ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কোলবালিশের সতীনের নাম ভালোবাসা | টোকন ঠাকুর

মুক্তগদ্য ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৬
কোলবালিশের সতীনের নাম ভালোবাসা | টোকন ঠাকুর

ত ভোরে, এই নদীকূলে এসে এখন কী দেখতে পাচ্ছি? কী দেখতে পাচ্ছি নদীর ওপরে থমকে থাকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে? নদীজল ও শূন্যতায় জমে থাকা কুয়াশাকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ফলে, নদীর ওপারে কী আছে, কী নেই ধরাই যাচ্ছে না।

এ নদীর নাম কী? জানা নেই। এ নদী ‘কোথা হইতে আসিয়াছে’ কোথায় যাচ্ছে—তাও ঠিক ঠাহর করা মুশকিল। ভোরের প্রথম রোদে নদী দেখব—এটা কোনো ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে না। নাকি করে? নদী পাড়ে এত শীত, এত শীত। নিশ্চয়ই শীত সংগ্রহ করতে আসিনি আমি! নিশ্চয়ই কুয়াশা কুড়োতে আসিনি! কী কুড়োতে এসেছি তবে? কী পেতে এসেছি তবে পৌষালি ভোরের নদীপাড়ে? যদি কবিতায় নদী ধরতে চাই, তাহলে তা ঘরে বসেই ধরা যায়। একটি শাদা পৃষ্ঠায় লিখে দিলেই হয়ে যায়, নদীর মধ্যে ঝাঁপ দিচ্ছে এক জলপিপি, বলে যাই, আমি জলপাখিটার যমজ ভাই। যদি কবিতায় কুয়াশা লিখাতে চাই, লিখতাম, কুয়াশাকে আপন বলে জানি, উতলা কুয়াশার মাকেও অামি চিনি, চিনতাম সেই শাদা থান পরা বুড়িকেও, যে কুয়াশার নানী। নিশ্চয়ই ভোর ভোর বলে কোনো ঘোরও আমাকে আজ, এখন, এই শীতের নদীর কূলে আপ্যায়নে ডাকেনি! নাকি ডেকেছে? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, উত্তর মিলছে না। প্রশ্নের পতাকা উড়ছে হাওয়ায়, হাওয়া বড্ড হৈম, এই হৈম হাওয়া আমাকে ডেকেছে? তবে আর এসেছি কেন?



তো নিজের কথায় আসি। মেয়েটি বয়সে আমার থেকে ছোট। আমি ওকে ভালোবাসি। বয়স আমার মধ্যে ফ্যাক্টর নয়, সমাজে ফ্যাক্টর। সমাজ কী? সমাজ হচ্ছে একটা গোয়ালঘর। এর বেশি বলা ঠিক হবে না। যে যৌনতা বাণিজ্যের ব্যাপার হয়ে অাছে দেশে দেশে, অপ্রকাশ্যে ঠিক আছে, প্রকাশ্যে নিষেধ। ভালোবাসা এখানো প্রকাশ্য নয়, নাকি ভালোবাসা ব্যাপারটা গোপনীয়, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়। কিন্তু আলোচনা করার চেয়ে ভালো না, ভালোবাসা? আবারও বলছি, আমি ওই রাইকিশোরীকে ভালোবাসি, কারণ, ভালোবাসতে ভাল্লাগে। ভাল্লাগাটা সুখ। সুখ কে না চায়? ‘দয়াল সুখেরও লাগিয়া...’ বলে কি কম গান শুনলাম?



ভোর-কুয়াশার ঝাপসাতিঝাপসা দৃশ্য-বাস্তবতার মধ্যেই দু’একটি পাখি, কী পাখি? তারা ঝুপ করে উড়ে গিয়ে নদীজল থেকে মাছ ধরে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। যন্ত্র-সভ্যতার কতদূরে এই নদীভোর? মনে হলো, ঠিক এ সময়ই দূরে ভেসে যাচ্ছে রেল-হুইসেল নয়, ওটা কি আমার শ্রুতি-কল্পনা? নিকটে-দূরে তো কোনো রেললাইনই নেই, হুইসেল আসবে কোত্থেকে? তবে কি আমার মনের মধ্যে কোনো রেললাইন চলে গেছে? মনের মধ্যেই প্রতিবিম্বিত আছে এক পুরোনো দিনের ইস্টিশন? মনে-মনের সেই রেল চলে গেল, এ সময়? নাকি কুরোসাওয়ার ‘কাক’ চিত্রে গমক্ষেতের মধ্যে যখন ভ্যানগগ হাঁটাছিলেন ইজেল-ক্যানভাস, রঙ-তুলি সরঞ্জাম নিয়ে, আর তক্ষুণি গমক্ষেতের ওপর দিয়ে কা কা করতে করতে উড়ে এলো একদল কাক, আর সে-সময়ই তীব্র শব্দে হুইসেল বাজিয়ে গেল একটি রেলগাড়ি, নিজের বন্দুকের গুলি আর্টিস্ট নিজের মাথায় চালিয়ে দিয়েছেন। এই ভোরে, শীতনদীর কূলে আমার মাথায় কি সেই শব্দ ঝাপটানি দিয়ে গেল? কিন্বা এরকমও কি পরে মনে হবে যে, ভেরের নদীপাড়ে কুয়াশায় প্লাবিত একটি ভোর, এরকম সাবজেক্টের একটি ওয়াটির কালার চিত্রের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সেই চিত্র শাসন করেছ সময়, পরিপার্শ্ব, আমাকেও? আরে না! তা হয় কী করে? আমি তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি কুয়াশা, কুয়াশার ভেতর দিয়ে পুবআকাশের আভা। আমি তো নিজের কানেই শুনতেই পাচ্ছি শব্দ, জলপিপিদের ডানার ঝাপাটানি। নিশ্চয়ই এ মাধুর্য মিথ্যে নয়, এই লাবণ্য মায়া নয়, সত্য। তাহলে, কী সেই সত্য, যার জন্যে আমি এত ভোরে আজ এই নদীকূলে ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো একাকি এসেছি? জেনে-বুঝে এসেছি? পথ চিনে এসেছি? সারারাত হাঁটতে হাঁটতে নদীপাড়ে এসে এসব দেখছি?

সারারাত হাঁটতে হাঁটতে এসেছি, মানে কী? রাতে মানুষ হাঁটে নাকি? ঘুমোয়। তাহলে আমি ঘুমোইনি? না-ঘুমোনো মানুষের দলে আমি! কেন? ঘুমোইনি কেন? নাকি ঘুমোতে পারিনি? কেন ঘুমোতে পারিনি? কতরাত ঘুমোইনি? কতরাত রাত আমি নির্ঘুম জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জানলার ভেতর দিয়ে আয় ঘুম আয় ঘুম ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি চিন্তা ধরেছি নামতা পড়েছি ঘুম ঘুম ঘুম আয় ঘুম ঘুম ঘুম হিম-মৌসুম পাড়ি দিয়ে দিয়ে কত কী দৃশ্য দেখতে দেখতে কত কী স্বপ্ন ভাবতে ভাবতে কত কী টপ্ন আঁকতে আঁকতে দাঁড়ি কমাহীন দীর্ঘ বাক্য হেঁটে ফেলেছি। এবার একটু থামি। কোথায় থামব? কোথায় থামব না, সেও এক ব্যক্তিগত নির্দেশের ব্যাপার। আমার ব্যক্তিগত নির্দেশক কে? কে আমাকে নির্দেশ করে এই ভোর নদীর বারান্দায় নিয়ে এসেছে? কার নির্দেশে আমি অনিদ্রিত, জানলা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছি! কার নির্দেশে আমি রাস্তার মোড়ের সেলুনঘরে ঢুকে পড়ি? আয়নায় তাকিয়ে কেন দেখে নিই, চুলগুলো ঠিক আছে কিনা! শার্টের কলারটা ভাঁজ ভাঙা ছিল। কার নির্দেশে সেলুন থেকে বেরিয়ে পোস্ট অফিসের পেছনে কমিনীগাছের গলি দিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই দিনে তিন-চারবার ঘোরাঘুরি করি? আসলেই। ব্যাপারটার নির্দেশক কে?

এই কে, কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জের পিরাইলে শর্ষেফুলের মাঠে গিয়ে হলুদের ওপর আছাড়ি-বিছাড়ি করে ব্যাপক ছবি-টবি তোলা হলো, কেন? কেন বারবার সমুদ্রে গেলাম। কেন? আমি কি মাছধরা জেলে, নাকি জাহাজের নাবিক? আসলে তো আমি তেমন কেউ না, সমুদ্র কেন ছোটখাটো নদীর একটা ঢেউও না, তাহলে আমি সমুদ্রে যাই কেন? এমন সম্ভাবনা তো আমি মোটেও দেখছি না যে, আমি বঙ্গোপসাগর লিজ নিয়ে চিন ঠেকাতে আমেরিকান বন্দর বানাব, কিচ্ছু না, তাহলে অামার সমুদ্রগমনের উদ্দেশ্য কী? কবিতা লেখার জন্য যে সমুদ্র দরকার, তা তো পুরাতন কবিতা পড়তে গিয়েই পেয়ে গেছি। তাহলে? আমি তো সন্তু লারমা বা ইউপিডিএফ-এর কেউ না। আমি ভ্যাটিক্যান পোপের প্রতিনিধিও না। যদি তাই হয়, তাহলে তো আমি পাহাড়ে যেতে পারি না। আমি বুদ্ধ বা অতীশ দীপঙ্করের ডিরেক্ট স্টুডেন্টও না। তারপরও, ‘পাহাড় আমাকে ডাকছে’ বলে একটি ছুঁতো বের করেই বান্দরবান-বগা লেক! কেওকারাডংয়ের চূড়ো! তেমনিভাবে, আমার জঙ্গলে যাওয়ার কথাও নয়। কোনো বনভূমিই আমার ব্লাড কানেকটেড নয়। তবু যাই। হিসেব-নিকেশ না করেই আমি যাই। খেয়াল থাকে না, খেয়াল রাখতেও চাই না যে, কোথায় যাচ্ছি/ খেয়াল যে রাখব, খেয়াল রাখার জায়গাই তো নেই। এমনকি অর্থ রাখারও জায়গা নেই। এমনকি আমার ঘুমোনোরও জায়গা নেই। বিছানা একটা আছে বটে, তবে সেখানে একা ঘুমোনো বিপদজনক মনে হয়। কেন একা ঘুমোনো বিপদজনক, সে ফিরিস্তি এখানে দেব না। তাইলে ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাবে। আচ্ছা, শিবের গীত ধরলাম না হয়, ‘প্রাতিষ্ঠানিকতার পুরাতন রোগ’কে সৌন্দর্য বলে মানতেই হবে? কেন? আমি মানলাম না। মানলে আছে, না মানলে নেই, দিগন্তরেখা। এ নিয়ে চার লাইনের একটা কবিতাও অাছে, অামার লেখা—‘ভূগোলমাসটার’-এ আমি এক যুগ আগে বলেছিলাম, ‘এই আকাশ আমার পিতা। মাটি আমার মা / আমি তাদের সন্তান, ঐ দিগন্ত। কিন্তু ভূগোলমাস্টার বলছেন—দিগন্ত একটি ধারণামাত্র। ’

তো যা বলছিলাম... কী বলছিলাম যেন! কোপার্নিকাসের সূত্রের কথা? কনফুসিয়াসের চিন্তার কথা? বিছানায় একা বিপদজনক শোয়াশুয়ির কথা? নাকি কে আমাকে নির্দেশ করে এই জলঝিরি নদীকূলে নিয়ে এসেছে, তার কথা? কার কথা? যার কথা শুনব বলে সারারাত হাঁটি? যার মুখ দেখব বলে মাইল মাইল চরাচরে নির্ঘুম রচনা লিখি। যার সঙ্গে দেখা হবে বলে আমি নদীর ওপারে যেতে চাই। কত কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি, যদিও, ‘আমার সকল গান তোমারেই লক্ষ্য করে। ’ এই গান নিশ্চয়ই ইংরেজি ‘গান’ নয়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, তাতে কী? সে-জন্যেই তো আমার ভালোবাসাটাও অনেক বড়। আমি না হয় কিছুকাল আগেই জন্মেছি, সে কি আশার ইচ্ছেয়? তুমি যে জন্মালে, সে কি তোমার ইচ্ছেয়? ভালোবাসি, ভালোবাসতে ভাল্লাগে, না বাসলে খারাপ লাগে, শরীর খারাপ হয়, মন খারাপ, মন-শারীর তো টু-ইন ওয়ান, খারাপ হলে বাঁচি কী করে? বুঝবা না? ‘তুমি’ না বুঝলে বেঁচে থেকে কী লাভ?

নদী দেখার নামে আসিনি, কুয়াশাও দেখাব না, কুয়াশা দেখার কিছু নেই ‘তুমি’ ছাড়া। ভোর দেখার কিছু নেই, তুমি ছাড়া। রেললাইন ধরে একা হাঁটা যায় না। কারণ, তোমার নিজেরও অজানা, তুমি আমাকে নির্দেশ করে চলেছো আর আমি সেই নির্দেশে নির্ঘুম আমি সহস্রবছর। আমার চোখের নিচে অগণন রাত্রির ইতিহাস গ্রস্থিত আছে। ইতিহাস কালো হয়ে গেছে। ইতিহাস ধুলো হয়ে গেছে, স্রেফ তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি বলে। ইউনিভার্সিটি এক ফুঁ-য়ে উড়িয়ে দিয়েছি, ক্লাস করিনি, দুপুরে খাওয়াও হয়নি, বিকাল থেকে সন্ধ্যা পার করে দিয়েছি তোমার পায়ের চপ্পলের শব্দ শুনব বলে। এত অপেক্ষা! এত উৎকর্ণ! ভালোবাসি বলেই। কাকে? তোমাকে। তুমি কে?

এই ‘তুমি’ কোথায় থাকে, কবি নিয়োজিত হলো তুমিতে। এই তুমি’র সন্ধানে কত রক্তপাত, কত স্বপ্নভঙ্গ! বাঙালি নারীর হাতে সেলাই করা কাঁথায় ফোঁড়ে ফোঁড়ে যেমন তার শ্বাস-দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকে, প্রতিটি কবিতায় শব্দের ভাঁজে ভাঁজে তুমি লুকিয়ে আছো, এ তুমি জানো না। তুমিই জানো না তুমি লুকিয়ে আছো কবির কবিতার ভাঁজে ভাঁজে। কারা যেন গান গেয়ে যায়—‘এ তুমি কেমন তুমি?’

‘তুমি’ তো তুমিই। তুমি আবার কেমন হবে? তোমায় যেমন ভাবি আমি, তুমি কি ঠিক সেই রকমই তুমি। তোমার নির্দেশেই না আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শাদা শূন্যতায় ছড়িয়ে দিয়েছি ‘সাতটি তারার তিমির!’

কারণ, তোমাকে ভালোবাসি। কারণ, তোমাকে ভালোবাসতে আমার ভাল্লাগে। কারণেও ভাল্লাগে, অকারণেও লাগে। কী যে লাগে! এই লাগাটা কী জিনিস—এই নিয়ে সমাজের তিনজন গুণী মানুষকে আমি জিজ্ঞাসা করেছি। বলি একটু? একজন অধ্যাপককে বললাম, বলুন তো লাগাটা কী জিনিস?’ অধ্যাপক ভ্রু কুঁচকে জানতে চান, ‘লাগা মানে?’ বললাম, ‘ভাল্লাগা। ’ তারপরও অধ্যাপকের চোখ ব্যাকরণ থেকে সরে না, বললেন, ‘কী বলছেন এসব? এ প্রশ্ন আমাকে কেন?’ আমি ‘ভাল্লাগা’ কথাটার অর্থ অধ্যাপকের কাছে ভালো করে তুলতেই পারলাম না। ফলে, এরপর পাই ব্যবসায়ীকে, বলি, ‘ভাল্লাগার কারণ বলতে পারেন? ‘কী ভাল্লাগার?’ ‘মানে ভালোবাসতে ভাল্লাগার কথা বুঝাচ্ছিলাম আর কি!’ ব্যবসায়ী আমাকে বলে দেন, ‘এসব নিয়ে ভাবার মতো টাইম কোথায় বলুন, আমাদের তো কাজ করে খেতে হয়। ’ তোমাকে যে আমার ভাল্লাগে, সে কথায় কারণ খুঁজে না পেয়ে গেলাম এক ডাক্তারের চেম্বারে। সব বলি ডাক্তারকে। তিনি ফিজিওথেরাপিস্ট। বললেন, ‘আপনার তো শারীরিক প্রবলেম দেখছি না, সমস্যা কী?’ বললাম, ‘আমার এক তুমিকে খুব ভাল্লাগে। কিন্তু বয়সে আমার থেকে বেশ ছোট বলে তাকে ঠিক কিছু বলতেও পারছি না। আই লাভ ইউ যদি বলি, শুনে সে যদি আমাকে বলে, আগেও যেরকম একজন বলেছিল, আঙ্কেল, আপনার কবিতা পড়েছি। ভালো লেগেছে। যদি ওরকম হয়?’

ডাক্তার আমাকে সমাধান দিতে পারলেন না, ডাক্তার তো শেষপর্যন্ত আমাকে জ্ঞান দিতে শুরু করলেন, ‘আরে ভাই, বয়স একটা ফ্যাক্টর না?’ কিসের ফ্যাক্টর?’ ‘ফ্যাক্টর বলতে মনে করেন মেয়েটার তো আপনার কবিতা ভাল্লাগছে, তাই বলে সে কি আপনার কবিতা নিয়ে নেবে নাকি?’ নিতে চাইলে নিক। দিয়ে দেব। কবিকেও দিয়ে দেব। ’ ‘কবি দিয়ে সমাজের কী হয় শুনি?’ ‘ কিছুই হয় না। ’

আমি চলে আসি ‘কিছুই হয় না’ বলে। কিন্তু আমার কিছু হচ্ছে। সবসময়, মনের মধ্যে একটা চৈত্র চৈত্র হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, গাছ থেকে শুকনো পাতারা ঝরে ঝরে পড়ছে আমার বুকের ওপর, আমি মাটিতে শুয়ে আছি। আমি গাছ হয়ে যাচ্ছি। আমার পাতা ঝরে যাচ্ছে। আমার গায়ে হাওয়া লাগছে। চৈত্র চৈত্র হাওয়া। খর্খরে হাওয়া। কী নেই কী নেই হাওয়া। বসন্তে তাই মোটেই ভাল্লাগছে না। ভাল্লাগে তোমাকে। তুমি কোথায়? শুধু কবিতায়? পুরা একটা টোস্ট বিস্কুট খেয়ে এক গ্লাস পানি খেলেও একবেলা কাটানো যায়, পুরো একটি কাব্যগ্রন্থও খেয়ে বাঁচা যায় না। খাওয়াই যায় না।
কিন্তু টোস্ট-বিস্কুট আর কতক্ষণ? খেতে হবে এক থালা ভাত। এক থালা ভাত নিশ্চয়ই ‘কালবেলা অবেলা’র চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী। খেয়ে বাঁচা যায়। খিদে পেটে এক থালা ভাতের কণার মতো নক্ষত্রদানা হলে কি চলবে? কিন্তু ভাত খাওয়ার পর না হয় একটা বিড়িও ধরালাম, তারপর ধরাব কী? মন? ভালোবাসার কথা মানেই মনের কথা, ভালোবাসার ব্যাপার মানেই মনের ব্যাপার—এটাই দেখি। আবার মনই বা জিনিসটা কী? মন শরীরের কোন জায়গায় অবস্থিত? ‘দেহ পাবি মন পাবি না’ বলে ভিলেনের আস্তানায় নায়িকা যে চিৎকার করে বলল, এর অর্থ কী? নায়িকার দেহ যতটা ফ্যাক্টর, মনও ফ্যাক্টর, বুঝলাম, কিন্তু নায়িকার দাদী-নানীর মন-দেহ কি ফ্যাক্টর না? ভালোবাসায় যৌবন ও যৌনতা যে তীব্র উপাদান, তা তো অস্বীকারের কিছু নেই। নেই বলেই, বুড়ি বা বুড়োদের চরিত্রে ভালোবাসার ব্যাপারস্যাপার নেই। ভালোবাসা সব যুবক-যুবতীদের ফ্যাক্টর। কারণ, যৌবন, যৌনতাকে এড়িয়ে যে কবিতা, যে শিল্পকলা, তা আসলে হয় শিশুতোষ না হয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শিল্পকলা। বাংলাদেশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শিল্পকলার দেশ, যদিও ভালোবাসার ভেতর দিয়েই সবার যাত্রা চলছে মানে যৌবন-যৌনতার ভেতর দিয়েই মানব-বংশের যাত্রা অব্যহত আছে। নইলে ধেই ধেই করে বিশ কোটি মানুষ হয়ে গেল কী করে?

তো নিজের কথায় আসি। মেয়েটি বয়সে আমার থেকে ছোট। আমি ওকে ভালোবাসি। বয়স আমার মধ্যে ফ্যাক্টর নয়, সমাজে ফ্যাক্টর। সমাজ কী? সমাজ হচ্ছে একটা গোয়ালঘর। এর বেশি বলা ঠিক হবে না। যে যৌনতা বাণিজ্যের ব্যাপার হয়ে অাছে দেশে দেশে, অপ্রকাশ্যে ঠিক আছে, প্রকাশ্যে নিষেধ। ভালোবাসা এখানো প্রকাশ্য নয়, নাকি ভালোবাসা ব্যাপারটা গোপনীয়, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়। কিন্তু আলোচনা করার চেয়ে ভালো না, ভালোবাসা? আবারও বলছি, আমি ওই রাইকিশোরীকে ভালোবাসি, কারণ, ভালোবাসতে ভাল্লাগে। ভাল্লাগাটা সুখ। সুখ কে না চায়? ‘দয়াল সুখেরও লাগিয়া...’ বলে কি কম গান শুনলাম?

আমাদের এক কবি, আকালপ্রয়াতই বলা যায়, ত্রিদিব দস্তিদার। তার একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব। ’ দ্যাখেন, কী সাংঘাতিক আত্মবিনাশী উচ্চারণ। ভালোবাসার আত্মনাশও ঘটে। সেই ঘটাটাই তার ভালোবাসা, তার ভাল্লাগা। ভাল্লাগা যার যার মতোন, কেউ শুটকি মাছ খেতে দারুণ ভালোবাসে, কারো শুটকি মাছের রান্নার ঘ্রাণ বা গন্ধেই বমি আসে। তাহলে ভালোবাসা হচ্ছে শুটকিমাছের বাস্তবতা, বলা যায়? না, কিছুই বলা যায় না, ভালোবাসায় কিছু না বলেও বলা হয়ে যায়। কোনো ভাষাই লাগে না, ইঙ্গিত হলেই হয়। এরপর ইঙ্গিতও লাগে না, জাস্ট একটা লুক। দেখা। কিন্তু না দেখেও, না জেনেও ‘পিরিত’ হয়ে যায়, রেকর্ড আছে। রেকর্ড হ্যাছ।

তাহলে কী দাঁড়াল? কিছুই দাঁড়াল না। সবই বসে গেল। বসেও নেই, শুয়ে পড়ল। ভালোবাসা শুয়ে পড়ল আমার পাশে, ভালোবাসা শু’লো বলে কোলবালিশ সরে গেল। কোলবালিশ যেন তার সতীনকে দেখতে পেল আমার পাশে, এককথায়, কোলবালিশের সতীনের নাম ভালোবাসা, যদি সে আমার পাশে শোয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমাকে মুড়িয়ে ধরে। আমাকে পেঁচিয়ে মারে। আমাকে খুঁচিয়ে মারে। শীতের রাতেও আমাকে বিবস্ত্র করে ছাড়ে, সেই তবে ভালোবাসা। সেই আমার ভাল্লাগা। সেই আমার দেবী, যতই সে বয়সে আমার চেয়ে বড়, সমান বা ছোট মোটা হোক, তাকেই আমার প্রণতি, প্রেম, পূজা, অর্ঘ্য, সমর্পণ। সেই তাকেই তো বলি ‘তুমি’। ভালোবাসার ‘তুমি’র সঙ্গে যখন আমি মুখোমুখি, কাছাকাছি, পাশাপাশি উৎকর্ণ থাকি, শুনতে পাই, অ্যাম্বিয়েন্স রীতিমতো। কেমন যে লাগে। আমি ওর দিকে তাকাই, ও আমার দিকে তাকায়, লোকেশন নদীর ধার, ব্যাকগ্রাউন্ড সানাই, আর কোনো ক্যারেক্টর নেই, সময় ভোর, এরকম একটা প্রাকৃত বাস্তবতায় আমরা দুজন, আমি আর আমাকে ‘আঙ্কেল, আপনার কবিতা আমার ভাল্লাগে’ বলা রাইকিশোরী, আমরা পরপর দেখছি। আমার ভাল্লাগতেছে। ভাল্লাগাটাই সুখ। অনেক গান শুনেছি, ‘দয়াল সুখেরও লাগিয়া...। ’ সুখ পাচ্ছি। সুখ পাচ্ছো তুমি? ওহ্ সুখ! আহ্ সুখ!

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলে এক লোক ছিলেন, সেই লোক বলেছেন, ‘ওরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, কেবলই মায়ার ছলনায়...। ’ এ কী কথা? আসলে কথার কি আর শেষ আছে? ভালোবাসারও শেষ নেই। ভালোলাগারও শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথেরও কথার কোনো উল্টো-সোজা নেই। একরাতে কবি লিখলেন, ‘যাব না আজ ঘরের বাহিরে’ আবার অন্য একরাতে তিনি উল্টো লিখলেন, ‘বাহির আমার ডাক দিয়েছে, থাকব না কো ঘরে। ’ যখন যা হচ্ছে, লিখেছেন। যখন যা ইচ্ছে, তা পূরণই সুখ। সুখই হলো ভালো লাগা, ভালোবাসা। এ নিয়ে এত কথারও কিছু নেই, বিষয়টা বলার নয়, লেখারও নয়, করার, অনুভব করার, রূপায়ণ করার। করতে করতে, অনুভব করতে করতে, অনুভূতির মধ্যদিয়ে একটা রাস্তা মনে হয় পাওয়া যায়। সেই রাস্তায় কোনো জ্যাম-জুম নেই, আমি হাঁটতে হাঁটতে যাই, ভাবতে ভাবতে যাই, সুখ-ভালোবাসা পাই, পেতেই তো চাই। দিতেও চাই। এই পেতে চাওয়া আর দিতে চাওয়া যখন এক সুতোয় দাঁড়িয়ে যায়, সঙ্গম হয়ে যায়। কবিতা হয়ে যায়। তখনই মূলত ‘সুখ’ শব্দটা লিখিত রূপ থেকে ইমপ্লিমেন্টেশনে পৌঁছয়। আমি তা ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই লিখি, লিখি না। ভালোবাসি বলেই ঘুমোই, ঘুমোই না। সারারাত হাঁটতে হাঁটতে কোনো এক নদীতীরে এসে পৌঁছই, যে নদীর নাম আমার জানা নেই। ভালোবাসি বলেই ছবি, ছবির মধ্যে ছবি হয়ে থাকার আনন্দ লাভ করতে চাই।

এই আনন্দ চাই বলেই ভালোবাসা, ভালোবাসা আছে বলেই বেঁচে আছি, নইলে দুনিয়ার মতো এই অাকাটা জায়গায় থাকে কে?



বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।