব্ধ নগরী হয়ে যায়। সবার মুখে মুখে জয় বাংলা স্লোগান। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’।
সেদিন রাত করে বাসায় ফিরেছিল জালাল। জালালের বাবা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের ঢাকার গোয়েন্দা শাখার পুলিশ সুপার। সেই সুবাদে জালালরা থাকত ইস্কাটন গার্ডেন সার্কিট হাউজের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে। ১ মার্চ জালালের মনটা অন্য রকম হয়ে যায়। দেশের জন্য তার মায়া বেড়ে যায়।
তবে যেই কালরাতে পাকিস্তানিরা ঘটিয়েছিল ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা। সেই রাতে মানে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের কিছুক্ষণ আগে দুঃসাহসী জালাল তার ভাই ফরিদউদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ও ইসরাত উদ্দিন আহমেদ বাবুলসহ তিন থেকে চারশ’ সঙ্গী নিয়ে কাঠের গুঁড়ি, ভ্যানগাড়ি, বাঁশ, পরিত্যক্ত গাড়ি, ড্রাম দিয়ে বাংলামোটরের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দেয়। জালালের সাহস দেখে তার বাবা পুলিশ সুপারও ভয় পেয়ে যান। শুধু ডর-ভয় নেই এইটুকুন একটা ছেলের।
এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এসে জালাল যুদ্ধে যোগ দিতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। প্রথমে সে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যায়। ভৈরব থেকে মেঘনা নদী পেরিয়ে আশুগঞ্জে। সেখানে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মো. গাফফার, ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ নাসিমকে পায়। তাদের কাছে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বলে জালাল। বয়স কম হওয়ায় কেউ তার কথা আমলে নেয়নি। তবু ওখানে থেকে যায় জালাল। দুয়েক দিন থাকার পর ১৪ এপ্রিল হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা আশুগঞ্জে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর জঙ্গি বিমান ও হেলিকপ্টার হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করে। কিন্তু এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী টিকতে পারেনি। আশুগঞ্জের মেঘনা পাড়ের এই যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে বাঙালি মুক্তিসেনাদের ওই বাহিনীর সঙ্গে ১৭ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা চলে যায় জালাল। সেখানে কিছুদিন থেকে ফিরে আসে ঢাকায়।
ঢাকায় আসার কয়েক দিনের মাথায় আফজাল নামে পাঞ্জাবি এক কর্মকর্তা যিনি ছিলেন এডিসি, তিনি জালালকে বলেন, ‘তোমার তো বেশ সাহস। এই সাহস নিয়ে ঢাকায় থাকা উচিত হবে না। যুদ্ধে যাও, তোমাদের স্বাধীনতা আসবেই। ’
বিচ্ছু জালাল দ্বিতীয়বারের মতো আবার ঘর ছাড়ে। এবার সরাসরি চলে যায় আগরতলায়। সেখানে গিয়ে যোগ দেয় ২ নম্বর সেক্টরের মতিনগর ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনারা হামলা করলে ক্যাম্প স্থানান্তরিত হয় মেলাঘরে। মেলাঘরে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় জালাল। তার টেকনিক এবং সাহস দেখে ট্রেইনারও অবাক হয়ে যায়। ছোট্ট জালালসহ আরো কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধাকে স্পেশাল টিমের জন্য তৈরি করতে থাকে। কমান্ডো ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার এই সাহসী দলকে হিট অ্যান্ড রান টেকনিকের স্পেশাল ট্রেনিং দেন। এই যোদ্ধারা শুধু মারবে আর দৌড়াবে। পরে তারা ওয়াই প্লাটুন ‘সজীব গ্রুপ’ নামে গেরিলা বাহিনীর সদস্য হয়ে অবরুদ্ধ ঢাকায় কখনো চোরাগুপ্তা, কখনো গেরিলা অপারেশন করে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
তারা ঝটিকা হামলা চালায়। হামলা চালিয়ে চোখের পলকেই তারা হারিয়ে যায়। তাদের এই গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পুরুরা গ্রামের মফিজুর রহমান খান সজীব। তার নামেই দলের নাম হয় সজীব গ্রুপ। সজীব গ্রুপের বিচ্ছু জালাল একদিন গেরিলা অভিযানে গিয়ে ধরা পড়ে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পুরনো এমপি হোস্টেলে। যেখানে ছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, ছিল বদি, জুয়েল, আজাদসহ অনেকে। ছোট্ট জালাল কাছ থেকে তাদের দেখে। আর তাদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের নির্মম দৃশ্য দেখে পাকিস্তানিদের প্রতি আরো ঘৃণা আসে তার মনে। সেই সেলে অমর একুশের গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদও ছিলেন। তাকেও অনেক কষ্ট দিচ্ছিল রাজাকাররা। কষ্ট দিয়েছিল জালালকেও। সেদিনের কষ্টের দাগ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন জালাল। এখনো তার শরীরে রয়ে গেছে শত্রুদের পেটানো ক্ষত। জালালকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে আফজাল নামে সেই পাঞ্জাবি এডিসি ছুটে যান। অনেক খুঁজেটুজে তিনি নির্যাতন কেন্দ্র থেকে জালালকে উদ্ধার করেন।
বিচ্ছু জালাল নামে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো হাঁটেন ঢাকার রাস্তায়। যেই রাস্তায় একাত্তরে সে ব্যারিকেড দিয়েছিল সেই রাস্তায় এখন গাড়ি চলে হাওয়ার বেগে। আর গাড়িতে পতপত ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা। এই দেখে প্রাণটা ভরে যায় একাত্তরে চোরাগুপ্তা হামলা চালানো সাহসী সেই বিচ্ছু ছেলেটার। পতাকার প্রতি জালালের যেই মায়া জন্মেছিল একাত্তরে। সেই মায়া রয়ে গেছে এখনো। তাই তো সে এখনো কপালে বেঁধে রাখে দেশের পতাকা। তার গায়েও পতাকার রঙ; লাল-সবুজের জামা পরে থাকে সারা দিন। গায়ে পতাকা জড়িয়ে এখনো শহরের রাস্তায় হাঁটেন। সভা-সমাবেশে যান। পরিপাটি হয়ে আবার টিভিতেও কথা বলেন। তার শরীরের মতো ভাবনা জুড়েও আছে দেশ!
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫