ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

একগুচ্ছ কবিতা | কুমার চক্রবর্তী

কবিতা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৩ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৬
একগুচ্ছ কবিতা | কুমার চক্রবর্তী

ব্যক্তিত্ববিজ্ঞান

তোমাকে পাহারা দেবার জন্যই রয়েছি আমি। পাহারা দিতে দিতেই জন্ম দিই, এবং মুছে ফেলি এইসব ভাঙা কবিতা।


ফুটো হয়ে যাওয়া আকাশপথে একে একে উড়ে গেল গাছপালা, নুড়িপাথর আর জমে থাকা জলের সমুদ্র। উড়ে গেল বোধ, হর্ষ আর প্রতীকের বহুরূপতা।
বাঁচতে চেয়েছিলাম গাছেদের মতো—নগ্ন এবং পোশাকি। যেন বৃষ্টি হলে খসে পড়ে পোশাক, নগ্নতাই যেন  পোশাক হয়ে  ওঠে।
লিখতে চাইনি কবিতা; শুধু একা হওয়ার জন্য বলেছি, জীবন থেমে যাও অন্য পথ থেকে, শব্দরা সংযমী হও, প্রকাশ করো তোমাদের  স্মৃতিরহস্যবাদ। আর পৃথিবীকে বলেছি, পৃথিবী, জন্ম দাও মর্ত্য বিপর্যাস, আমাকে তোমার অন্তর্বস্তু করে নাও, গূঢ় করো আমার চিন্তন।

পুরোনো দিনের মতো হেসে ওঠো তুমি। আমি বুঝি এইসব স্নায়ুর চাঞ্চল্য, এইসব বায়ুরোগ। যখন নগ্ন হও শুধু তখনই তোমার অন্য এক ব্যক্তিত্ববিজ্ঞান, যা আমাকে আর সব আবশ্যকতা থেকে মুক্ত করে আবারও আত্মোন্মাদ করে তোলে।


নিজের পথ

জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে তাড়াহুড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিলে তোমরা।   বোঝনি, তাড়াহুড়ায় জীবন আরও দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
বস্তুর রহস্য আর রূপকার্থ নিয়ে তোমরা উদ্বেল হয়ে উঠেছিলে, আর নিজেকে বানিয়ে ফেলেছিলে এক একজন আসঙ্গলিপ্সু রহস্যবাদী। কেউবা  জ্ঞেয় আর অজ্ঞেয়বাদের পর্বতারোহণে গিয়ে বরফ হয়ে ফিরে এলে। বোঝনি, শীত আর গ্রীষ্ম তোমার ভেতরেই রয়েছে যা সময়সুযোগ মতো একে অন্যকে সুবিধা দেয়, আর তোমাকে দেয় ঋতুচক্রের নিশ্চয়তা।
সুতরাং হয়ো না নস্টিক, মিস্টিক, স্টোয়িক বা কাবালিস্ট। হয়ো না সোফিস্ট, নিউপেটনিস্ট। তুমি হও  যা হয়নি অন্যরা।
মনো রেখো, বাঁচার জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো নিজের পথ, যেভাবে বাঁচে—ফুল, পাখি, মেঘ আর মেরুতুষার। যখনই অন্যের পথে যাবে, তখনই মৃত্যুর দিকে চলে যাবে তুমি, যেমন যায় তোমার আর বন্ধুসকল।


পশুচিকিৎসালয়

বৃক্ষদের দেখলে মনে হয় তাদের মতো হই। সবখানেই, অথচ একা, ছুঁয়ে যায় রেখা ও রক্ত, আকাশের খনির ভেতর। পশুচিকিৎসালয় থেকে এই আমাদের চিন্তার সর্বশেষ ময়নাতদন্ত।
আরম্ভটা আমি করিয়ে দেব কিন্তু সমাপ্তিতে যেতে হবে তোমায়। মনে রাখবে, সব আরম্ভেরই সমাপ্তি থাকে না। কিছু আরম্ভের থাকে উৎসমুখ, থাকে অনন্তের গান। আরও মনে রেখো, কেউ কেউ আবার সমাপ্তি দিয়েই শুরু করে। ঝরাপাতাদের কোনোটিই থাকে না, শুধু সরে যাওয়া ছাড়া।

উঠতে কষ্ট হয় না আমার, কিন্তু নামতে গেলে কষ্ট বেড়ে যায়। এইসব অপরসায়ন, ধাতু আর তরলের খনি, রচনা করেছে প্রতীক আর সাদৃশ্যের বনভূমি। এক অস্পষ্ট অনুভূতি আর এখানে মানুষ এবং মেঘ-বৃক্ষ-পাহাড়েরা ক্ষণস্থায়ী শূন্যতায় রয়েছে অমীমাংসিত।
অনন্তগামী ভ্রমণে সবকিছুই অনুমিতি, প্রাচীন পৃথিবীর সমাপ্তি-দর্শন কী কাজে আসে আর। অতএব নিজেকে বিলুপ্ত করো বায়ুতে, আকাশে, শব্দে আর শিশুপ্রকৃতির গুহ্য সংশয়ে। কেননা সব অস্তিত্বই বলে যে, ‘আমি পূর্বাপর অস্তিত্বহীন’।
পশুচিকিৎসালয়ে এই আমাদের পূর্ববোধ, আমাদের দস্তুর অটোসাইকোগ্রাফি।
 

অধিপ্রাণবাদী

মুক্ত হতে গিয়ে আটকে যাচ্ছি প্রতিটি বস্তুর ঘনত্ব-ছায়ায়। যা কিছু শিখেছি তা ছুড়ে দিচ্ছে আমাকে সংশয়বাদে, আর যা শিখিনি তা-ও ছুড়ে দিচ্ছে আমাকে অস্তিত্ব ও প্রতিভাসের খমধ্যবিন্দুতে। এক শান্ত বিমূর্তকরণ আমাকে ভ্রমণ করে, দেখে নেয় নিবৃত্তি এবং  নিশ্চেতনের খাদগুলোকে, অন্তর্নারীত্ব আর অন্তর্পুরুষত্বের উভবলতাকেও পরখ করে নেয় আমার অপবেদন। যে রক্তকে লাল মনে হয়, আসলে তারা নীল, কারণ তা না হলে ব্যথা হতে পারত না পরানুভব।
মৃত্যুপরবর্তী কোনোকিছুতে বিশ্বাস না করেই আমি চাই অমরত্ব, খ্যাতি এবং ব্যক্তি-অভিন্নতা আর ঈশ্বর, পৃথিবী ও মানুষ সম্পর্কে না জেনেই আমি হতে চাই অধিপ্রাণবাদী। আমার রয়েছে জানা ও না-জানার সমুদ্র যা আমাকে কখনও একা করে, কখনও বা করে অসংখ্য।


আধিবিদ্যক জ্বর

চেষ্টা করো গাছেদের ভ্রমণ বুঝতে, চেষ্টা করো ধরতে  স্থিতিবিদ্যার কুহক। প্রতিটি গন্তব্যই আসলে আরম্ভের ভিত্তিবিন্দু, প্রতিটি চিন্তাই এক সজীব জড়বাদ।
হাঁটতে হাঁটতে কখন থেমে পড়েছি তা বুঝে ওঠার আগেই নিঃশেষিত সময় জন্ম দিয়ে গেল এক ছায়াপৃথিবীর। আমি এক গাছ, ভোর হয় স্নায়ুর জঙ্গলে আর পাখিরা উড়ে হারিয়ে যায় শরীর থেকে মনের গভীরে।
আমি তো আমি নই, আমি হলাম তুমি আর সে, এবং পৃথিবীর অসংখ্য আয়না-প্রতীক নিয়ে ছকবন্দি ব্যক্তিত্বের উদ্ভিন্নতা। পুব আর পশ্চিমে ঝুলে থাকা জীবন এভাবেই জন্ম দেয় বিস্ময় আর বিমূঢ়তাবোধ।
বিন্দু থেকে জন্ম নেওয়া বর্ণ, বর্ণ থেকে জন্ম নেওয়া বাক্য আজ হয়ে পড়েছে অনস্তিত্বের ধ্রুবক। আমি ভাবি, সমুদ্রের তলে রয়েছে যে এবেড়োখেবোড়ো পাহাড়-পর্বত, কতকাল সয়ে যাবে তারা এই অতলান্ত জলের ভার!



বাংলাদেশ সময় : ১৩১৪ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।