ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সঞ্চারপথ | আশিকুর রহমান তানিম

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৬
সঞ্চারপথ | আশিকুর রহমান তানিম

ধ্যরাতে আমার বাসার খালি রুমটার বারান্দায় দাঁড়ালে অনেক দূরে একটা বাড়ির জানালায় আলো জ্বলতে দেখা যায়। আরো বেশ কিছু বাসা বাড়ির জানালায়ই আলো জ্বলতে দেখা যায়, কিন্তু, আমি নির্দিষ্ট করে ঐ জানালার কথাই বলছি কারণ আমার মনে হয় ঐ আলোটা আমাকে সম্মোহিত করে।

আলোটার মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা আমাকে নেশাতুর করে ফেলে, কিছু একটা ইঙ্গিতে আমাকে কাছে যেতে বলে।

আমি বেশ কিছু ভূতের বই কিংবা এমনি বইতেও আলেয়ার কথা পড়েছি, আলেয়ার কাহিনী শুনেছি। আলেয়ার খুব সম্ভবত কোনো কমন ফর্ম নেই, অনেকে বলে একটা মেয়েরূপী কাউকে দেখা যায় নাচছে আর তার সারা শরীরে আলো জ্বলছে, আবার অনেকে বলে, শুধু একটা হ্যারিকেন কিংবা কুপিবাতির আলোর মতোই দেখতে এটা। এই আলেয়া বা যাই হোক, তাকে ধরতে গেলে সে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। রাতের বেলায় যারা পথ চলে, তাদেরকে আলেয়া তার পেছনে সম্মোহিত অবস্থায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করে একসময় মেরে ফেলে।



আমি বোধহয় ঠিক বোঝাতে পারছি না আপনাকে, আলোটা কেমন কিংবা আমাকে কিভাবে সম্মোহিত করে, না? আসলে আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই, ব্যাপারটা কীরকম। আমি যখন আলোটার দিকে তাকাই মনে হয় আমি কোনো বিশাল এক খোলা মাঠে বসে আছি। শরীর ঘামার পর হঠাৎ বাতাস আসলে যেমন একটা শীত শীত লাগতে থাকে, ঐরকম লাগে



আমি জানি না আপনি আমার কথাগুলো বিশ্বাস করছেন কিনা। কিন্তু, যেহেতু পড়ছেন, আমি আশা করছি ব্যাপারটা রীতিমত হাস্যকর বলেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। ও আচ্ছা, এটাও বলে রাখা দরকার, এই আলোটা আমাকে সবসময়ই, মানে, চব্বিশ ঘণ্টাই কিন্তু সম্মোহিত করে রাখে না। যেমন, মাঝে মাঝে হয়তো কয়েক রাত আমার বারান্দায় যাওয়াই পড়ে না। আমিও এটার কথা মাঝেমধ্যেই ভুলে যাই। তারপর হয়তো কোনোদিন থুথু ফেলতে অথবা যেকোন কাজে অন্যমনস্ক হয়েই বারান্দায় যাই, দূরের ঐ জানালাটায় চোখ পড়ে, আর, ঐ ঘটনা ঘটে।

আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, এটা কি আলেয়া? আমি এটার পেছনে ছুটতে শুরু করলে কি সত্যি সত্যি এটা দূরে সরে যাবে?

২.
আপনি হয়তো এখন ভাবছেন, এই আলোটা যদি আমাকে এতই বিচলিত করে, তাহলে আমি এর উৎস অনুসন্ধান করি না কেন, তাইতো? আমি আসলে করার চেষ্টা করেছিলাম। সমস্যা হচ্ছে, আলোটা অনেক দূরের একটা বিল্ডিংয়ে জ্বলে, উপরন্তু, ঐ বিল্ডিংয়ের ঐটাই একমাত্র জানালা যেটায় আলোর কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়। বুঝতেই পারছেন, এত দূর থেকে আসলে ব্যাপারটা বোঝা অসম্ভব যে ঠিক কোন ফ্লোরের কোন ফ্ল্যাটে আলোটা জ্বলে। তারপরও, দিনের বেলায়, যখন আলোটা জ্বলে না, আমি ঐ এলাকায় গিয়েছিলাম। আমার আন্দাজশক্তির ওপর আমার তেমন একটা ভরসা না থাকলেও খুঁজে খুঁজে বিল্ডিংটা পেয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু, সবগুলো ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদেরই আমাদের মতো আট-দশটা সাধারণ ফ্যামিলিই মনে হয়েছে। সব বারান্দায়ই নিয়ম করে কাপড় ঝুলছে, কোনো কোনো বারান্দায় শখের বাগান—একদম আটপৌরে জীবন। আমার কিছুতেই মনে হয়নি যে, এরকম কোনো ফ্ল্যাটে গভীর রাতে অদ্ভুত আলো জ্বলতে পারে।

আমি বোধহয় ঠিক বোঝাতে পারছি না আপনাকে, আলোটা কেমন কিংবা আমাকে কিভাবে সম্মোহিত করে, না? আসলে আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই, ব্যাপারটা কীরকম। আমি যখন আলোটার দিকে তাকাই মনে হয় আমি কোনো বিশাল এক খোলা মাঠে বসে আছি। শরীর ঘামার পর হঠাৎ বাতাস আসলে যেমন একটা শীত শীত লাগতে থাকে, ঐরকম লাগে। আশেপাশের সবকিছুই তখন আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। মহাবিশ্বে তখন সবরকমের নক্ষত্রজগত বিলীন হয়ে যায়। মনে হয় ঐ আলোটাকে কেন্দ্র করেই সমগ্র জগত, আর আমি তার একমাত্র গ্রহ।

৩.
যাই হোক, এইভাবে আলোটা মাঝেমধ্যে জ্বলছিল, আমাকে সম্মোহন করছিল, আমিও সম্মোহিত হচ্ছিলাম। তারপর একসময় নিয়মিত বিরতিতে ভোরের দিকে আমাকে বারান্দায় অচেতন অবস্থায় পাওয়া যেতে লাগল। আমার পরিবারের মানুষজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলেছিল, হাইপারটেনশন। আমাকে গাদা গাদা এই অষুধ সেই অষুধ, ঘুমের অষুধ দেয়া হয়েছিল। আমিও আইসক্রিমের বক্স থেকে নিয়ম করে অষুধ খাওয়া শুরু করলাম।

আমার স্ত্রীও আমাকে রীতিমতো বকা-ঝকা শুরু করল যে, মধ্যরাতে উঠে ভূতের মতো বারান্দায় যেতাম কেন? ও ভালোভাবেই জানে, আমার সিগারেটের অভ্যেস নেই; একসময় ছিল, এখন আর নেই। তারপরও কেন যাই? আচ্ছা, আপনি কি ভাবছেন যে, আমি আমার স্ত্রীকে আলোটার কথা বলিনি কেন? সত্যি বলতে, আলোটার কথা বলে ফেললে আমার স্ত্রী তৎক্ষণাৎ সাফ সাফ বলে দিত, এক মাসের মধ্যে বাসা ছাড়তে। আমরা ভাড়াটিয়া মানুষ, শিকড় উপড়ে ফেলা আমাদের জন্য সোজা। কিন্তু, আমার এই বাসাটা খুবই পছন্দ, প্রায় আট বছর হয়ে গেল এই বাসায়। মেয়েটার স্কুল একটু দূরে হয়ে গেলেও আমি এই বাসা ছাড়ার নাম করি না। আচ্ছা, লুকোছাপা করে লাভ নেই, আপনাকে সত্যি কথাটা বলেই ফেলি, আমি আসলে আলোটার জন্যই বাসা ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলাম না। আলোটা আমাকে যাই করুক, আমার সেটা ভাল্লাগতো। বারান্দায় গিয়ে ঐ আলোটাকে দেখলে মনে হতো, আমি আসলে বিশাল এই নিঃসীম জগতে একা নই, আরো কেউ আছে। কোথাও না কোথাও কেউ একজন আছে, যার কাছে আমি ঠিক আমিই। সত্যি বলতে, এই অনুভূতিটার জন্যই আমি বাসা ছাড়তে রাজি ছিলাম না। তাই, স্ত্রীকেও বলা হয়নি। ওর স্বভাবটা কেমন জানেন? মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো। আমার মেয়েকে কোন ছেলে যেন ডিস্টার্ব করত, সেজন্য ওকে ঐ স্কুল থেকেই ছাড়িয়ে এনেছিল! অদ্ভুত না?

যাই হোক, অষুধ খাওয়া শুরুর পর থেকে আমার ঘুমের সমস্যা দূর হয়ে যায়। রাতদুপুরে বারান্দায়ও আর তাই যাওয়া হয় না। ঐ আলোটাকেও আর দেখি না। আমি মাঝে মধ্যে আমার চোখ দুটো বন্ধ করে মনের মধ্যে আলোটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করি, নাহ, আলোটাকে কিছুতেই মনের মাঝে আনতে পারি না।

৪.
কিন্তু, শেষমেশ একদিন বাসাটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ট্যাংকের পানি শেষ হওয়ার মতো খুব সিম্পল একটা ঘটনা থেকে বাড়িওয়ালার সাথে ঝামেলার সূত্রপাত, অতঃপর, আমার স্ত্রীই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল বাড়ি ছাড়ার। এসব ব্যাপারে আমি কখনোই নাক গলাইনি। আমার একটু খারাপ লাগতে থাকলেও, আমি নতুন বাসার খোঁজ করি। ঠিক জানি না, স্ত্রীর প্রতি নাকি আমার কাল্পনিক আলেয়া—কার প্রতি রাগ দেখিয়ে আমি এই এলাকা থেকে অন্তত মাইল চার-পাঁচেক দূরের এলাকায় বাসা ঠিক করি!

তারপর যেদিন ঐ বাসায় থাকার শেষ রাত, আমি বারান্দায় যাই। অদ্ভুত সেই আলোর সাথে চোখাচোখি হয়। কেন যেন মনে হয় আলোটা আজ আর আমাকে সম্মোহিত করছে না। সে নিজেও বিষাদগ্রস্ত। সত্যিই আজ আর সম্মোহিত হচ্ছি না! আমি ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।

৫.
সামনে আমার মেয়ের টেস্ট পরীক্ষা। আমি ওর সাথে বসে পেপার পড়ছি আর ও নিজের পড়া পড়ছে। জ্যামিতির উপপাদ্য বা এই টাইপ কিছুই বোধহয় পড়ছিল। সেই কত আগে এসব পড়ে এসেছি। এখন আর কানাকড়িও মনে নেই। বেশ স্পষ্ট উচ্চারণে সঞ্চারপথের সংজ্ঞা পড়ছে—কার্তেসীয় সমতলে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু এবং একটি নির্দিষ্ট সরলরেখা থেকে যেসব বিন্দুর দূরত্বের অনুপাত একটি ধ্রুবক, তাদের সেট একটি সঞ্চারপথ। আমার মেয়ে আবার নিজেই নিজেকে বুঝাচ্ছে, “..মানে, একটা জায়গায় দুইটা বিন্দু আছে। এরা যেখানেই যাক, যেভাবেই যাক এদের দূরত্ব সবসময়ই ধ্রুবক থাকবে। এরা কখনো কাছেও আসতে পারবে না, দূরেও যেতে পারবে না, এই টাইপ। ”

আমার হঠাৎ করেই কেমন যেন লাগতে থাকে। আমার শরীর অবসন্ন হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মাথায় ঘুরছে, এরা কাছেও আসতে পারবে না, দূরেও যেতে পারবে না। আমি ঘড়ির কাঁটার দিকে দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। আমার শরীর ক্রমাগত ঘেমেই যাচ্ছে। রাত যখন প্রায় একটা, আমি তখন এই নতুন বাসার বারান্দায় যাই। প্রায় সাত মাস হয়ে গেলেও এখনো এই বাসার বারান্দায় আমার পা পড়েনি। আমি লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চারদিকে তাকাই। হঠাৎ আমার শরীর কেমন শীতল হয়ে আসতে থাকে। ঐ তো, দূরের একটা জানালায় সেই পরিচিত আলো জ্বলে উঠেছে... নাকি আগে থেকেই জ্বলছিল? কে জানে?



বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।